দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ ও মহাকাব্যিক যুগলবন্দী

একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প দু’জনের যুগলবন্দী আর বোঝাপড়ায় হয়ে ওঠে আরো বেশি সুমিষ্ট। সেই প্রেম চলে বহুকাল, হয়ে রয় উদাহরণ। ক্রিকেট মাঠেও এমন প্রেম না হোক যুগলবন্দীর দেখা মিলেছে বহুবার। ব্যাট হাতে বাইশ গজে খেলোয়াড়দের সেই বোঝাপড়া দলকে জিতিয়েছে ম্যাচ, হয়েছে গর্বের কারণ কিংবা চির-সজীব উদাহরণ।

ভিভিএস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড় – ক্রিকেট পাড়ায় এই  দু’টি নাম কেবলই নাম নয়। এক একটি ব্র্র্যান্ড। কতশত কীর্তি আর দারুণ সব পারফর্মেন্স তাঁদের পুরো সাদা পোশাকের ক্যারিয়ারকে রঙিন করেছে তাঁর যেন হিসেব কষা দায়। তাঁদের সেই পারফর্মেন্সের ঝুলি যেন শেষ হবার নয়। আর বাইশ গজে একসাথে তাঁদের যুগলবন্দী সর্বদাই হয়েছে উদাহরণ। তাঁদের ব্যাট হেসেছে, সেই সাথে হেসেছে ভারত।

এই দু’জন যখনই বড় কোন জুঁটি করেছেন তখনই ক্রিকেট দেবতা প্রসন্ন হয়ে জয়ীদের কাতারে ফেলেছেন ভারতকে। তাছাড়া ইতিহাসে দু’বার লক্ষ্মণ ও দ্রাবিড় গড়েছেন ৩০০ এর বেশি রানের জুঁটি। তাও আবার সময়ের সেরা দল, সেরা বোলারদের বিপক্ষে। দুই দফাই তাঁরা এমন সময়ে দলের হাল ধরেছেন যখন সব শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আর সেই পরিস্থিতি থেকে তাঁদের ব্যাটে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভারত। এমন কি জিতেছে ম্যাচ।

প্রথম দফা যেবার লক্ষ্মণ-দ্রাবিড় জুঁটি গড়লো ৩০০ এর বেশি রানের সেবার তো ঘরের মাঠেই করেছিল সে কাণ্ড। তাও আবার পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ওপার বাংলার কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ম্যাচ। টস জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত অতিথি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহের। ২০০১ সালে হওয়া সেই টেস্ট ম্যাচে প্রথম ইনিংস রান পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া। ৪৪৫ রানের উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড় বেয়ে চূড়ায় ওঠা তো দূরে থাক ভারত পড়ে গেলো ফলো অনে।

১৭১ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত। অগত্যা দ্বিতীয় দফা ব্যাট করার নিমন্ত্রণ আসে অতিথিদের পক্ষ থেকে। এবার যেন আর ভুলচুক করতে নারাজ ভারতের ব্যাটাররা। দেখে শুনে, ধীরে-সুস্থে ব্যাট চালাচ্ছেন। তবুও তৃতীয় দিনের শেষের খানিক আগে চতুর্থ উইকেটের পতন ঘটে। ক্রিজে ছিলেন তখন ভিভিএস লক্ষ্মণ। তাঁর রান তখন নব্বইয়ের ঘরে। তাঁর সাথে এসে যুক্ত হলেন রাহুল দ্রাবিড়। ব্যাস এর পর যা ঘটেছে তাঁর সবটুকুই ইতিহাস।

তৃতীয় দিনে ৪২ রানে পিছিয়ে ভারত। লক্ষ্মণ-দ্রাবিড় ২২ রান যোগ করতেই দিনের খেলার সমাপ্তি। পরদিন, অর্থ্যাৎ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ দিন, সারাটা দিন ব্যাট করে গেলেন দ্রাবিড় আর লক্ষ্মণ। অজি বোলাররা তো রীতিমত অতিষ্ঠ। অধিনায়ক আর টিম ম্যানেজমেন্টের হয়ত জানাই ছিল না দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ দূর্গ ভাঙ্গতে হয় কি করে। ৩৩৫ রান যোগ করেন তাঁরা দু’জনে। সেই চার উইকেটেই ভারতের স্কোরবোর্ডে রান ৫৮৯। চতুর্থ দিনের খেলারও পরিসমাপ্তি।

