বিশ্বজয়ী একমাত্র প্রোটিয়া

মানুষ একটা কথা খুব করেই বলে- ‘ভাল ছাত্র নাকি অধিকাংশই ভাল শিক্ষক হয় না।’ কিন্তু গ্যারি কার্স্টেন ছাত্র হিসেবে যেমন ভাল ছিলেন, শিক্ষক হিসেবে তার চেয়েও ঢের বেশি উঠেছিলেন সাফল্যের আকাশচুম্বী চূড়ায়। ক্রিকেটার হয়ে যা অর্জন করতে পারেননি, কোচিংয়ে এসে সে ক্ষতকে প্রলেপ লাগিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব সেরা কোচ।

২০০৭ বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়ের পর ভারতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব দেয়া হয় গ্যারি কার্স্টেনকে। ২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০১১ বিশ্বকাপ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে ভারতকে করেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি। টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানে ওঠা, ২৮ বছর পর একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ ট্রফি পুনরুদ্ধার- ভারতীয় ক্রিকেটের সোনালী অধ্যায়ের কারিগর এই গ্যারি কার্স্টেন।

গ্যারি কার্স্টেনের কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুটা এই ভারতকে দিয়েই। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পর কার্স্টেনকে পটাউনে নিজস্ব একটি ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। আর সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঐ ক্রিকেট একাডেমি ঘিরেই কাটছিল কার্স্টেনের দিন। এর মধ্যেই অদ্ভুতুড়ে-ভাবে ভারতীয় কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কারের এক মেইল বার্তা পান কার্স্টেন।

যাতে লেখা ছিল, ‘ভারতীয় দলের কোচ হতে চাও?’  ব্যাপারটাকে প্রথমে ধাপ্পাবাজি ভেবে আর আমলে নেননি। পরবর্তীতে গাভাস্কারের মেইল থেকে আরও একটি বার্তা পান গ্যারি। ভারতীয় এ কিংবদন্তির সাথে কথোপকথনের জেরেই চলে আসেন ভারতে, বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) কাছে জাতীয় দলের প্রধান কোচ হওয়ার ইন্টারভিউ দিতে। সেদিনের সাত মিনিটের সাক্ষাৎকার পর্ব শেষে কোনরূপ কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকা কার্স্টেন নিয়োগ পেয়ে যান ভারতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে।

কোনরূপ কোচিং অভিজ্ঞতা না থাকা কার্স্টেন হয়তো কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি কোনদিন এভাবে ভারতের মত হাই-প্রোফাইল একটি দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পেয়ে যাবেন। দায়িত্বটা যেমন অবিশ্বাস্যভাবে পেয়েছিলেন কার্স্টেন তেমনি দায়িত্ব লাভের পর তার অর্জনগুলোও ছিল সব অবিশ্বাস্য বিস্ময় জাগানিয়া। খেলোয়াড়ী জীবনে যেসব অপূর্ণতা নিয়ে তিনি অবসরে গিয়েছিলেন কোচিং ক্যারিয়ারে এসে তার সবটাই ঘুচিয়েছেন কার্স্টেন ।

দু’বারের চুক্তিতে প্রায় চার বছর ভারতের দায়িত্ব পালন করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কোচের তকমা গায়ে লাগানোর পর পরিবারকে সময় দেয়ার কারণ দেখিয়ে আর বিসিসিআইয়ের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেননি। পরবর্তীতে হয়েছিলেন নিজ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের কোচ। পাশাপাশি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এ কোচ তার অভিজ্ঞতার দ্যুতি ছড়িয়েছেন ফ্রাঞ্চাইজি লিগ আইপিএলের রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু, বিগ ব্যাশের হোবার্ট হ্যারিকেন এবং ইংল্যান্ডের ‘দ্য হান্ড্রেড ক্রিকেট’ টুর্নামেন্টে কার্ডিফের হয়ে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ চন্দ্রিকা হাতুরুসিংহের বিদায়ের পর তাকে ঘিরে গুঞ্জন উঠেছিল হাথুরুর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কিন্তু বিসিবির চাহিদা মেনে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে শেষমেশ আর সে দায়িত্ব নেননি। তবে  মোটা অংকের বেতনে কোচ নিয়োগে বিসিবির পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছিলেন এই প্রোটিয়ান।

কোচ হিসেবে কার্স্টেন যেমন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ক্রিকেটার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও প্রোটিয়া এ ওপেনার তার সময়ে ছিলেন সেরাদের সেরা। ১৯৯৩ সালে রঙিন পোশাকের একদিনের ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে অভিষেক। ওই বছরেই মেলবোর্নে অজিদের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ক্রিকেটের রাজসিক ফরম্যাট টেস্ট ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয় কার্স্টেনের। শুরুর পরে আর কখ‌নও পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি গ্যারি কার্স্টেনকে। প্রথম প্রোটিয়া ক্রিকেটার হিসেবে দেশের হয়ে শততম টেস্ট ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি তার দখলে।

১০১ টি টেস্ট ম্যাচে ২১ টি সেঞ্চুরিতে ৭২৮৯ রান করে তিনি যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে যান তখন তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে হয়ে টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান ও সেঞ্চুরির রেকর্ড। যদিও পরবর্তীতে সতীর্থ জ্যাক ক্যালিসের কাছে দুটি রেকর্ডেরই মালিকানা হারিয়েছিলেন তিনি।

গ্যারি কার্স্টেন বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান, যিনি তাঁর সময়ে টেস্ট খেলা অন্য সবগুলো দেশের বিপক্ষে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। প্রোটিয়া এ ওপেনার ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন ধৈর্যের রুদ্রমূর্ত প্রতীক। ডারবানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফলোঅনে পড়ার পর ১৪ ঘন্টা ব্যাটিং করে ২৭৫ রান সংগ্রহ করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করা ইনিংসটি পাকিস্তানের হানিফ মোহাম্মদের ৯৭০ মিনিটের ইনিংসের পর বিশ্বরেকর্ড গড়া দ্বিতীয় মন্থরতম ইনিংস।

একদিনের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটিও এই প্রোটিয়া ওপেনারের দখলে। ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে তাঁর খেলা ১৮৮ রানের দুর্দান্ত ঐ ইনিংসটি এখনও দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সর্বোচ্চ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ।

টেস্ট ও একদিনের ক্রিকেট মিলিয়ে ব্যাট হাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৪ হাজার রান ও ৩৪ টি সেঞ্চুরি করা প্রোটিয়া এ ওপেনার অসামান্য ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে পেয়েছেন ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার। খেলোয়াড় হিসেবে উইজডেনের স্বীকৃতি আর কোচ হিসেবে ‘বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ তকমা অর্জনই বলে দেয় জীবনের দুটি পর্যায়েই কতটা ধারাবাহিক আর সফল ছিলেন গ্যারি কার্স্টেন।

অন্য যেকোনো প্রোটিয়া গ্রেটের মত তাঁরও কখনও বিশ্বকাপ জিততে না পারাই ছিল খেলোয়াড়ী জীবনের বড় আফসোস। বাকিদের সেই আফসোস না গেলেও গ্যারি কার্স্টেন সেটা মিটিয়েছেন কোচ হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link