বিশ্বকাপটা হতে পারে সাকিবের!

জীবনটা কি শিল্পের মত? খুব সম্ভবত নয়। শিল্পের আলাদা আলাদা ধারা আছে। সেই ধারাগুলির ‘কমেডি’, ‘ট্রাজেডি’র মত নানা নাম আছে, এই নামগুলি একেকটা পথ মেনে চলে, নিজের চারপাশে গড়ে তোলে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তির সীমারেখা। কিন্তু জীবন? একদম আলাদা! প্রতিটা জীবন নিজের নিজের পথ তৈরি করে নেয়, বয়ে যায় অনিশ্চয়তার পানে!

ডন ব্রাডম্যানের কথাই ধরুন না! সর্বকালের সেরাদের কাতারে থাকা এই কিংবদন্তি শত গড়ের রেকর্ডটা ছুঁতে পারলেন না এরিক হোলিসের বলে ডাক মেরে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়ে! কিংবা আপনি ভারতীয় দলের ২০১১ এর গ্রীষ্মটার কথাই ভাবতে পারেন। যে গ্রীষ্মের শুরু হয়েছিল বিশ্বকাপ জয়ের রূপকথার মাধ্যমে আর শেষটায় ছিল ইংল্যান্ডের সাথে ৪-০ তে টেস্ট সিরিজের হার!

জীবন কতটা অনিশ্চিত তাই না!

জীবন আর অনিশ্চয়তার মিশেলে গল্প বলতে হলে এরপরই আসবে সাকিব আল হাসানের নাম। যেদিনটা তাঁর নিজের দিন হবে, সেই দিনেই তিনি হবেন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। বিগত দেড় দশক ধরে তিনি বাংলাদেশের সবচাইতে বড় পারফরমার। দেশটির সবচেয়ে বেশি উইকেট সংগ্রহক, সব ফরম্যাট মিলিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান তাঁর ঝুলিতেই! এই বিচিত্র পৃথিবীতে , সাকিব আল হাসান যেন একা অস্ত্র হাতে চলা এক সৈন্য- যে পরিস্থিতিতেই আপনি তাকে ফেলুন না কেন, সব চ্যালেঞ্জ উতরে তিনি বেরিয়ে আসবেন বিজয়ীর বেশেই!

নিজের এই লম্বা ক্যারিয়ারে সাকিব এমন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। এই চ্যালেঞ্জের অনেক রেকর্ডকেই তিনি নিজের করে নিয়েছেন, আর এবার? এবার তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আরো একটা বিশ্বকাপের সামনে!  আর এটা কে না জানে, সোনায় মোড়ানো এক ক্যারিয়ারে সাকিবের পাওয়া হয়নি স্রেফ একটা বিশ্বকাপ!  আর সাকিব আল হাসান যে সেটি মনে প্রাণে চাইবেন সেটা কে না জানে!

তবে সাকিবের দল বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বিবেচনায় হয়তো এমন বিশ্বকাপ জয়ের ভাবনা দুরাশাই ভাবতে পারেন অনেকে। কিন্তু সত্যি বলতে, সাকিবের মত একজন স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার আর সাথে মুস্তাফিজের মত একজন প্রমাণিত ম্যাচ উইনার নিয়ে বাংলাদেশ যেকোন কিছুই করতে পারে। তবে এটা আপনাকে মানতেই হবে, বিশ্বকাপ মিশনে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় অস্ত্র হতে পারে সাকিব আল হাসানের স্কিল আর ক্ষুরধার মগজ!

সাকিব আল হাসান এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছেন আরেকটি রেকর্ডের সামনে। আন্তর্জান্তিক টি-টোয়েন্টিতে লাসিথ মালিঙ্গার সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটি তিনি হয়তো সামনেই ভেঙে ফেলবেন। তবে এই মুহুর্তে সাকিবের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির হিসাব ব্যতিরেকে শুধুমাত্র বিশ্বকাপ বিবেচনায় নিলে তাঁর পরিসংখ্যান বলবে, সীমিত ওভারের এই ফরম্যাটে তিনি করেছেন ৫৬৭ রান আর নিয়েছেন ৩০ উইকেট!

আর এছাড়াও বাংলাদেশ দলের হয়েও বড় টুর্নামেন্টে সাকিব আপন আলোয় জ্বলে উঠেছেন বহুবার। সেসবের উদাহরণ দিতে গেলে আসবে  নানা রঙের সব ম্যাচের গল্প। ২০০৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতের সাথে  ৫৩, ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উইন্ডিজের সাথে ৪-৩৪ এর বোলিং স্পেল, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের সাথে ১১৪, , ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ৭৫ আর ১-৫০ এর অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স- বড় মঞ্চে বাংলাদেশ দলকে ফুয়েল যোগাতে সাকিব আল হাসান নামটার কখনও ভুল হয়না!

