নেইমারকে চিনেছিলাম, ২০০৯ এ। ওর অভিষেকের বছরখানিক আগে। ব্রাজিলে তখন ‘নিলমার’ নিয়মিত ছিলো; ভাবছিলাম যে পত্রিকা বুঝি ভুল করে ‘নিলমার’ কে ‘নেইমার’ লিখছে! পরে বুঝলাম, নামটা ব্রাজিলের নতুন এক সম্ভাবনার নাম।
মিডিয়ায় নেইমারের নাম আলোচনায় আসে অনেক ছোটবেলাতেই, অ্যাকাডেমি’র মাঠে পিচ্চি এক ছেলের স্কিল গতি আর ফুটবল সেন্স দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন অনেকেই; সেই সময় থেকেই নেইমারকে ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন অনেকেই!
১৭ বছর বয়সে সান্তোসের সিনিয়র টিমে অভিষেক হওয়ার সাথেই ডাক পেয়েছিলেন হলুদ জার্সির অনূর্ধ্ব-১৭ দলে, এরপরে খেলেছেন অনূর্ধ্ব ২০ দলে।
হলুদ জার্সিতে আর সান্তোসের সিনিয়র দলে নেইমারের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ ছিলো ব্রাজিলবাসী; গ্লোবো এক নিউজে জানিয়েছিলো তৎকালীন ব্রাজিল কোচ কার্লোস দুঙ্গার কাছে প্রায় ১০ হাজার চিঠি এসেছিলো নেইমারকে ২০১০ বিশ্বকাপের দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে। দুঙ্গা তা কানে না নিলেও, এটি অনুমেয়ই ছিলো যে ২০১০ পরবর্তী সময়ে নেইমারই হবেন ব্রাজিলের কাণ্ডারি! তবে জাতীয় দলের ডাক যে এত দ্রুতই পাবেন তা হয়তো স্বয়ং নেইমারও ভাবতে পারেননি! ২০০৬ বিশ্বকাপের পরে ব্রাজিলের প্লেয়িং স্টাইল পাল্টে দুঙ্গা যে ঐতিহাসিক ভুল করেছিলেন, সম্ভবত তার স্বীকৃতি মিলে ২০১০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হতাশাজনক পারফরম্যান্সে!
ব্রাজিলের স্বর্ণালি যুগ পরবর্তী প্রথম দলের এমন হতশ্রী পারফরম্যান্স হতবাক করেছিলো পুরো ব্রাজিলবাসী কিংবা বিশ্বব্যাপী ব্রাজিল ভক্তদের! খেলায় ছন্দ নেই, ঐতিহাসিক সাম্বা নেই, দুঙ্গা’র ‘সৌন্দর্য্য নয়, জয়ই মুল’ ফিলোসোফি তখন পুরোপুরি ব্যার্থই নয় কেবল, বরং সমালোচনা আর আফসোসের চরম পর্যায়ে!
ব্রাজিল’কে ঘুড়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় মানো মেনেজেস কে; যিনি প্রথম এসাইনমেন্টেই বিশ্বকাপ দলের ২০ জনকে বাদ দিয়ে গড়েন তারুণ্য নির্ভর এক দল; যেই দলের সকল আশা প্রত্যাশা পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে একজন – মাত্র ১৮ বছর বয়সী সান্তোসের নেইমার জুনিয়র!
শুরুটা সেইখানেই, এরপর দীর্ঘ সময় পেড়িয়ে নেইমার ব্রাজিলের হয়ে মোট ১০৩ ম্যাচে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৪ গোল আর দেশের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট ৪৪ টির মালিক! কিন্তু এসবের চরম সত্য যেটি, তা হলো নেইমার অনেকের কাছেই কিঞ্চিৎ হতাশার নাম; একটা সময়ে মানুষটাকে নিয়ে যে প্রত্যাশার পারদ ছিলো, অস্বীকার করার উপায় নেই গত ১০ বছরে হয়তো তার অনেককিছুই পুরণ করতে পারেননাই মানুষটা। এরপরেও নেইমারকে নিয়ে একদল পাগলপ্রাণ মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখে আরো ভালো কিছুর, স্বপ্ন দেখে অনন্য এক উচ্চতার, যাদের কাছে নেইমার নিছক একজন খেলোয়াড় নন, বরং এক অনুভূতির নাম, যাদের কাছে নেইমার প্রেরণার নাম!