পরদিন তাঁরা আবার ইনিংস শুরু করলেও এগোতে পারেননি বেশি  দূর। তবুও তাঁদের সেই ৩০০ পার করা জুঁটির ভরসায় অস্ট্রেলিয়াকে ৩৮৪ রানের বিশাল টার্গেট ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয় ভারত। লক্ষ্মণ-দ্রাবিড় জুঁটির অবদান ৩৭৬ রান। দ্রাবিড়ের ১৮০ ও লক্ষ্মণের ২৮১। পঞ্চম দিনে সেই ৩৮৪ রান তুলতে আর পারেনি অস্ট্রেলিয়া। মাত্র ২১২ রানে অল আউট হয় সফরকারীরা। অস্ট্রেলিয়া টানা ১৬ ম্যাচ জয়ের রেকর্ডে সেদিন আঘাত হেনেছিল ভারত।

সেই একবার এমন কীর্তি গড়েই কিন্তু ক্ষান্ত হয়ে যেতে পারতেন লক্ষ্মণ ও দ্রাবিড়। না তাঁরা কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছে আজীবন। তাইতো সেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই আবার লিখলেন ৩০০ এর বেশি রানের প্রেম কাব্য। সে কাব্যের প্রধান চরিত্র দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং। এবার ঘটনা বছর দুই বাদে। তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার মাঠে। আবারও এক দ্বিতীয় টেস্টের, দ্বিতীয় দিন। এবার পরিস্থিতি আরও বেশি বেগতিক।

৫৫৬ রান স্বাগতিক বোর্ডে। আর ৮৪ তে নেই ভারতের চার উইকেট। দ্রাবিড়ের সাথে বাইশ গজে যুক্ত হলেন লক্ষ্মণ। সিরিজে তখনও জেতা হয়নি কোন পক্ষেরই। তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল দ্বিতীয় ম্যাচটা। আর সে ম্যাচেই এমন বাজে এক পরিস্থিতি। আবার নিজেদের যুগলবন্দীর উদাহরণের ছাপ রেখে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন রাহুল-লক্ষ্মণ। তৃতীয় দিনের শুরুটা করলেন তাঁরা ১৮০/৪ এমন একটা অংক নিয়ে।

সাবলীল আর ঝুঁকিহীন সব শটের পসরা বসিয়ে রানের চাকা সচল রাখলেন দু’জনই। এদফা আর বেশিদূর এগোতে পারেননি লক্ষ্মণ। তাঁদের ৩০৩ রানের জুঁটি ভাঙ্গে ১৪৮ রানে লক্ষ্মণ আউট হলে। তবে পরদিন শেষ ব্যাটার হিসেবে আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত রাহুল দ্রাবিড় ব্যক্তিগত রানের খাতায় যুক্ত করেছিলেন ২৩৩ রান। এই দুইজনের ব্যাটে আবার ভর করে ৫২৩ রান সংগ্রহ করে ভারত। মাত্র ৩৩ রানের লিড নিয়ে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে অস্ট্রেলিয়া।

তবে দ্রাবিড়-লক্ষ্মণদের দিনে মুখ পোড়ে অজিদের। মাত্র ১৯৬ রানেই অল আউট অস্ট্রেলিয়া। জয়ের জন্যে ভারতের লক্ষ্য গিয়ে দাঁড়ায় কেবল ২৩০ রানে। শেষদিনে চার উইকেটের জয় তুলে নেয় ভারত। সেই সাথে ভারত সিরিজে ১-০তে এগিয়ে যায়। দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ ৩০০ পেরনো মহাকাব্যে কোন কাল ছিল না ভারতের ট্রাজেডির গল্প। সর্বদাই যেন কাব্যের শেষে বিশাল এক হাসি মুখে এঁকে মাঠ ছেড়েছে ভারতের ক্রিকেটাররা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link