২০০২ সালের জুনের ২১ তারিখ। ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল। ইংল্যান্ডের তখন সোনালি প্রজন্ম; পল স্কোলস, ডেভিড বেকহাম, রিও ফার্ডিনান্ড, মাইকেল ওয়েনের মত খেলোয়াড়দের নিয়ে ইংল্যান্ডের দল সাজিয়েছিলেন তৎকালীন কোচ এরিকসন। অন্যদিকে, ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে ছিল রবার্তো কার্লোস, কাফু, রিভালদো, রোনালদো এর মত বড় নামগুলো।
ম্যাচের ২৩ মিনিটের সময় ইংলিশদের হয়ে মাইকেল ওয়েনের গোল; লিড ইংল্যান্ডের। পিছিয়ে পড়া ব্রাজিল সমর্থকদের মন তখন শঙ্কিত; ৯৮’ বিশ্বকাপের মত আবারো কি হাত ছাড়া হবে সোনালি ট্রফি? প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ে অবশ্য গোল করে ব্রাজিলকে সমতায় ফেরান রিভালদো।
এরপর ঘটে এক নাটকের মঞ্চায়ন। ম্যাচের প্রায় ৫০ মিনিটে ফ্রি কিক প্রায় ব্রাজিল। চল্লিশ গজ দূর থেকে বাঁকানো শটে মারা ফ্রি কিকটি ইংলিশ গোলরক্ষক ডেভিড সিম্যানকে বোকা বানিয়ে এমনভাবে গোলটি হয়েছিল যে সেটি বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল। সেই খেলোয়াড়টি হলেন রোনালদিনহো গাউচো, আরো স্পষ্ট করে বললে তিনি ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে নান্দনিক দলটির অন্যতম নান্দনিক কাণ্ডারি।
উল্লেখ্য, সেদিন প্রথম গোলের অ্যাসিস্টও করেছিলেন ওই রোনালদিনহো। তারকাখচিত এক ব্রাজিল দলের হয়ে খেলতে নেমে তারকাদের পিছনে ফেলেই কোয়ার্টার ফাইনালের নায়ক হওয়ার মাধ্যমেই শুরু এক জাদুকরের গল্প।
১৯৮০, ২১ মার্চ জম্ম ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রেতে। ফুটবলের তীর্থস্থান ব্রাজিলে আরেক ফুটবল কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিল সেদিন, তা হয়তো কেউ সেদিন বুঝতেই পারেনি। সবাই ডাকতো ‘গাউচো’নামে। ছোটবেলায় ফুটসাল দলের সব থেকে ছোট সদস্য ছিল, তাই নাম দেওয়া হয় ‘রোনালদিনহো’ সব মিলিয়ে নামটা দাঁড়ালো ‘রোনালদিনহো গাউচো’। আদতে তিনিও আরেক রোনালদোই। কারণ, পুরো নাম হল রোনালদো ডি অ্যাসিস মোরেইরা।
ছোটবেলা থেকেই স্থানীয় ক্লাবগুলোতে নজরকাড়া পারফরম্যান্স করা রোনালদিনহোকে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব গ্রেমিও নিজেদের দলে আনে। গ্রেমিও’র যুব দলে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু। এরপর ১৯৯৮ সালে সিনিয়র দলে অভিষেক। গ্রেমিও’র হয়ে ৪৮ ম্যাচে করেন ২৩ গোল।
গ্রেমিওর হয়ে খেলার সময় একটি ম্যাচে তাঁর প্রতিপক্ষ দলে ছিল ব্রাজিলের ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কার্লোস দুঙ্গা। যে দুঙ্গাকে টিভিসেটের সামনে বিশ্বকাপ ট্রফি নিতে দেখেছিলেন, মুখোমুখি দেখায় সেই দুঙ্গা’কে বার কয়েক মনোমুগ্ধকর ড্রিবলিঙয়ে বোকা বানিয়েছিলেন দিনহো।
