শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে একটা গদ গদ ভক্তি আমাদের দেশ তো বটেই, সারা বিশ্বেই আছে।
ওদের শিক্ষিতের হার খুব বেশি, ওদের ক্রিকেটাররা পণ্ডিত হয়, ওরা খুব ভদ্রলোক; এরকম সব প্রচারণা আছে। কিন্তু দূর্ভাগ্য কী জানেন, আমার এই নাতিদীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে এই দেশের ক্রিকেটীয় কর্মকাণ্ডে এরকম ভণ্ডামিই বেশি দেখেছি। ফলে তারা এই যে বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডকে নিয়ে ডাবল স্টান্ডার্ড দেখালো, এটা আমার কাছে নতুন মনে হয়নি। বরং আমার মনে হয়েছে, এটাই তাদের আসল রূপ।
আগে ঘটনাটা একটু খুলে বলা যাক।
কয়েক দফা পেছানোর পর গত সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়ার কথা ছিলো বাংলাদেশ দলের। শুরুতে কথা ছিলো। বাংলাদেশ জাতীয় দল ও হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) দল একই সাথে ভাড়া করা বিমানে কলম্বো যাবে। বাংলাদেশে এই কোচ খেলোয়াড়রা জৈব বলয়ের মধ্যে ছিলো পাঁচ তারকা হোটেলে।
কথা ছিলো বাংলাদেশের এই দুটি দলের খেলোয়াড়রা ও কোচরা কলম্বোতে গিয়ে কোনো একটা হোটেলে জৈব বলয়ে কোয়ারেন্টিন করবে। কোয়ারেন্টিনের সময় তারা অনুশীলন করবে এবং এইচপি দলের সাথে ভাগাভাগি করে অনুশীলন ম্যাচ খেলবে। এরপর স্থানীয় ক্রিকেটারদের সাথে একটা অনুশীলন ম্যাচ হবে কোয়ারেন্টিন শেষে। আর তারপর টেস্ট।
কিন্তু সফরের সময় যতো এগিয়ে আসতে থাকলো, শ্রীলঙ্কান বোর্ড ততোই বাঁকা আচরণ শুরু করলো। তারা বাংলাদেশকে ‘কোভিড টাস্কফোর্স’ নামে এক হাইকোর্ট দেখানো শুরু করলো।
প্রথম কথাই হলো, বাংলাদেশ দলকে তারা কলম্বোতে রাখবে না; রাখবে দেশের এক প্রান্তে হাম্বানটোটা নামে প্রায় এক জঙ্গলরাজ্যে; ভালো। এরপর বলা হলো, বাংলাদেশ দলকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন করতে হবে; এটাও ভালো। এরপর বলা হলো; কোয়ারেন্টাইনের সময় নিজেদের মধ্যে অনুশীলন ম্যাচ খেলা তো দূর, অনুশীলনও করা যাবে না; আরও ভালো। এর দু চার দিন পর তারা বললো, এইচপি দলকে সাথে নেওয়া যাবে না!
বোঝেন অবস্থা।
বাংলাদেশ বোর্ড বেকায়দায় পড়ে বললো, ভাই অন্তত অনুশীলনের ব্যবস্থা করো। তা না হলে আমরা মাঠে নামবো কী করে? তারা বলে, তারা নেট বোলার দিতে পারবে না। বিসিবি বললো, তাহলে আমরা বহরটা একটু বড় করে বাড়তি কিছু বোলার নিয়ে যাই? আজ্ঞে না। তাও হবে না।
মানে, অনুশীলন করতে পারবা না, থাকবা একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে, নেট বোলার পাবা না, বাড়তি লোক নেওয়া যাবে না। ধরে পেটানো বাকী থাকে আর কী!
বিসিবি এই সময় খুব ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিলো। বোর্ড সভাপতি দৃঢ়ভাবে বলে দিলেন, এসব অদ্ভুত শর্ত মেনে সফর করা সম্ভব না। এই কথায় একটু দৌড়ঝাপ শুরু করলো শ্রীলঙ্কান বোর্ড। তারা কোভিড টাস্কফোর্সের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করে বললো, টাস্কফোর্স নমনীয় হচ্ছে না।
ফলত, সফর বাতিল হলো।
আমরা শ্রীলঙ্কাকে বাহবা দিলাম। খুব প্রশংসা করলাম। বাহ, এই না হলে দেশ! নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে কোনো আপোষ নেই। আমরা আবার গদগদ হয়ে পড়লাম। কিন্তু ভেজাল হলো আজকের খবর।
আজকের খবর হলো, ইংল্যান্ড দল শ্রীলঙ্কা সফরে আসছে।
খুব ভালো কথা। কিন্তু বিস্তারিত জানতে গিয়ে জানা গেলো, এবার আর শ্রীলঙ্কার সেই তেজ নেই। ইংল্যান্ডকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন করতে হবে না। নামকা ওয়াস্তে যেটুকু কোয়ারেন্টাইন তারা কলম্বোতে করবে, সে সময় তারা অনুশীলন করতে পারবে। আর অনুশীলনে সব সাপোর্ট দেবে লঙ্কানরা।
তা ভাই, শ্রীলঙ্কার আপোষহীন ভাবমূর্তির কী হলো? কোথায় গেলো তাদের টাস্কফোর্সের কঠোরতা?
