দিনের প্রথম কিরণ জাগায় আশার আলো। তেমনই এক আশার আলোর কিরণ ছড়িয়েছিলেন চান্দিকা হাতুরুসিংহে। উজ্জ্বল এক তারকা ক্রিকেটার হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে পা রেখেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে। খেলেছেনও দিন কতক।
তবুও এক হতাশা হয়ে রইলেন খেলোয়াড় হাতুরুসিংহে, সেটা তিনি কোচ হিসেবে যেমনই খ্যাতি পান না কেন পরবর্তীকালে। উপুল চান্দিকা হাতুরুসিংহে ১৯৬৮ সালে জন্মেছিলেন শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে। সেখানে উপমহাদেশের আর চারটা শিশুর মতোই পাড়ার গলিতে কিংবা বাড়ির ধারের মাঠে ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয়েছিল তার।
ছোট বেলা থেকেই হয়ত স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের। সেই লক্ষ্যে নিজেকে বানিয়েছেন একজন অলরাউন্ডার।প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি পা রাখেন ১৯৮৮/৮৯ সালে। বছর তিনেক ঘরোয়া ক্রিকেটে পদাচারণ শেষে সেই সূবর্ণ সুযোগ আসে তাঁর।
ডাক পান জাতীয় টেস্ট দলে। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা খেলতে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ডে। সেখানে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেক হয় হাথুরুসিংহের। তিনি অবশ্য দলে সুযোগ পেয়েছিলেন রোশান মহানামার অবর্তমানে।
হ্যামিলটনে হওয়া সেই টেস্টের আগেই ইনজুরির কবলে পড়েন মহানামা। হাতুরুসিংহে এলেন ইনিংসের সূচনা করতে। সঙ্গে ছিলেন চারিথ সেনানায়েকে। তবে প্রথম ইনিংসে আশার আলোটা দেখা গেল না। মাত্র ৪৫ বল খেলেই তিনি আউট হয়ে যান ২৩ রান করে।
২৩ বছর বয়সে অভিষেক হওয়ার স্মৃতি রাখতেই হয়ত এমন কান্ড! সে যাই হোক, দ্বিতীয় ইনিংসেই নিজের আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে যান। এইতো তবে শুরু আলোর বিকিরণের। তবে সেই আলো ম্যাচ ড্র অবধিই নিয়ে যায়।
অভিষেক ম্যাচেই দারুণ পারফর্ম করা হাতুরুসিংহে পরের ম্যাচেও সুযোগ পেয়ে যান। যদিও মহানামা তখনও ইনজুরি কবলিত। সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে তাঁর ব্যাট থেকে এলো ১৩ রান। দ্বিতীয় ইনিংসেই আবার একটি অর্ধ-শতক। নিজেকে জাতীয় দলে থিতু করার পথটা যেন ধীরে ধীরে সুগম করছেন।
সে বছর আরো একটি ম্যাচ খেলেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। সে ম্যাচেই তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উইকেটের দেখা পান। তাঁর প্রথম উইকেট ছিলেন মার্ক রামপ্রকাশ। সে ম্যাচেও প্রথম ইনিংসে তিনি অর্ধ-শতক করেন।
তাঁর করা ২০১ বলে ৬৬ রান লঙ্কানদের রান সংগ্রহে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। যদিও পরের ইনিংসে মাত্র ২৫ রান করতে পেরেছিলেন তিনি। যদিও ম্যাচটি ইংল্যান্ড জিতে নিয়েছিল। অভিষেকের পর টানা তিন ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি, তাও আবার বিদেশের মাটিতে।
এমন কাণ্ডের জন্য আলোচনায় চলে আসেন হাতুরুসিংহে। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য যেন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে ওয়ানডে অভিষেকও হয় তাঁর। এর আগে অবশ্য পাকিস্তান সিরিজের তিন টেস্টে হাতুরুসিংহে নামক আলোটা খানিক ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতেও তাঁর সূচনাটা ঠিক শুভ হয়নি। তবুও ১৯৯২ সালে তিনি দলের সাথেই ছিলেন। তবে, ঘরের মাঠে তিনি তাঁর বোলিং সামর্থ্যের প্রমাণ দিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সে বছর আগস্টে হওয়া টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডারে একাই ধ্বস নামান হাতুরুসিংহে।
তারপর সেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে আবারও হাতুরুসিংহের ব্যাটের ঝলক। তুলে নেন আরো একটি অর্ধ-শতক। সাফল্যের মূলমন্ত্র হয়ত খুঁজে পেলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর প্রথম ওয়ানডে অর্ধ-শতকের সাথে মোলাকাত হয়।
এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে তিনি ডাক পেলেও পারফর্ম করতে ব্যর্থ হন। তবুও ১৯৯৩ সালে ১২টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন তিনি। যেখানে তিনটি অর্ধ-শতক করেছিলেন হাতুরুসিংহে। তবে হঠাৎ করেই তিনি জাতীয় দলের নিজের জায়গা হারান।
গোটা ১৯৯৪ সালে তিনি আর সুযোগ পাননি শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করার। সুযোগ ক্ষীণ হতে থাকে সময়ের সাথে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপেও তিনি ছিলেন দলের বাইরে। অদ্ভুত কারণে তিনি দল থেকে ক্রমশ ছিটকে যেতে থাকেন।
কালেভদ্রে সুযোগ মিলতো তাঁর। তবে ১৯৯৯ সালে হওয়া এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য আবারও ডাক আসে তাঁর। সে বছরই তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। তবে অভিষেকের আলো দূরে মিলিয়ে যায় শেষ টেস্টের শূন্য রানে ঘরে ফেরায়।
২৬ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ১২৭৪ রান। উইকেট নিয়েছিলেন ১৭টি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ দলে তিনি ছিলেন তবে ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। সেখানেই তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারেরও সমাপ্তি ঘটে। ৩৫ ম্যাচ দীর্ঘ তাঁর সাদা বলের ক্যারিয়ার। ৬৬৯ রানের বিপরীতে ১৪টি উইকেট নিয়েছেন তিনি।
হাতুরুসিংহের পূর্ণ ব্যবহার করেনি শ্রীলঙ্কা অথবা নিজেকে ঠিক সেভাবে কার্যকর প্রমাণ করতে পারেননি হাতুরুসিংহে। কোন এক সমীকরণের শেষে হয়ত হাতুরুসিংহের এমন ক্যারিয়ারের ব্যাখ্যা মিলবে। তবে এমন এক অমসৃণ ক্রিকেট খেলুড়ে যাত্রার অবসান ঘটে প্রশিক্ষক হয়ে।
বেশ কিছু দেশে তিনি কোচ কিংবা পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে কোচ হিসেবে সর্বাধিক সাফল্য ধরা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাথে যুক্ত হওয়ার পর। তবে তাঁর একটা স্বৈরাচারি মনোভাব রয়েছে। যা কিনা লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড সহ্য করেনি বেশিদিন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) অবশ্য সেই বাস্তবতা মেনে নিয়েই বারবার ভরসা রাখছে এই লঙ্কানের ওপরই। সিনিয়রদের তিনি দলে রাখতে চান না, সেই সিনিয়ররাই বারবার হাতুরুসিংহেকে কোচ হিসেবে চেয়েছেন। তাই বলা যায়, যার ওপর এত ভরসা, নিশ্চয়ই সেই কোচের মধ্যে কোনো এক্স ফ্যাক্টর আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য তিনি অবশ্যই তাই দ্য স্পেশাল ওয়ান!