কেনিয়ার ‘বিপ্লবী’ নেতা

সাল ২০০২। ১৬ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। অবসরে চলে যাওয়া আসিফ করিম তখন নামাজ পড়ছিলেন। হঠাৎই বেজে উঠল ফোন। তিনি ফোন রিসিভ করেননি, করেছিল তাঁর মেয়ে। ফোনের অপর প্রান্তে আরেক আসিফ, আসিফ পাপামশি, যার মূল পরিচয় কেনিয়ান ক্রিকেটের নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান।

চার বছর আগের এমনই এক ফোন কলের দুই প্রান্তে ছিলেন এই দুই আসিফ। নির্বাচক কমিটির প্রধান আসিফ পাপামশি ফোন দিয়ে আসিফ করিমকে অবসরের ব্যাপারে ভাবার পরামর্শ দিলেন।

ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি আসিফ করিমের। নির্বাচকেরা তো এমন ‘ভদ্রভাবেই’ খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দেন, তোমাকে আর জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করা হবে না! সেদিনের পর আর কথা হয়নি দুজনের।

আম্পায়ার যখন ফ্যান: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই স্পেলের পর স্বয়ং স্টিভ বাকনার এসে হাত মেলান আসিফের সাথে।

চার বছর পরে, আরেকটা ফোন কলে উপস্থিত এই দুই চরিত্র। অথচ কথোপকথনের বিষয় কতটা ভিন্ন! এবার ফোনকল দিয়ে পাপামশি আসিফ করিমকে অনুরোধ করছেন ২০০৩ বিশ্বকাপে কেনিয়ার হয়ে খেলার জন্য!

আসিফ করিম অনুরোধ রেখে খেলেছিলেন, এবং নিজের সেরা খেলাটাই খেলেছিলেন। ৩৯ বছর বয়সী এই ইনস্যুরেন্স দালালের হাত ধরেই কেনিয়া উঠেছিল ২০০৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। গল্পটাকে চাইলে ১৯৯০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের রজার মিলারের সাথেও মিলিয়ে ফেলা যায়।

সুপার সিক্সে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন, তখনকার প্রবল পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আসিফ যা করেছিলেন, এককথায় অনবদ্যই বলতে হবে। ৮ ওভার বোলিংয়ের পর আসিফের ফিগার ছিল ৬ মেইডেন, ২ রান ও ৩ উইকেট! আসিফ সেদিন যা করেছিলেন, সেটা বিশ্বের শীর্ষ দলগুলোও করতে পারেনি ওই বিশ্বকাপে।

শৈশবে-তারুণ্যে সব খেলাতেই আসিফ ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। বাবা ইউসুফ করিম (নিচে) তাঁর অনুপ্রেরণা।

শুধু বিশ্বকাপে কেন, অজি প্রতাপের সেই যুগেই এমনটা খুব কম দেখা গেছে। আসিফ যে সেদিন রীতিমত লজ্জায় ডুবিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে!

আসিফের ক্যারিয়ারের ২৩ তম বছর চলছিল সেটা। কিন্তু সত্যি বলতে সেদিনের আগে আসিফ যে ক্রিকেট খেলেন এটাই হয়তো বেশিরভাগ ক্রিকেটপ্রেমী লক্ষ্য করেননি।

সেই বিশ্বকাপের আগে আসিফের দেশ কেনিয়াকেও হয়তো সেভাবে কেউ খেয়ালই করেনি। নিজ দেশকে ২৩ বছর ধরে নীরবে সেবা দিয়ে যাওয়া এক ক্রিকেটার সেদিন পেয়েছিলেন নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা। সেই দিনটা ছিল শুধুই আসিফের দিন, আসিফের দলের দিন। প্রকৃত ক্রিকেটপ্রেমীরা হয়তো সেদিন আসিফের বোলিংয়ের কথা কখনোই ভুলতে পারবেন না।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। ১৯৯৫ সালে এক সাথে তিন সতীর্থ আসিফ, টিটো ওদুম্বে (মাঝে) ও তারিক ইকবাল।

আসিফের ক্যারিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম স্মরণীয় ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম বলেই ডানকান ফ্লেচারের উইকেট নিয়ে শুরু করেছিলেন, ক্যারিয়ারে এরপর পেয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, মাইক আথারটন, শোয়েব মোহাম্মদ, দিলীপ ভেংসরকার, রিকি পন্টিংয়ের মত ব্যাটসম্যানদের উইকেট।

কেনিয়ার হয়ে সর্বশেষ যে বলটি খেলেছিলেন তার বোলার কে ছিল জানেন? শচীন টেন্ডুলকার। আসিফের ক্যারিয়ারের বর্ণময় চরিত্র এখানেই শেষ না। জুনিয়র ফ্রেঞ্চ ওপেন খেলেছেন, আমেরিকার একটি কলেজে টেনিসের উপর স্কলারশিপ নিয়েছেন, ডেভিস কাপ টেনিস খেলেছেন, নাইজেরিয়ান প্রেসিডেন্টস কাপে কেনিয়ার অধিনায়কত্বও করেছেন!

