ভ্যানিশ হওয়া জাদুকর

– আসলে অফ স্পিনটা সহজাত। যে-কোনো বাচ্চাকেও বলটা ছুড়তে বললে সে অফস্পিনই করবে। তাহলে বাঁহাতি অফস্পিনাররা স্পেশাল হয় কেন?

– হয় না তো। কোথায় হয়? কত যুগ পরে কোন এক রঙ্গনা হেরাথ, কোন এক ড্যানিয়েল ভেট্টোরি তিনশ-র বেশি উইকেট পায়।

– কেন, বিষেণ সিং বেদিও তো কপিল দেবের আগে ইন্ডিয়ার সর্বাধিক উইকেট শিকারি ছিলেন!

– ছিলেন, কিন্তু তিনি কি চন্দ্রশেখরের মতো ভয় ধরিয়ে দিতে পেরেছেন? একটা বাঁ-হাতি শেন ওয়ার্ন কই? নিদেনপক্ষে মুথাইয়া মুরলিধরন?

– আরে সে বললে তো বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানই বা কই যারা লারা বা সাঙ্গাকারা হয়েছে। দুনিয়ায় বাঁ-হাতিরা কম হয় বলেই তো একটা ওয়াসিম আকরামকে দিল দিয়ে বসে থাকি। ব্রেট শ্যুলজের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে দু:খ পাই।

– তুমি কি বাঁ-হাতি?

– আলবাত বাঁ-হাতি! কতদিন ভেবেছিলাম যে যার সঙ্গে প্রেম করব সেও বাঁহাতি হবে।

– আচ্ছা আচ্ছা! তা বেশ তো লম্বা-চওড়া চেহারা বানিয়েছ, ক্রিকেট খেলতে? হ্যাঁ! তাহলে ব্যাটিং? নাকি পেস বল, আক্রম, অ্যালান ডেভিডসনের মতো?

– নাহ। ছেলেবেলা থেকেই বাবা বলটা ক্রস সিমে ধরিয়ে দিয়ে দিলীপ দোশিকে দেখিয়ে দিলেন তো!

– দিলীপ দোশী আর কদ্দিন খেললেন! তারপর তুমিও তো বড়ো হচ্ছিলে, পালটালে না কেন?

– পালটাতাম, কিন্তু ওই যে টিভিতে দেখে ফেললাম, রোগা মতো সদ্য দাড়ি গজানো এক সর্দার, মাথায় পটকা বেঁধে, হাতে কড়া, একটু দুলে, ডান পা আগে ফেলে ভাংরার তালে তালে নাচতে নাচতে দুটো হাতকেই গোল গোল ঘোরাতে-ঘোরাতে ডান পা-টা রিটার্ন ক্রিজ আর পপিং ক্রিজ বরাবর ছুড়ে দিয়ে তারপর ডান হাত চাকার মতো ঘুরিয়ে বাঁ হাতটাকে তার পিছন পিছন নিয়ে এসে ডান পায়ের উপর ভর করে বাঁ হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে বাঁ হাতটা ডান ঊরু পার করে হাত ঘুরিয়ে শেষ করত। আর বলটা ব্যাটসম্যানের চোখের উপরে উঠে ব্যাটসম্যানের কাছে পৌঁছোবার ঠিক আগেই ফ্লাইট ভেঙে পড়ে ব্যাটের কান্না ছুঁয়ে চলে গেল উইকেট কিপারের দস্তানায়। সেই দৃশ্যটা থেকে বেরোতে পারলাম না আর!

– কে? বিষেণ বেদি? কিন্তু তিনি তো তোমার ভালো করে বুঝতে শেখার আগেই খেলা ছেড়েছেন। আর লাস্ট ডেলিভারি স্ট্রাইডে উনি তো ওভাবে পা ছুড়তেন না!

