দ্য সেলফিশ জায়ান্ট

১৯৬১-৬২ সাল। সেবার এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য নরি কন্ট্রাক্টরের নেতৃত্বে বার্বাডোজে পাড়ি জমাল ভারতীয় দল। ক্লাইভ-ভিভ-রিচার্ডসন জমানা আসেনি তখনো। ক্যারিবিয়ানদের অধিনায়ক তখন ফ্রাঙ্ক ওরেল, একুশ শতকেও যাকে বলা হয় ক্যারিবিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ রাজপুত্র।

ওরেলের দলের খুনে বোলার গ্রিফিথের বাউন্সার সম্পর্কে ওরেলের মন্তব্য ছিল, ‘প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা আমাকে নিজেদের উইকেট উপহার দেবে, কারণ দেশ বাঁচানোর চেয়ে জীবন বাঁচানো জরুরী।’

১৪০-১৫০ কিমি প্রতি ঘন্টার ওরেলের খুনে বাউন্সারের খেসারত দ্বিতীয় টেস্টেই দিলেন ভারতের অধিনায়ক নরি। সে সময় পিচের ঘাস ছাঁটার রীতি ছিল না। বার্বাডোজে গ্রিফিথের বাউন্সার গ্রিণ টপে আছাড় খেয়ে সপাটে লাগল নরির মাথায়। নন স্ট্রাইকারে দাঁড়িয়ে রুশি সূর্তি দেখলেন কান আর নাক দিয়ে ছিটকে রক্ত বেরিয়ে এল নরির।

হাসপাতালে রক্তের প্রয়োজন। একে একে রক্ত দিলেন ভারতীয় দলের পলি উমরিগর, চাদু বর্দেরা। সকলকে অবাক করে দিয়ে ম্যাচের পর হাসপাতালে হাজির দৈত্যাকার ফ্রাঙ্ক ওরেল। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘আমিও নিজের রক্ত দিতে চাই নরি ভাইকে।’

প্রায় ৫৫ বছর পর সপাটে ছক্কাটা যখন বাচ্চাটার নাকে লেগে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল তখন ক্রিজ ছেড়ে বেরতে না পারার যন্ত্রনা হয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আধুনিক ক্রিকেটের দৈত্যকে। ম্যাচের পর সেলিব্রেশনে কোত্থাও নেই তিনি, উদ্দাম নৈশপার্টিতে ক্রিস গেইল নেই?

ব্যাঙ্গালুরু ড্রেসিংরুম ধরেই নিয়েছিল হয়ত নিজের পছন্দের পার্টিতে গিয়ে দেদার মদ্যপান করছেন ক্রিস গেইল। কিন্তু তিনি তো সেই ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের উত্তরাধিকার। যে ছুঁটে গিয়েছিল ছোট্ট শিশুটির কাছে- পাহাড়ের বুকে যেমন কুলকুল করে বয়ে যায় নদী- ক্যারিবিয়ান লিগ্যাসির দৈত্যদের আগ্রাসন আর উদ্দামতার ভেতর থাকে একটা শিশুর মতো মন- ওরেল থেকে ভিভ, লয়েড থেকে গেইল সেই ট্র্যাডিশন চলল- পরদিন সকলকে চমকে দিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন মিস্টার ইউনিভার্সাল বস। 

ভিভের লিগ্যাসি কিংবা লারার প্রতিভার ধারেকাছেও নেই লোকটা। আধুনিক ক্রিকেটে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতম হয়ে উঠলেও ভারতে একজন বীরেন্দ্র শেবাগ ছিলেন যিনি স্থায়িত্ব আর দায়বদ্ধতায় টেস্ট রেনেসাঁসের নায়ক- গেইল কখনোই নন। কিন্তু গেইল কে? গেইল একা হাতে ক্যারিবিয়ান দলকে দায়িত্ব নিয়ে ক’টা ম্যাচই বা জেতালেন? তবু বার্বাডোজ কেন ভেঙে পড়ে এই স্বার্থপর মানুষটার বিদায়ে? আজও?

৩৩৩ রান। স্কোরবোর্ড নেমে যাবে। টি-টোয়েন্টিতে ১৭৫। মাইলস্টোন অজেয় নয়। টেস্টে লারাকে টপকালেন না মুকুটের উচ্চতায়। তবু গেইল অধ্যায় অস্কার ওয়াইল্ডের সেই সেলফিশ জায়েন্টের গল্প যা থেকে যাবে রূপকথায়। ওরেল থেকে ওয়েসলি হল, জর্জ রক থেকে কোর্টনি ওয়ালশ,অলভিন কালিচরন থেকে ম্যালকম মার্শাল আর ভিভ থেকে গেইল- ক্যারিবিয়ান আভিজাত্যের শেষ মাইলস্টোন হয়ে থেকে গেলেন ক্রিস গেইল।

সেই উদ্ধত ভঙ্গী, সেই ষাট থেকে আশির দশকের ক্যারিবিয়ান দাদাগিরি আর ক্ষয়িষ্ণু ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে ভিভ-লয়েডের শেষ প্রতিনিধি হয়ে ইতিহাস হয়ে গেলেন ক্রিস গেইল। স্যার ভিভ বলতেন ব্যাট হাতে নামলে আমি-ই সেরা, তাই আউট হয়ে গেলে মরা ক্রিজের দিকে ফিরে তাকাতে নেই। সেই ক্রিজের দিকে আর ফিরে তাকালেন না গেইল যে ক্রিজে একদিন তাঁর সামনে অসহায় হয়ে যেত সমস্ত বোলার।

উইকেটের মায়া করে ব্যাটিং কপিবুকের মিথ ভেঙে ভিভ যে পথ দেখিয়েছিলেন তাঁর তরী কূলে ভিড়িয়ে দিয়ে সরে গেলেন ভিভ। টর্ণেডো-হ্যারিকেনের সাথে জুড়ে থাকল গেইল ঝড়। দানবিক ঔদ্ধত্যের মাঝে ভিভ মাঝে মাঝে রাতে সমুদ্রের পাড়ে বসে কাঁদতেন, ম্যাচ জেতার দিন সন্ধ্যায় আন্টিগার রাস্তায় একা একা বসে থাকতেন লয়েড- ক্যারিবিয়ান সম্রাটদের বর্ণময় জীবন।তোয়াক্কা করেনি সমাজ আর মাঠের বাউন্ডারিকে।

তাই তো, গেইল সাম্রাজ্যের সাজানো বাগানে উদ্দামতা আর উচ্ছৃঙ্খলতার বেড়ার ভেতর বেঁচে ছিল এক ফালি সবুজ, সেই সেলফিশ জায়েন্টের বাগানে যীশু আসতেন বসন্ত নিয়ে, ক্যারিবিয়ান সাগরের ঢেউ দোলা দিত বিশ্বের বাইশ গজে – অভিমানী দৈত্যের বাগান থেকে ক্রিকেটের গল্পে অস্কার ওয়াইল্ড হলেন ক্রিকেট ঈশ্বর। যীশুর অনন্ত বাগানে হারিয়ে যেতেই গেইল চলে গেলেন বাইশ গজ ছেড়ে, হয়ত বাইশ গজে একলা পড়ে রইল ওরেল থেকে গেইল হয়ে অবিরাম বয়ে চলা ক্যারিবিয়ান ঐতিহ্যের ভারী ব্যাটনটা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link