ফুটবল’টা কারো কাছে নিছক একটি খেলা, কারো কাছে কেবলই বিনোদনের মাধ্যম! কিন্তু এই ফুটবল’টাই কারো কাছে শুধু খেলা নয়, বরং জীবনে চলার পথে সবচেয়ে বড় পাথেয়, বেঁচে থাকার অন্য নাম, দুঃখ কিংবা দুর্দশাকে পাশ কাটিয়ে একটুখানি সুখের পরশপাথর!
মানুষ হিসেবে কেউই কখনো শতভাগ সুখী নয়, ছোট্ট এই জীবনে আমাদের অসংখ্য না পাওয়া, অসংখ্য অপ্রাপ্তি, অসংখ্য বুক চাপা কস্ট! কোথাও বা অর্থকড়ির অভাব, কোথাও বা প্রেয়সীকে হারানোর অভাব, আবার কোথাও বা সব পেয়েও আরো উচ্চতায় না পৌছাতে পারার আক্ষেপ; হতাশা কিংবা মারাত্মক দুর্দশা, চরম পর্যায়ের খারাপ থাকার মাঝেও ফুটবল কে বেঁচে থাকার পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করা মানুষগুলো ফুটবল মাঠের ৯০ মিনিটে ভালোথাকার সব কারণগুলো খুঁজে নেয়, যেখানে সমস্ত খারাপগুলো ভুলে নতুন সূর্যদয়ের সাথে নতুন শুরুর প্রেরণা পায়, এক পশলা সুখ খুঁজে পায়!
প্রিয় দল কিংবা প্রিয় খেলোয়াড়ের ব্যর্থতা হয়তো পরিস্থিতিকে অন্য মোড়ে নেয়; কিন্তু ফুটবল নামক গোলকধাঁধা হতে প্রাপ্তির জায়গায় এই অপ্রাপ্তি হয়তো নিছকই ক্ষুদ্রকায়!
পাগলপ্রাণ সেই মানুষ ফুটবল কে ভালোবেসে যদি হৃদয়ে স্থান দিয়ে থাকে তবে তার হৃদস্পন্দন এই মানুষ’টা; নেইমার! তাদের কাছে মানুষটা একটা ভালোবাসার নাম, আবেগের নাম!! কারো আবেগ কিংবা ভালোবাসা’কে কোন মানদন্ডে পরিমাপ করে এমন সাধ্যি কার!!
আপনার কিছু মানুষ থাকেনা, আপনার পরিবার কিংবা আপনজন, যারা আপনার যেকোন ভালোলাগার কেন্দ্রবিন্দু তে থাকে? যারা আপনার প্রতিদিনের রুটিনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে? পাগলপ্রাণ সেই মানুষগুলো নেইমারকে তাদের থেকে ঠিক আলাদা করবে কোথায়?
ইহজগতের কোটি কোটি ফুটবল ফ্যানের মাঝে আমি নিতান্তই এক ক্ষুদ্র, সামান্য একজন। আমার ভালোবাসা কিংবা ঘৃণায় কোন ফুটবলারের কিংবা অন্যান্য ফ্যানদের কিচ্ছুটিই যায় আসবেনা। কিন্তু একটা মানুষকে ভালোবাসার ফল আমার আমিকেই পুরো ভালো রাখতে পারে, আনন্দে রাখতে পারে, হতাশামুক্ত রাখতে পারে, অনুপ্রানিত করতে পারে।
গত ১০ বছরে মানুষটা কলিজায় মিশে গেছে, অস্তিত্বে মিশে গেছে, অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে! এ ভালোবাসা কে ছোট করে দেখে এ সাধ্যি কার!
সপ্তাহে দুই ম্যাচ ডে বাদ দিয়ে বাকি দিনগুলাতে মানুষটার খেলা দেখার জন্যে অপেক্ষায় থাকা, ম্যাচ ডে’র সকাল থেকে খেলা শুরু হউয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটা মুহুর্ত যেনো একেকটা যুগ, সাথে পরম আনন্দ এই ভেবে যে আজ মানুষটার খেলা দেখবো, যেই আনন্দে সকল চাপ কিংবা খারাপ লাগা কিংবা হতাশাকে ভুলে থাকা যায়!