ক্রুইফের বিদায়ের পর ভঙ্গুর তখন বার্সেলোনা। ২০০৩ সালে সেই ভঙ্গুর বার্সেলোনায় সৃষ্টির প্রতিজ্ঞা নিয়েই পা রাখেন রোনালদিনহো। ২০০৪-০৫ মৌসুমে চল্লিশেরও বেশি গোলে অবদান রেখে তিনি বার্সেলোনাকে জেতান লিগ শিরোপা। আর এর পরের বছর প্রায় নিজ কৃতীত্বেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে নিয়ে আসেন ন্যু ক্যাম্পে। সে বছর লা লিগা’র শিরোপাও নিজেদের করে নিয়েছিল বার্সেলোনা। চার বছর শিরোপাহীন থাকার পর দিনহো’র আগমনে তিন বছরেই জিতে নেয় তারা দুটি লিগ শিরোপা আর একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।
২০০৫ সালের ১৯ নভেম্বর, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খেলতে এসেছিল বার্সেলোনা। সেই ম্যাচে ২ গোল করেন। তার দল জিতেছিল ৩-০ গোলে। শুধু গোল নয়, দিনহো পুরো ম্যাচেই খেলেছিলেন অসাধারণ। কতটা অসাধারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর হবে এতটাই অসাধারন খেলা তিনি পুরো ম্যাচ খেলেছিলেন যে, সম্পূর্ণ বার্নাব্যু সেদিন তাঁকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে চেলসির বিপক্ষে প্রায় নাচের ভঙ্গিতে করা গোল, সেমিফাইনালে মিলানকে বিদায় করে দেয়া ডিবক্সের বাইরে থেকে করা গোল কিংবা লিওনেল মেসির প্রথম গোলের পর তাকে কোলে নিয়ে উদযাপন; বার্সা ভক্তদের জন্য রোনালদিনহো’র এমন বহু আইকনিক দৃশ্য রয়ে আছে যা হয়তো মুছে ফেলা যাবে না।
১৯৯৯ সালে কোপায় ব্রাজিল সিনিয়র টিমে ডাক পেয়েছিলেন; সেই টুর্নামেন্টেই পান কোপা জয়ের স্বাদ। এরপর একই বছর ফিফা কনফেডারেশন কাপে খেলতে গিয়েছিলেন। ফাইনাল ছাড়া বাকি সব ম্যাচে গোল করলেন রোনালদিনহো। সাথে একটি হ্যাট্রিক। ব্রাজিল ফাইনালে হারলেও, দিনহো জিতেছিলেন সেবার গোল্ডেন বলের পুরস্কার। সাথে গোল্ডেন বুটও।
২০০২ বিশ্বকাপে যখন কোচ লুই ফিলিপ স্কলারি যখন রোমারিও নয় বরং ২২ বছরের তরুণ দিনহোর ওপর ভরসা করেছিল সেদিন কয় জন বিশ্বাস রেখেছিল তার উপর? তবু বিশ্বকাপ শেষে যখন ট্রফি হাতে দেশে ফিরেছিল সেলেসাও’রা তখন পুরো বিশ্ব জেনে ফেলেছিল সেই তরুণকে ৷ ভরসা করতে পেরেছিল তরুণের পা-জোড়াকে।
রিভালদো আর রোনালদো এর সঙ্গে সেসময় গড়েছিলেন ‘ট্রিপল আর’। তৎকালীন দলগুলোর কাছে এমন আক্রমণ-ত্রয়ীর জন্য কোন উত্তর জানা ছিল না। জিতেছেন বিশ্বকাপ,কোপা আমেরিকা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সবই, ব্যক্তিগতভাবে ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারও রয়েছে তার ঝুলিতে। খেলেছেন বার্সেলোনা, এসি মিলানের মত দলের হয়ে। নান্দনিক ফুটবল, পাসিং, প্রেসিং , ড্রিবলিং – সাথে উঁচু দাঁত বের করে সেই ট্রেডমার্ক হাসি – কি ছিল না তাঁর মধ্যে। দিনহোর ফুটবল ক্যারিয়ারটা ছোট হলেও সেখানে অপূর্ণতা ছিল না তেমন।
কিন্তু, এতসব পূর্ণতার মাঝেও রয়ে গিয়েছে একটুখানি আক্ষেপ; ইনজুরি। যার অভিশাপে ২০০৬-০৭ এর পর থেকেই ধীরে ধীরে নিজেকে হারাতে শুরু করেছিলেন দিনহো। ইনজুরি না হলে হয়তো আরো দীর্ঘায়িত হতো এই গল্পকারের গল্প। তারপরও তিনি আছেন সর্বকালের সেরাদের একজন হয়ে, তিনি আছেন সবার মনের মণিকোঠার স্থায়ী হয়ে। ব্রাজিল ফুটবলের ভক্ত নয় এমন অনেকেও হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন এই রোনালদিনহোকে।