ভারত-পাকিস্তান খেলার মাঠ হোক কিংবা রাজনীতির টেবিল এই দুই দেশের স্নায়ুযুদ্ধ আর মাঠে খেলার যুদ্ধ, দুইটি যুদ্ধই বেশ একটা উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে পুরো বিশ্বজুড়ে। আর ক্রিকেট মাঠে এই দুই দলের লড়াই বর্তমানে অমাবস্যার চাঁদ।
কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির খেসারত দিতে হচ্ছে ক্রিকেট উন্মাদ ভক্ত সমর্থকদেরকে। তবে শুরু থেকেই তো এমন অবস্থা ছিল না। নব্বই দশকে হর-হামেশাই মুখোমুখি হতো এই দুই দল।
তাঁদেরকে ঘিরে কতশত আয়োজন হতো। ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সিরিজ সেই সময় যেন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক একটি ব্যাপার। বছরে কম করে হলেও অন্তত দু’বার মুখোমুখি হতো তাঁরা। এমনই এক ধারাবাহিক টুর্নামেন্ট ছিল সাহারা ফ্রেন্ডশিপ কাপ। ১৯৯৬ থেকে শুরু করে ১৯৯৮ অবধি টানা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই দুই দলের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজ। কিন্তু মজার বিষয় সেই টুর্নামেন্টটা হতো নিরপেক্ষ ভেন্যুতে।
নব্বই দশক থেকেই যারা নিয়মিত ক্রিকেটে নজর রেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই সাহারা ফ্রেন্ডশিপ কাপটা অনুষ্ঠিত হতো কানাডায়। খানিকটা উদ্ভট একটা ভেন্যু। কেননা কানাডার ক্রিকেট কাঠামো তখনও খুব একটা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা লাভ করেনি। তাতে অবশ্য টুর্নামেন্টে দর্শকের অভাব হয়নি। মাঠ ভর্তি দর্শক থাকতো টুর্নামেন্টের শুরু থেকে একেবারে শেষ অবধি।
প্রথমবার আয়োজিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সে বার ভারতকে রীতিমত উড়িয়ে দিয়ে শিরোপা নিজেদের ঘরে তুলেছিল পাকিস্তান। সেই মহাদ্বৈরথে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই জিতেছিল পাকিস্তান। অথচ টুর্নামেন্টের শুরুর ম্যাচটা আট উইকেটে জিতেছিল ভারত। তার পরের ম্যাচগুলোতে পাকিস্তান জিতেছিল যথাক্রমে দুই উইকেট, ৫৫ রান, ৯৭ রান এবং ৫২ রানের ব্যবধানে।
প্রথম আসরে মূলত পাকিস্তানি বোলারদের নৈপুণ্যেই অধিকাংশ ম্যাচ জিতেছিল তাঁরা। যদিও উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকায় সবার উপরে ছিলেন অনিল কুম্বলে। নিয়েছিলেন ১৩টি উইকেট। রান খরচাতেও তিনি বেশ কৃপণ ছিলেন।
তাঁর পরেই ছিলেন আরেক কিংবদন্তি স্পিনার পাকিস্তানের সাকলাইন মুশতাক। তাঁর ঝুলিতে ছিল নয়টি উইকেট। তবে ভারতীয় বোলাররা খুব একটা সঙ্গ দিতে পারেননি কুম্বলেকে। অপরদিকে, বল হাতে পাকিস্তানের সবাই নিজেদের সেরাটা দেওয়ারই চেষ্টা করেছিলেন।
মাত্র চার ইনিংসে দুইশো রানের কোটা পার করতে পেরেছিল দুই দল। অধিকাংশ সময়েই পিচটা কেন জানি বোলারদের পক্ষেই ছিল। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ছিল না কোন শতক। একটি অর্ধ-শতকের সুবাদে রান সংগ্রাহকদের তালিকায় সবার উপরে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়।
৪৪ গড়ে করেছিলেন ২২০ রান তিনি। তাঁর পরের অবস্থানে ২০৩ রান নিয়ে ছিলেন সাঈদ আনোয়ার। নিরপেক্ষ ভেন্যুতে টুর্নামেন্ট হলেও দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আয়োজক কমিটি পরবর্তী দুইটি আসর আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে খেলা ছাড়াও মাঠের বাইরের নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছিল এই সাহারা ফ্রেন্ডশিপ কাপ। পাকিস্তানের কিংবদন্তি ব্যাটার ইনজামাম উল হক ব্যাট হাতে মারতে চলে গিয়েছিলেন দর্শক গ্যালারীতে। যার জন্য তাঁকে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
সেই দর্শক নাকি তাঁকে মোটা আলু বলে সম্বোধন করা ছাড়াও ভারতীয় ব্যাটার মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের স্ত্রী-কে নিয়ে করেছিলেন বাজে মন্তব্য। খেলা ছাড়াও সেই সাহারা কাপ বেশ উত্তেজনা ছড়িয়েছিল মাঠের বাইরেও।
তবুও দুইটি বছর নির্বিঘ্নে চললো এই টুর্নামেন্ট। প্রথম আসরের লজ্জাজনক হারের প্রতিশোধ নিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া ১৯৯৭ এর আয়োজনে। সে বার তাঁরা ৪-১ ব্যবধানে জিতেছিল ছয় ম্যাচের টুর্নামেন্ট। সেই আসরে সৌরভ গাঙ্গুলি ছড়িয়েছেন পারফর্মেন্সের সৌরভ।
নিখাদ অলরাউন্ডার সৌরভ রান সংগ্রাহক এবং উইকেট শিকারির দুই ভিন্ন তালিকায় ছিলেন সবার উপরে। সেবার আসলে ভারতীয় খেলোয়াড়দের দাপটের ফলশ্রুতিতে পাত্তাই পায়নি পাকিস্তান।
ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্পন্সর কোম্পানি সাহারা আবারও ১৯৯৮ সালে আয়োজন করে এই টুর্নামেন্টের। দল, ভ্যেনু ছিল অপরিবর্তিত। তবে টুর্নামেন্টের বিজেতা আবারও হয় পরিবর্তন। প্রথম আসরের ন্যায় তৃতীয় আসরেও ছিল পাকিস্তানের জয়জয়কার। আবারও ফলাফল ৪-১, পাকিস্তানের পক্ষে।
পাকিস্তানি ব্যাটারদের দারুণ পারফর্মেন্সের ভিড়ে ভারত দলের পেস বোলার জাভাগাল শ্রীনাথ বনে যান ৯৮ আসরের সেরা উইকেট শিকারি। নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। অন্যদিকে, সেরা রান সংগ্রাহক ইনজামাম উল হক। ২১৪ রান করেছিলেন দুইটি হাফ-সেঞ্চুরির বদৌলতে।
তবে এসব সংখ্যার বিচারে আসলে সেই আমেজকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এখন যখন আর ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয় না সচরাচর তখন দর্শক সমর্থকরা সেই সুদিন গুলোর অপেক্ষা করে।
যখন পুরো উপমহাদেশে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করতো। গোলাবারুদের যুদ্ধের জন্য নয়। ব্যাট আর বলের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কতশত তর্ক-বিতর্ক হতো। সেসব এখন সব অতীত।
১৯৯৯ সালে এই দুই দেশের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই গোলাবারুদের যুদ্ধ লেগে যায়। আর বন্ধ হয়ে যায় সাহারা কাপ। ক্রিকেটে এই দুই দলের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক ক্রমশ বিরূপ হতে থাকে বলে আর এমন মাঠের উত্তেজনা ছড়ায় না। নতুন গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টগুলোর।