মানুষ ডিপ্রেশনে পড়ে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড হয়; এই মানুষটাকে অস্তিত্বে মিশে নিছি তো, ড্রাগের প্রয়োজন আছে? এই মানুষটার একেকটা গোল এসিস্টে যে পরিমাণ সুখানুভূতি ছুয়ে যায়, তা দিয়ে পাহাড়সম ডিপ্রেশন কেটে উঠা যায়। হ্যাঁ, এইভাবেই এতটাই নিজের সাথে মিশে গেছে মানুষটা।
প্রচন্ড মন খারাপ; ইউটিউবে মানুষটার কিছু ক্লিপ দেখে নিলাম! মনটা যেনো ভালো হয়ে যায়!!
মানুষটার ইন্সটা স্টোরি কিংবা ফটো ক্যাপশনে ব্যাবহার করা ছোটখাটো মোটিভেশনাল স্পিচ যেনো অন্য যেকোন মোটিভেশন কে হার মানায়!!
ভালোবাসি মানুষটাকে; ১০ টা বছর ধরে ভালোবাসি!
নেইমার নামক আশা প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তি’র সমীকরণ মিলানো হয়তো কঠিন; কিন্তু নেইমার নামক একজন ব্রাজিলিয়ান যোদ্ধার প্রতি ভালোবাসা সম্মান আর চাওয়ার কোন শেষ হয়না, যিনি গত ১০ বছর ধরে ব্রাজিলের জার্সিতে ব্রাজিলকে তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যাচ্ছেন, ভক্তদের উচ্ছাসে মাতাচ্ছেন, প্রিয় দল ব্রাজিল’কে এগিয়ে নিচ্ছেন!
ব্রাজিলবাসীর পরম আরাধ্য অলিম্পিক জিতিয়েছিলেন কড়া সমালোচনা আর দুয়ো উপেক্ষা করে, কিংবা সেলেসাওদের হয়ে ১০ বছর যাবৎ ধারাবাহিক পারফরম্যান্স হয়তো এই মুহুর্তে নেইমার কে ব্রাজিলের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় রাখা নিয়ে দ্বন্দ হতে পারে; কিন্তু নেইমার ব্রাজিলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফর্মার, এ নিয়ে বোধ করি কারোই সন্দেহ থাকার কথা না!
যাত্রাটা শুরু হয়, আজ থেকে ২৯ বছর আগে। ১৯৯২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলের মগি দাস ক্রুজেসে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নেইমার। নেইমাররের উত্থানও অন্যসব ফুটবল গ্রেটদের মতোই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফুটবলকে ধ্যান-জ্ঞান ও পেশা হিসেবে বেছে নেয়া। নেইমারের বাবা নেইমার সিনিয়রের’ও ইচ্ছা ছিলো ফুটবলার হউয়ার, কিন্তু দারিদ্র্যের গ্যাঁড়াকলে সে স্বপ্ন পুরণ হয়নি তার। ভাগ্যান্বেষণে ব্রাজিলের মধ্যাঞ্চলের শহর সাও ভিনসেন্ট থেকে ১৯৯২ সালে সাও পাওলোর মগি দাস ক্রজেস শহরে এসেছিলেন তিনি। ওই দুঃসময়ে সিনিয়র নেইমারের ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ঘর আলো করে আসে জুনিয়র নেইমার। এরপর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে যায় তার। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলেকে দিয়ে পূরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এ কারণে অভাবের সংসার হলেও ছেলেকে এর আঁচ লাগতে দেননি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উত্তরসূরির চাওয়া পূরণ করতে। ছোট্ট ছেলের প্রতিভা ক্ষুরধার হওয়ায় কাজটাও সহজ জয়।