আসিফের এই গল্প শুরু হয়েছিল তাঁর বাবা ইউসুফ করিমের হাত ধরে, যা এখনো বয়ে নিয়ে চলেছেন আসিফের ছেলে ইরফান। ইউসুফ করিম ১৬ বছর ধরে কেনিয়ার দ্বিতীয় প্রধান শহর মোম্বাসায় অভিবাসী হয়ে বাস করছিলেন।

১৯৮১ সালের জিম্বাবুয়ে সফর। বোলিং প্রান্তে মাত্র ১৭ বছর বয়সী আসিফ করিম।

টানা ২৫ বছর ধরে ইউসুফ করিম মোম্বাসা রেসিডেন্টস সিঙ্গেল চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন। ব্যাট হাতে ইউসুফ করিম এতটাই ভালো ছিলেন যে তাঁকে কাউন্টি ক্রিকেটে খেলার অফারও দেয়া হয়েছিল।

আসিফের ছেলে ইরফান এখন কেনিয়া জাতীয় দলের সদস্য। ৯ টি ওয়ানডেতে এরই মধ্যে দুই সেঞ্চুরি সহ ৪৪ গড়ে রান করেছেন ইরফান। ১৬ টি-টোয়েন্টিতে আছে দুটি হাফ সেঞ্চুরিও। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটাই যে খেলেছেন সেই ২০১৪ সালে। নামতে নামতে কেনিয়ার ক্রিকেট এতটাই নিচে নেমেছে যে, এখন আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ আসে না বললেই চলে।

কেনিয়ার ক্রিকেটের এই অতল গহবরে হারিয়ে যাওয়াও অবশ্য পরিবারটির গৌরব এক বিন্দুও কমাতে পারেনি। এই পরিবারটিকে নিয়ে বানানো হয়েছে ‘দ্য করিম’স: অ্যা স্পোর্টিং ডাইন্যাস্টি’ নামের একটি তথ্যচিত্র। আসিফ করিম নিজেই সেটির অর্থায়ন করেছেন। তথ্যচিত্রটির ট্যাগলাইন দেয়া হয়েছে ‘থ্রি জেনারেশনস, টু স্পোর্টস, ওয়ান ফ্যামিলি।

ছেলে ইরফান করিমের সাথে আসিফ

কেনিয়া তাদের খেলার হিরোদের কখনোই মনে রাখেনি। কেনিয়ায় কোন ক্রীড়া জাদুঘর নেই, নেই কোন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও। কেনিয়ায় অনেক হিরো আছে, কিন্তু কেউ তাদের মনে রাখে না। আসিফ করিম ভয় পান, আরও অনেক কিংবদন্তির মত তাঁর পরিবারের দারুণ সব অর্জনও লোকজন একদিন ভুলে যাবেন।

অ্যালেক্স গিবনির মানের তথ্যচিত্র দেখে থাকলে এই তথ্যচিত্রটিকে আপনার কোন দিক থেকেই পরিপূর্ণ মনে হবে না। বিশেষ করে প্রোডাকশন ভ্যালুর অভাবটা খুব বেশি করে আপনার চোখে পরবে। কিন্তু যেই আবেগ নিয়ে তথ্যচিত্রটি বানানো হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই আপনাকে স্পর্শ করে যাবে। এটি শুধুই একটি পরিবারের গল্প নয়, পুরো কেনিয়ার সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবিই যেন এই তথ্যচিত্রটি।

আসিফ বিশ্বাস করেন, খেলা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। তিনি চান তাঁর গল্প যেন বাকিদেরও অনুপ্রাণিত করে। সীমিত সামর্থ্য নিয়েও তাই তিনি তথ্যচিত্রে সাবটাইটেলের ব্যবস্থা করেছেন। কেনিয়ার মানুষের জীবন বদলে দেয়ার লক্ষ্যে কেনিয়ায় চালু করেছেন সাফিনাজ ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন।

মাঠ এবং মাঠের বাইরে দুই জায়গাতেই করিমদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। খেলা থেকে যে তারা খুব বেশি অর্থ উপার্জন করতে পেরেছেন সেটা কিন্তু না, কিন্তু তারপরেও তারা তাদের সমস্ত জীবন খেলাকেই উৎসর্গ করেছেন। কারণ তারা খেলাকে ভালোবাসেন।

কেনিয়ার ক্রিকেটের হঠাৎ এই অধ:পতনের কারণ কি? সেটাও আবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়ার পর? উত্তর শুনুন খোদ আসিফ করিমের মুখেই, ‘কোনো কাঠামো না থাকলে টিকোলো-ওদুম্বেদের দিয়ে মত খেলোয়াড়রা আসবে কোথা থেকে? ওদের তো আর রাস্তায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাল কোনো কাঠামো ছাড়া নিয়মিত ভাল খেলোয়াড় তৈরি করা মুশকিল।’

এখান থেকেও কি স্বপ্ন দেখার কোনো উপায় আছে? উত্তরে আসিফ বললেন, ‘কেনিয়ার ক্রিকেট মরে গেছে, দাফন হয়ে গেছে, শেষকৃত্যও হয়ে গেছে। উদ্দেশ্য যতই ভাল হোক, যোগ্যতা না থাকলে এই পর্যায়ে টেকা মুশকিল। এক যুগের বেশি সময় ধরে আমাদের কোনো প্রশাসনিক কাঠামো নেই বললেই চলে। ফলাফলটাতে বিষয়টা পরিস্কার। ক্রিকেট এখন কোথায় আছে কেনিয়ায়? কোথাও নেই।’

এই উত্তরটা শুনে যেকোনো ক্রিকেট ভক্তের হৃদয়ই হয়তো ভেঙে যাবে, তাহলে একবার ভাবুন তো আসিফ করিম কিংবা স্টিভ টিকোলোদের এসব বলতে কেমন লাগে!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link