যত জোর দুর্বলের সাথে। যত আইন পাশের বাড়ির লোকটার সাথে। যেই না ইউরোপ থেকে কল এসেছে, সব আইন উবে গেছে। সব আপোষহীনতা আপোষকামিতায় পরিণত হয়েছে।
আমি আবারও বলি, এটাই শ্রীলঙ্কার আসল রূপ।
হোস্ট হিসেবে শ্রীলঙ্কা কতো নিচে নামতে পারে, তার প্রমান এই বাংলাদেশ আগেও পেয়েছে। আমার ২০১৩ সালের মার্চ মাসের কথা খুব মনে পড়ে। গলে আশরাফুলের ১৯০ আর মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরিতে ম্যাচ ড্র করে এসেছে বাংলাদেশ। সিরিজ খোয়ানোর আশঙ্কায় কাঁপছে লঙ্কানরা। সেই সময় শুরু হলো কলম্বো টেস্ট।
প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে খেলা শুরু হতে সবাই হতভম্ব-এতো বড় বড় ঘাস!
মনে হচ্ছিলো, নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার কোনো গো-চারণ ভূমিতে খেলা হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা দারুন পাওয়ার দিয়ে শট করেন, বল ঘাসে আটকে যায়। এ নিয়ে ক্রিকইনফোর ধারাভাষ্যে অনেক কথা হচ্ছিলো। তবে স্বান্তনা ছিলো, ঘাস তো শ্রীলঙ্কান ব্যাটিংয়ের সময়ও থাকবে।
জ্বি, না। তা থাকেনি।
পরদিন খেলা শুরু হতে দেখা গেলো ঘাস কয়েক ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছে; এখন স্রেফ গালিচা বেছানো। এ নিয়ে কথা কথোন্তর এতোদূর গড়ালো যে, ম্যাচ রেফারিকে কথা বলতে হলো। তিনি খুব স্বাক্ষী নিয়ে বললেন, নিয়মের চেয়ে একটু বেশী ঘাস কাটা হয়নি। সকালে নিয়ম মতো ঘাস কাটার সময় তিনি মাঠে ছিলেন।
এই স্বাক্ষী লোকেরা যে বিশ্বাস করেনি, তা এখনও ক্রিকইনফোর সেই ম্যাচের ধারাভাষ্য খুললে দেখতে পারেন। আমি অন্তত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সেই ম্যাচে গুরুতর অন্যায় করেছিলেন গ্রাউন্ডসম্যানরা।
আমার বিশ্বাস অবশ্য ব্যাপার না। আমি বাংলাদেশি মানুষ; বাংলাদেশের পক্ষেই বিশ্বাস করবো। কিন্তু আজ তো বিশ্ববাসীই শ্রীলঙ্কানদের সততা নিয়ে সন্দিহান। দেশটির ক্রিকেটের দুই আধুনিক ‘দেবদূত’ মাহেলা জয়াবর্ধনে আর কুমার সাঙ্গাকারার সততা নিয়ে তো শ্রীলঙ্কারই সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন।
এমনিতে সাঙ্গাকারা তো ক্রিকেট ভদ্রতার প্রতিমূর্তি বিশেষ। তিনি এমসিসি চেয়ারম্যান হন, কলি কাউড্রে বক্তৃতা দিয়ে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেন। কী একটা দারুন ভাবমূর্তি।
অথচ এই জয়াবর্ধনে আর সাঙ্গাকারা একটার পর একটা ফাইনালে কুদৃশ্যভাবে চোক করেছেন। সেটা ইচ্ছে করেই করেছেন, এমন বিশ্বাস করার লোকের অভাব নেই। খোদ অর্জুনা রানাতুঙ্গা মনে করেন, ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল সাঙ্গাকারা-মাহেলারা ইচ্ছে করে হেরেছিলেন। রানাতুঙ্গার কথা কেউ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু দেশটির সে সময়ের ক্রীড়ামন্ত্রী যখন এ বছর অভিযোগটা আবার করলেন, তখন লঙ্কান সরকার লোক দেখানোর জন্য হলেও একটা তদন্ত করলো।
সে তদন্ত কেমন হলো?
আমিই বিচারক, আমিই আসামী, আমিই স্বাক্ষী এবং সব খালাস!
সাঙ্গাকারা, মাহেলা সহ কয়েক জন শ্রীলঙ্কানের স্বাক্ষী নেওয়া হলো এবং বলা হলো তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন। তাই তারা নির্দোষ! খুব বিচার হলো!
আমি কোনো সন্দেহ করছি না। কিন্তু রানাতুঙ্গা বা একজন ক্রীড়ামন্ত্রী যখন সন্দেহ করেন, সেটা অবশ্যই এর চেয়ে স্বচ্ছ ও ব্যাপক বিচার দাবি করে। কিন্তু দাবিটা কে শুনবে?
যেচে কে আর মুখোশটা খুলতে চায়!