যার প্রমাণ মেলে স্থানীয় ‘পর্তুগিজা সানটিস্টা’ ফুটবলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের মধ্যদিয়ে। তখনই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ব্রাজিলের বস্তি থেকে ফুটবিশ্ব শাসন করতে আসছে আরও একজন বিস্ময়বালক। মূলত সাও পাওলোর রাস্তায় ফুটবল খেলতে খেলতে ফুটবলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় সেদিনের ছোট্ট নেইমারের। নেইমারের বিস্ময়কর উত্থানের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর তিনি কিশোর প্রতিভা হিসেবে ক্লাব সান্তোসে যোগ দেন। পেশাদার ফুটবলের সঙ্গে তখন থেকেই পরিচিতি ব্রাজিলের বর্তমান স্বপ্নদ্রষ্টার। সেদিনের নেইমার আজ বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়।
নেইমার তো এমনই। কতশত লাখো কোটি ভক্তের নয়নের মণি। নেইমার তো এমনই। কতশত লাখো কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা। দরিদ্র এক ঘর থেকে উঠে এসে ব্রাজিল কে ফুটবলবিশ্বে প্রতিনিধিত্ব করা, নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন করা নেইমার – কতশত যুবক বালকের এগিয়ে যাওয়ার উদ্দীপনা। কতশত লাখো কোটি হতাশাগ্রস্থ মানুষ স্বপ্ন দেখে নতুন করে বাঁচার নেইমারের ‘1% chance, 99% faith’-এ, পায় সফলতা অর্জনের দীপ্তিময় সাহস।
কেবল প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তা যেনো মানুষ’টার প্রতি একটু সন্তুষ্ট হয়, তাকে সুস্থ রাখে! স্বপ্ন দেখি তাহলেই হয়তো, নেইমার নামক আশা প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির খাতাটা পুরোপুরি মিলবে; একদিন হয়তো নেইমার কে ব্রাজিলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বলায় আর কোন দ্বন্দ্ব থাকবেনা; ব্রাজিলবাসী তথা নেইমারের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পুরণ হবে, কিংবা ব্রাজিলের ট্রফি খাতায় আরো প্রাপ্তি যোগ হবে!
কেবলই শুভকামনা! প্রার্থনা নেইমার এগিয়ে যাবে অনেক দূর, নিজেকে নিয়ে যাবেন অনন্য অসম্ভব এক উচ্চতায়, নাম লেখাবেন কিংবদন্তিদের তালিকায়। আস্থা বিশ্বাস স্বপ্ন, নেইমারের হাতেই আসবে ব্রাজিলের ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ, নেইমারর পায়ের জাদুতেই পুরণ হবে হেক্সা জয়ের বাসনা। শুভকামনা, নেইমার
সৃষ্টিকর্তা যেন মানুষটার প্রতি একটু সন্তুষ্ট হয়, তাকে সুস্থ রাখে! স্বপ্ন দেখি তাহলেই হয়তো, নেইমার নামক আশা প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির খাতাটা পুরোপুরি মিলবে; একদিন হয়তো নেইমার কে ব্রাজিলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বলায় আর কোন দ্বন্দ্ব থাকবেনা; ব্রাজিলবাসী তথা নেইমারের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পুরণ হবে, কিংবা ব্রাজিলের ট্রফি খাতায় আরো প্রাপ্তি যোগ হবে!
ভালো থেকো সবসময়, প্রিয় নেইমার! ভালো রেখো সবসময়, প্রিয় নেইমার! বেঁচে থাকো নিজ উদ্যামে, আমাদের প্রেরণা হয়ে, ভালোবাসায়, মন্ত্রমুগ্ধে! ‘নেইমার’ মানুষটাই আমাদের জন্যে অনেক বড় পাওয়ার, বড় আনন্দের, বড় সৌভাগ্যের! সেজন্যেই বলতেই বাঁধেনা, প্রত্যাশার কিঞ্চিৎ’ও যদি নেইমার পুরণ না করতে পারে তবুও জীবনভর সমুচ্চারণে স্মরণ করব, আমি নেইমার ভক্ত ছিলাম, যে মানুষটা আমার প্রতিটি মুহুর্তের সঙ্গী ছিলো, যাকে ঘিড়ে প্রেরণা ভালো থাকা আর আকাশচুম্বী ভালোবাসা ছিলো! সত্যিকারের ভালোবাসায় তো কোনো শর্ত থাকে না!