– নাহ, বেদি নয়, বেদি নয়। বেদিকে পছন্দ হয় না, হতও না। কিন্তু এ তো ফিল্ডিং-এও মাশাল্লাহ ছিল। কি বাইরে কি ভিতরে সর্বত্রই সফল ছিলেন, ব্যাটিংটা করতে পারতেন না শুরুতে। কিন্তু বোলিংটা? শারজায় রামিজ রাজাকে একটা আর্মার মেরেছিলেন, বলটা অফস্টাম্পের বাইরে পড়ে ভিতরে চলে আসে। ব্যাটসম্যান তো বোঝেনইনি, কিন্তু উইকেটও বোঝেনি কখন তার বল উড়ে গেছে। তখন তো আবার দুসরা ছিল না। হাত ভেঙে পনেরো ডিগ্রির সহায়তা নিয়ে হাত উলটে ছোড়া। তখন আর্ম বলটাই ছিল অফস্পিনারদের শক্তি। বা লুকানো অস্ত্র। পালিশ করা সাইডটা হাতের তালুর দিকে না রেখে বাইরের দিকে রেখে আঙুল না মুচড়িয়ে বল ছাড়া আর সিমে পড়ে ইনস্যুইং করত।

– আর স্টক বল? বাঁ-হাতি অফস্পিনারকে খেলা অত শক্ত কেন?

– আসলে এটার ব্যাখ্যা হয় না। সাধারণত অফ স্পিনারের বল ভিতরে আসে অর্থাৎ আমার আয়ত্তের মধ্যে। বাঁহাতির বল বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ আমার আয়ত্তের ভিতর থেকে বাইরে চলে যায়। ওই আকর্ষণ অমোঘ, ব্যাটসম্যান পারে না ব্যাট এড়াতে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায় উইকেট রক্ষকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে! অথবা ফার্স্ট স্লিপের গাভাস্কাররা বল নিয়ে পকেটে পুরে দৌড় লাগান কভার পয়েন্টের দিকে, যেখানে ওই সর্দার হাততালি দিতে দিতে ছুটে চলেছেন।

– মানিন্দার সিং?

– মনে আছে? নামটা মনে আছে? ধূমকেতুর মতো মঞ্চে প্রবেশ। ইংল্যান্ড পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়ার কোমর ভেঙে ৮৭-র বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। মনে আছে?

– না, মানে, মনে আছে। তবে ওগুলোর জন্য নয়। ওই যে মাদ্রাজের টাই টেস্টে শেষ গ্রেগ ম্যাথুজের বলে ব্যাট লাগাতে পারল না। তারপর বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগে একই অবস্থায় স্টিভ ওয়-র বলেও বিট হয়ে গেলেন। অথবা ইডেনের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিকে সেলিম মালিকের কাছে ধুনাই। তারপর ১৯৯০-এর দেওধর ফাইনালে আজহারের হাতে মার। একশ উইকেট পেয়েছিলেন? টেস্টে তো হারিয়েই  গিয়েছিলেন। পরে ব্যাটিং করারও চেষ্টা করেছিলেন শুনেছি। আম্পায়ারিং-ও। এখন কোথায়?

– সেসব পরে হবে। তার আগে ইংল্যান্ড সিরিজ মনে করো। মাইক গ্যাটিং-এর আউটটা? ৮৬-৮৭ সোনার সময় মানিন্দারের। পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা। আট মাসে ১৩টা টেস্টে ৫৫টা উইকেট। ফ্লাইট ভ্যারিয়েশন, ক্রিজের কোণ থেকে বল করা উইকেটের কাছ ঘেঁষে বল করা, স্পিনিং গ্রিপে আর্ম বল, সিমিং গ্রিপে আর্মার ছাড়াও যেটা ছিল সেটা হল বলের লুপের সঙ্গে বল ভিতরে পড়ে গোখরোর মতো ছোবল মেরে বাইরে যাওয়া। এই সময়ই শিখেছিলাম পালিশ করা দিকটা হাতের ভিতরের দিকে রাখতে হবে। তাহলে রিলিজে সেটা বাইরের দিকে থেকে হাওয়ার ধাক্কায় হালকা স্যুইং করে ভিতরে পড়বে আর তারপর স্পিন নিয়ে যাবে তাকে বাইরে।

– তারপর কী হল?