সাকিব আল হাসানের বয়স এখন ৩৪,  স্কিলের সাথে তাঁর ভান্ডারে এখন যোগ হয়েছে নানা অভিজ্ঞতা। আন্তর্জাতিক তো বটেই, আইপিএলের মত বিদেশী লীগে খেলাও তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিকে করেছে আরো বেশি অনন্য। আর এই বিশ্বকাপে তামিম ইকবালের দলে না থাকা মুশফিক-রিয়াদের পাশাপাশি সাকিব আল হাসানের অভিজ্ঞতার মূল্যকে যে আরেকটু বাড়িয়ে দেবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।

আর এই ফরম্যাটে নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর থেকে সাকিব আল হাসানের ফর্ম যে খুব একটা খারাপ যাচ্ছে এমনটাও বলা যাবেনা। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর টি-টোয়েন্টিতে তিনি করেছেন ১৯৬ রান, বল হাতে নিয়েছেন ১৪ উইকেট। অবশ্যই সাকিব আল হাসান নামটার থেকে চাহিদার তুলনায় এই পারফরম্যান্সের যোগানকে অপ্রতুলই বলতে হয়, কিন্তু তবুও- তিনি তো পারফর্ম করেছেন!

ব্যাট হাতে বড় মঞ্চে সাকিব আল হাসান সবসময়ই দলের ট্রামকার্ড। এই ২০১৯ বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না, টুর্নামেন্টটা তিনি শেষই করেছেন তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে। আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও সাকিব আল হাসানের চাইতে বেশি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস তাঁর দলের আর কারই বা আছে? রানের সংখ্যার হিসেব যদি আপনি একদিকে সরিয়েও রাখেন, তাহলেও সাকিব আল হাসানের আবেদন দলে অনন্য। বিশেষ করে সাকিবের মিডল অর্ডারের যেকোন জায়গায় খেলার সামর্থ্য দলের স্বস্তিকে যেন আরেকটু বাড়িয়ে দেয়!  এছাড়াও গত কয়েক বছরে তিনি টপ অর্ডারেও যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, তাতে তামিমের না থাকায় টপ অর্ডার সামলানোর দায়িত্বটা যদি বাংলাদেশ ম্যানেজমেন্ট সাকিবকে দিয়েও দেয়, সেটাও নির্ভার কাঁধে দায় দেওয়ার মতই হবে।

এ তো গেল ব্যাট হাতের কেচ্ছা। বল হাতেও সাকিব আল হাসানের চার ওভার বাংলাদেশ দলের জন্যে যেন নির্ভরতার সুবাতাস। বিশেষ করে আমিরাতের ঐ পিচে সাকিব আল হাসানের বাঁহাতি স্পিন যে দুর্দান্ত কাজের হবে, সে কথা তো আর বলে দিতে হয়না। অবশ্য এর প্রমাণও সাকিব দিয়েছেন, এই এশিয়াতেই যে তিনি নিয়েছেন ৬৮ উইকেট, যে সংখ্যাতে সাকিবের আগে রশিদ খান ছাড়া আর কেউ নেই! সবমিলিয়ে, সাকিব আল হাসানের উপস্থিতি বাংলাদেশ দলের একাদশকে অনেক বেশি ভারসাম্য এনে দেবে।

এছাড়াও একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, কোন কিছু প্রমাণের তাগিদ এলে সাকিব আল হাসান যেন আরেকটু তেঁতে ওঠেন। আইপিএলের দ্বিতীয় পর্বে বেশিরভাগ ম্যাচই তিনি কাটিয়েছেন ডাগ-আউটে, কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছেন আপন আলোয় জ্বলে উঠেছেন। দুবাইয়ে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে যখন তাকে সুযোগ দেওয়া হল , ২০ রানের বিনিময়ে একটা উইকেট তো নিয়েছেনই, সাথে সানরাইজার্স অধিনায়ক উইলিয়ামসনকে রান-আউটে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছেন একটি দুর্দান্ত থ্রোয়ের মাধ্যমে, যেটা কিনা হায়দ্রাবাদকে ১১৫ রানে আটকে রাখতে সাহায্য করেছিল।

তবে, সাম্প্রতিক সব ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই ফরম্যাটে সাকিবের নিজেকে প্রমাণের আরো বাকি আছে। তিনি সবসময়ই তাঁর সময়ের সেরাদের একজন হয়েই থাকবেন, তবে সাকিবের লিগ্যাসি আরেকটু উপরে উঠবে যদি নভেম্বরের রাতে, ১৪ তারিখে বাংলাদেশ একটা ইতিহাস তৈরি করতে পারে।

– উইজডেন ইন্ডিয়া অবলম্বনে

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link