এক ইংলিশ গ্রেটের আক্ষেপ

ক্যারিয়ার তিনি শেষ করেছেন ১৩৩টি টেস্ট খেলে, ইংল্যান্ডের জন্য এটা রেকর্ড। কে ভেবেছিল - ২৭ বছর বয়সে অভিষিক্ত কেউ একজন এই রেকর্ড ছুঁতে পারবেন। আবার তাঁর আক্ষেপও কম না। অনেকেই মনে করেন, উইকেট রক্ষণের চাপ না নিলে ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর রেকর্ড আরো সমৃদ্ধ হত। বিশুদ্ধ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন একাদশে ছিলেন, তখন তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৪৬। আর উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে ৩৫! বোঝাই যাচ্ছে - পার্থক্যটা নেহায়েত কম নয়!

ক্রিকেটের বাপ কা বেটা – এমন নজীর আছে বিস্তর। কেউ কেউ বাবাকে ছুঁতে পারেন না বাইজ গজের জীবনে। তবে, কেউ কেউ ছাড়িয়ে যান বাবাকেও। আজ তেমনই এক বাবা-ছেলে জুটির কথা বলবো। তাহলে হলেন মিকি আর্থার ও অ্যালেক স্টুয়ার্ট। দু’জনেই ইংল্যান্ডের হয়ে জাতীয় দলে খেলেছেন। বাবা মিকি স্টুয়ার্ট ও ছেলে অ্যালেক স্টুয়ার্ট দু’জনেই ইংল্যান্ড জাতীয় দল সহ কাউন্টি দল সারের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন।

অবশ্য বাবা মিকি শুধু পেশাদার ক্রিকেটার ছিলেন না, তিনি পেশাদার ফুটবলারও ছিলেন। মিকি স্টুয়ার্ট মোটে ৮ টেস্ট খেললেও ছেলে খেলেছেন ১৩৩ টেস্ট! সেই সাথে নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও ছিলেন তিনি! এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ছিলেন অ্যালেক।

জন্ম ১৯৬৩ সালের আট এপ্রিল। পুরো নাম অ্যালেক জেমস স্টুয়ার্ট। ১৯৮১ সালে ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল সারের হয়ে ক্রিকেটে পা দেন। যেই দলের হয়ে বাবা মিকি স্টুয়ার্ট ১৮ বছর ক্রিকেট খেলেছেন সেই দলের হয়েই ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয় অ্যালেকের! ছেলেবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবেন। বাবা-ছেলে দু’জনেই সারের হয়ে ক্রিকেটে অনেক অবদান রাখেন। আর সেজন্যই সারে ক্রিকেট ক্লাবের পক্ষ থেকে বাবা-ছেলেকে এক অনন্য সম্মাননা দেওয়া হয়।

সারে ক্রিকেট ক্লাবের মূল ফটকের নামকরণ করা হয় অ্যালেক স্টুয়ার্টের নামেই। আর সেই ক্লাবের একটি প্যাভিলিয়নের নাম রাখা হয় তার বাবা মিকি স্টুয়ার্টের নামে। এই ব্যাপারে পরে মজার ছলেই ছেলে বলেছিলেন, ‘প্যাভিলিয়নে যেতে হলে সবার আগে গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। সে হিসেবে আমি একটি এগিয়েই আছি।’

যেহেতু বাবা দীর্ঘদিন ধরে সারের হয়ে খেলেছেন সে হিসেবে অ্যালেকের প্রিয় দল ছিল সারে এবং ফুটবলে তিনি সমর্থন করতেন চেলসিকে! তার প্রিয় খেলোয়াড় ছিল চেলসির জন হলিন্স। প্রিয় খেলোয়াড়ের সাথে জার্সির নাম্বার মিল রেখে আন্তর্জাতিক ওয়ানডে অভিষেকের সময় ৪ নম্বর জার্সি বেছে নেন তিনি এবং পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই সেই নম্বর জার্সিতে ব্যবহার করেন! তাকে সতীর্থরা ‘দ্য গ্যাফফার’ বলেও ডাকতেন।

যেই ছেলেটা ক্রিকেটার হবে শুনে তার বাবা কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই ছেলেটিই কিনা পরবর্তীতে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ছোটবেলায় একবার ছেলেকে নিয়ে স্টেডিয়ামে এক ফুটবল ম্যাচ দেখছিলেন মিকি। সেখানে দর্শকদের তিনি দেখিয়ে বলেন এখানে কেউই প্রোফেশনাল খেলোয়াড় হতে পারবেনা, হলেও হয়তো একজন হবে। বাবার কথা শেষ না হতেই হাত উঁচু করে অ্যালেক জানিয়ে দিলেন যে তিনিই হবেন সেই খেলোয়াড়!