– আসলে তখন মানসিক ভাবে ক্রিকেটকে দেখা হত না। টেনশন, চাপ সহ্য করতে না-পারা, এসব দুর্বলতা হিসাবে দেখা হত। সাতাশির পর থেকেই মানিন্দারের বোলিং-এ বিশেষত রান আপে চেনা ছন্দ গায়েব। অনেক পরে যখন ফিরে আসছিলেন, তখনই ইরানি ট্রফিতে অনিল কুম্বলে ১৪ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চলে গেলেন। আর তারপর শুরু হল কুম্বলে-চৌহান-রাজুর যুগ। মানিন্দার এরই মধ্যে একটা টেস্ট খেললেন; জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। কিন্তু সেই রিদম নেই। ডান পা-টা ডেলিভারি স্ট্রাইডের আগে অদ্ভুত ভাবে সামনের দিকে ছুড়ে দিয়ে বল করতেন। লুপ গায়েব, ফ্ল্যাট স্পিন শুধু। আন্তর্জাতিক মানের আর রইলেন না। ব্যাটিংটা তদ্দিনে শিখেও কাজ হয়নি।

আসলে আমার মনে হয় ওঁকে বড়ো দ্রুত আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে আসা হয়। বেদি নেই, দোশি নেই, নতুন কাউকে দরকার ছিল তাই বাচ্চা ছেলেটাকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়। আর দিল্লীর ক্রিকেটে হিজ-হিজ হুজ-হুজ। কেউ কাউকে দ্যাখে না, ভয়ানক দলাদলি। না হলে রবি শাস্ত্রীও তো একই সময়ে অভিষেক করেছিল। মুম্বাইয়ের ছেলে খাড়ুশ ছিল। সহজে লড়াই ছাড়ত না। মানিন্দারের অর্ধেক ট্যালেন্টও ছিল না, কিন্তু দেড়শ উইকেট। প্রথম টেস্টে এগারোয় ব্যাট করা ব্যাটসম্যান ওপেন করে দুশো। মানিন্দারের উপর খালি চাপ ছিল। পরবর্তী বেদি হবার চাপ। কিন্তু মেন্টরের হাত ছিল না। তারপর আরও কত কী! আম্পায়ারিং, কোকেন সেবন, নেশা করে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা। এসব পেরিয়ে এসে আজকাল ধারাভাষ্যটা খারাপ দিচ্ছেন না।

– হ্যাঁ, একই কথা লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণেরও। চরস খেয়ে খেয়ে শরীরটাই শেষ করে ফেলেছিলেন। তারপর ফিরে এসে এখন ধারাভাষ্যকার।

– আসলে এখন তাও ভাবনাচিন্তা হচ্ছে। মনোবিশেষজ্ঞদের কাছেও নিয়মিত যাচ্ছে মানুষ। খেলোয়াড়রা তো অবশ্যই। স্পোর্টস সাইকোলজি একটা বিশেষ ধারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ঋষাভ পান্তরা যে আবার ফিরে আসবে সেই আশা থেকেই যাচ্ছে।

– ঠিক, আসলে মানিন্দারদের সময় সেটা ছিল না। আর তার ফলে আমরা বিশ্বের শেষ ক্লাসিকাল বাঁ-হাতি স্পিনারকে হারালাম। মাত্র ৮৮ টেস্ট উইকেট আর ৬৬ সীমিত ওভারের উইকেটে থেমে যেতে হয়। ভেট্টোরি বা হেরাথ বা হাল আমলের জাদেজারা থাকবেন। কিন্তু মানিন্দারের সেই রিদম, সেই ফ্লাইট, সেই স্পিনের ছোবল, সেই চোখের আরাম, সেই জাদুকরী, যেটা হয়তো ফিল টাফনেল বা কিছুটা মুরালি কার্তিকের মধ্যে ছিল। সেটা আজকের গদার মতো ব্যাট আর ছোটো বাউন্ডারির চাপে মিউজিয়াম পিস হিসাবেই রয়ে যাবে আর টেনে টেনে বোলাররা লাইন আর লেন্থ নিয়েই পাতার পর পাতা গরুর রচনা লিখে চলবে। সব কি আর ইউটিউব ভিডিওতে ধরা থাকে?

– ঠিক কথা। ভ্যানিশ করতে গিয়ে জাদুকররা নিজেরাই ভ্যানিশ হয়ে যায় আর আমরা সাধারণ মানুষরা খোঁজও রাখি না।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link