আরিয়েন রোবেনের বিদায়বেলা খুব নিশ্চুপ। সমসাময়িক খেলোয়াড়দের সাথে তুলনা, লেখালেখিকে অনেক পিছনে রেখে রবেনের বিদায়লগ্ন একা বালুচরে হেঁটে যাওয়ার সামিল। খুব মনে পড়ে, ২০০৮ ইউরো। রাশিয়ার কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে গেল হল্যাণ্ড। ২০০০ পরবর্তী নেদারল্যান্ডস কিছুটা অস্তমিত সে সময়।
রুদ ভ্যান নিস্তলরয়, ভ্যান পার্সি, রোবেন-স্নেইডার তখন সবে শুরু করছেন। বাঁ পায়ে বলটাকে ইনসাইড আউট করাটা সহজাত, বডি ফেন্টে অপনেন্টকে বোকা বানানোও। নেদারল্যান্ডস এমনিতেই অভাগা দেশের মধ্যে পড়ে। অনেক আশা-নিরাশার কাব্যতীর্থ, বহু হাহুতাশের ফিসফাস।
যে সময়ের কথা, তার কিছু আগে রোবেন সদ্য চেলসিতে যোগ দিলেন। হোসে মরিনহো তখন ইউরোপের ফুটবলে নব নক্ষত্র, সদ্য পোর্তোকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেতাব ধরিয়েছেন। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজকেও নিরাশ করেননি, দু’বার ইপিএল-সহ এফএ কাপ দিয়েছেন। এ হেন রোবেন যখন রিয়ালে প্রবেশ করছেন, তখনই স্নেইডারের আগমন। দুই বন্ধুর যাত্রাপথের কার্যত সেই শুরু। এরপর রোবেন বায়ার্নে আর স্নেইডার ইন্টার মিলানে চলে গেলেও অটুট থেকেছে এই বন্ধুত্বের কাহিনী।
রোবেনের কথা উঠলে মনে পড়ে যায় ২০১০ বিশ্বকাপ। সাহসী ক্যাসিয়াসের গোল ছেড়ে বেরিয়ে আসা। রবেনের হতাশ নয়নে ললাটস্পর্শ। পাদপ্রদীপের আলো থেকে চিরাচরিত শব্দ – ট্র্যাজিক নায়কের উপাখ্যান। সে বিশ্বকাপে অনবদ্য উরুগুয়েকে সেমিতে ৩-২ এর নেপথ্যে বামপ্রান্তে খেলে যাওয়া এক টাকমাথা স্প্রিন্টার। অবিশ্বাস্য গতি, সঙ্গে বল কন্ট্রোল দেখার মত।
রোবেনের অনেক কিছু পাওয়ার ছিল দেশের হয়ে। পাননি। যেমন পাননি স্বদেশীয় ডেনিস বার্গক্যাম্পও। যেমন পাননি মার্স ওভারমার্স, প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট, ভান পার্সি, স্নেইডাররা। রবেন তাদেরই প্রতিনিধি, যারা ট্র্যাকের খুব কাছে এসেও ফাইনাল মার্কে আগে পা ছোঁয়াতে পারেননি। থেমে গেছে একটু দূরে, যেথায় হাত বাড়ালেই মিলতো সোনার সন্ধান।
কিংবা ২০১৪ বিশ্বকাপে সেই ক্যাসিয়াসকেই পরপর দু’বার পরাস্ত করা। ৫-১ এর ম্যাচে দুটো গোল এসেছিল রোবেনের পা থেকে। তার একটা হল ডানদিক থেকে রামোসকে টেনে নিয়ে সেই গতিময় ফুটবল! শেষে দুরন্ত কন্ট্রোলে বাঁ পায়ে শট। এবং সেটা অতিমানবীয় বাঁ পা। রবেন এমন একজন মিডফিল্ডার যার পায়ে বল পড়লে ভয় গ্রাস করতো। প্রিয় দলের বিপক্ষে খেলা পড়লে আরও বাড়ত সে ভয়।
তেমনই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যান ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে ম্যাচ। অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে বায়ার্নের জেতা এবং ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে হারকেও ছাপিয়ে যায় রোবেনের ভলি। রবেনের কর্নার কিক থেকে স্নেইডারের ব্রাজিল সংহার। রবেন মানে অনেক স্মৃতি, ভাললাগা-মন্দলাগা মিশিয়ে। সব স্মৃতি তো নথিভুক্ত থাকে না, মনে থেকে যায় বহুযুগ ধরে।
আরিয়েন রোবেনের ক্যারিয়ার জুড়ে চোট-আঘাতের বর্ষা। তা সত্বেও ডাচ দলে কামব্যাক, বায়ার্নে কামব্যাক। ডান পায়ে বল নিয়ে বাঁ পায়ে ফেন্ট করে তুলনাহীন দৌঁড়ে এগিয়ে যাওয়ার নাম রোবেন। যার শরীরী ভাষার মধ্যে বরাবর একটা চ্যালেঞ্জিং মনোভাব। নাছোড়বান্দা। স্পেনকে একাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা। উপর্যুপরি দু’বার সোনায় মোড়া ট্রফিটার কাছে এসে থেমে যাওয়া হারকিউলিস।
আইন্দোনভান, স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ, স্যান্টিয়োগো বার্নাব্যু হয়ে আলিয়াঞ্জ এরিনায় যে যাযাবরের পথ বেঁকে গেছে। সেই আর্জেন রবেন মানে মাসচেরানোর কাছে আটকে যাওয়া, দূরে দাঁড়িয়ে বন্ধু স্নেইডারের পেনাল্টি মিস দেখার পর হতাশার চাদরে মুড়ে যাওয়া। অথবা আর্জেন রবেন মানে ছেড়ে আসা বার্নাব্যুতেই পরের মৌসুমে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে হার, রবেন মানে কত কত স্মৃতি।
সেই রোবেন এবার তুলে রাখলেন বুটজোড়া। এগারো নম্বর জার্সি। আরিয়েন রোবেন চলে যাচ্ছেন ফুটবল ছেড়ে, সবুজ ঘাসে ফেলে যাওয়া রূপকথার পাহারা ছেড়ে। আর আমার মনে পড়ে যাচ্ছে ইতিহাসে পড়া একটি দিনের কথা। দিনটা ১৩ মার্চ, ১৮৫৬। শেষ বারের মত অযোধ্যা ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন জাহনে-আলম, অওধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ। গন্তব্য, কলকাতা।
যাত্রাপথে এক জায়গায় তাঁবু পড়েছে, খাওয়া-দাওয়া চলছে। নবাবের বড় গানবাজনার শখ ছিল, সেই গানও চলছে ঢিমেতালে। আর কিছুদূরে বসে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ তাঁর নিজের লেখা কয়েকটি লাইন গুনগুন করছেন। আর্জেন রবেন ডাচ দলের সেই নি:শব্দ নবাব, যিনি তাজ ছেড়ে চলে গেলেন পরের প্রজন্মের হাতে। ডাচ দলে এর পরেও প্রতিভা আসবে, জন্মাবে, ফুটবল খেলবে। কিন্তু একটা আর্জেন রবেনের প্রতীক্ষায় দিন বয়ে যাবে ফল্গুধারার মত। বছরের পর বছর, বছরের পর বছর।
অবসর নিলেন আরিয়েন রোবেন। নবাব গাইছেন –
দর-এ-দিওয়ার পে হাসরত সে নজর করতে হ্যায়,
খুশ রাহো এহলে ওয়াতন, হাম তো সফর করতে হ্যায়…