অ্যালেকের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক হয় ১৯৮৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে। এরপর পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক! ১৯৯২ সালের চার জুন এজবাস্টনে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে নিজের ক্যারিয়ার সেরা ১৯০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে কেনিংটন ওভালে ৭ম ইংলিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরির (১১৮ & ১৪৩) রেকর্ড গড়েন অ্যালেক! ৪০ এর নিচে এভারেজ নিয়ে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে ৮ হাজারের বেশি রান করা ব্যাটসম্যান তিনি৷

ইংল্যান্ডের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার পর প্রায় ৪৭ গড়ে ৫১ টেস্টে নয়টি সেঞ্চুরি করেন অ্যালেক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংলিশ ওপেনার হিসেবে তার উপরে টেস্টে ব্যাটিং গড়ের দিক থেকে আছেন শুধুমাত্র লেন হাটন, জিওফ বয়কট, ডেনিস আমিস ও স্যার এলাস্টার কুক!

কোনো ডাবল সেঞ্চুরি না করেই সবচেয়ে বেশি টেস্ট রান (৮৪৬৩) করার রেকর্ডটি অ্যালেকের দখলে! ওপেনিং ব্যাটিং সাথে উইকেটরক্ষক ও অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (২৮) খেলা ক্রিকেটার হলে অ্যালেন! ১৯৯৩ সালে সেরা পাঁচজন উইজডেন বর্ষসেরা পুরষ্কার পাওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যালেক। নব্বইয়ের দশকে সবচেয়ে বেশি টেস্ট রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি!

তার জন্ম তারিখ নিয়েও একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে! তার জন্ম তারিখ ৮-৪-৬৩ যা পাশাপাশি রাখলে দাঁড়ায় ৮৪৬৩। অ্যালেকের টেস্ট রান সংখ্যাও কিন্তু ৮৪৬৩! কি এক অদ্ভুতুরে ব্যাপার!

সারের হয়ে তিনি প্রায় ৯ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। আন্তর্জাতিকে ১৩৩ টেস্টের পাশাপাশি খেলেছেন ১৭০টি ওয়ানডে! টেস্টে ৮৪৬৩ রানের পাশাপাশি ওয়ানডেতে করেছেন ৪৬৭৭ রান। ১৯৯২ সালের ফাইনালে ইমরান খানের পাকিস্তানের কাছে না হারলে তার নামের পাশেও একটি বিশ্বকাপ থাকতো! তবে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ইংলিশদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অ্যালেক।

শুধু ব্যাটসম্যানই নয়; আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উইকেটরক্ষক হিসেবেও অ্যালেক ছিলে দুর্দান্ত। ইতিহাসের সেরা উইকেটরক্ষকদের তালিকা করলে নাম থাকবে তার। ৪২২ ক্যাচ আর ২৯ স্ট্যাম্পিং করেছেন পুরো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে! যাকে বলা হয় ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।

ক্রিকেটার হবেন শুনে হাসি দেওয়া বাবাও একসময় গর্বে বুক ফুলিয়েছিলেন যখন ছেলে ইংল্যান্ডের হয়ে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করছিল। বাবা নিজের নামের পাশে বড় অর্জন না রাখতে পারলেও ছেলে ঠিকই রেখে গেছেন। আর বাবা-ছেলের এই জুটি আজীবন সারে ক্রিকেট ক্লাবে রয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের একজন হয়তো হতে পারেননি কিন্তু ইংল্যান্ডের ইতিহাসে মনে রাখার মতো অবদান রেখে গেছেন অ্যালেক জেমস স্টুয়ার্ট!

ক্যারিয়ার তিনি শেষ করেছেন ১৩৩ টি টেস্ট খেলে, ইংল্যান্ডের জন্য এটা রেকর্ড। কে ভেবেছিল – ২৭ বছর বয়সে অভিষিক্ত কেউ একজন এই রেকর্ড ছুঁতে পারবেন। আবার তাঁর আক্ষেপও কম না। অনেকেই মনে করেন, উইকেটরক্ষণের চাপ না নিলে ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর রেকর্ড আরো সমৃদ্ধ হত। বিশুদ্ধ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন একাদশে ছিলেন, তখন তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৪৬। আর উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে ৩৫! বোঝাই যাচ্ছে – পার্থক্যটা নেহায়েত কম নয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...