বাংলাদেশ এবার বিশ্বকাপ জিতবে— এমন ভবিষ্যদ্বাণীর পক্ষাবলম্বন-কারীর সংখ্যা মোটেই কম না। সংখ্যাটা অযুত, লক্ষ, নিযুত পেরিয়ে কোটিতে। কারণ দেশটা যে ১৭ কোটি মানুষের ভূখণ্ড।
হ্যাঁ। এমন একটা অভাবনীয় প্রত্যাশা পূরণেই চোখ সমগ্র বাংলাদেশির। তবে সীমানা পেরোলে বাংলাদেশিদের সেই স্বপ্ন কি ভিনদেশিদের কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নিতে পারছে? মানে, টাইগাররা যে বিশ্বকাপ জিততে পারে, তাদের কাছে এমন সম্ভাব্যতায় কি আদৌ অগ্রগণ্য হচ্ছে?
বিশ্বকাপের ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার গ্লেন ম্যাকগ্রার দৃষ্টিতে, এবারের বিশ্বকাপ শিরোপা যাচ্ছে ভারতের ঘরে। আর তাঁর চোখে সম্ভাব্য ৪ সেমিফাইনালিস্ট হিসেবে ভারতসহ আছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান।
ম্যাকগ্রার মতো একই ভবিষ্যদ্বাণী দক্ষিণ আফ্রিকার এ বি ডি ভিলিয়ার্সেরও। তবে সম্ভাব্য ৪ সেমিফাইনালিস্ট হিসেবে তিনি ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তানসহ রেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
অর্থাৎ, বৈশ্বিক কোনো কিংবদন্তিদের চোখেই সেরা চারের সম্ভাব্য দৌড়ে বাংলাদেশ নেই। অবশ্য সেটা আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিকই। বাংলাদেশ কোন বিশ্বকাপেই বা ফেবারিট হিসেবে খেলতে নেমেছিল? বরাবরই সমীহ জাগানিয়া দল হিসেবেই পরিচিতি টাইগারদের। সমীহ জাগানিয়া দল তো আরো অনেক আছে। তাই বলে সব দলকে তো আর গ্রেটরা সেরা চারের আসনে বসাবেন না। খুবই স্বাভাবিক।
তবে এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। বিশ্বকাপে ওঠার লড়াইয়ে ওয়ানডে সুপার লিগে কিন্তু এবার বাংলাদেশ ৩ নম্বরে থেকে শেষ করেছিল অর্থাৎ শেষ ২ বছরে খাতাকলমে বাংলাদেশ ওয়ানডের তৃতীয় সেরা দল। তবে শেষমেশ তা অনেকের কাছেই বিবেচনার বাইরে থেকে গিয়েছে।
বাংলাদেশ দল অবশ্য একটু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলেই নতুন একটা ইতিহাস গড়তে পারে। সেই যাত্রায় সাকিব আল হাসান হতে পারে কপিল দেব, অর্জুনা রানাতুঙ্গার উত্তরসূরি।
একটু ভেঙ্গে বলা যাক। তবে তার জন্য ফিরে যেতে হবে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে। সেবারে কপিল দেব নেতৃত্বধীন ভারতীয় দলটা ছিল অনেকটা ভঙ্গুর। আগের দুই বিশ্বকাপে ভারত কোনো জয়ের খাতাই খুলতে পারেনি। ব্যাপারটা এমন, বিশ্বকাপের স্কোয়াডে অংশ হয়ে বিলেতের মাটিতে ঘুরে আসাটাই ছিল সে সময়কার দলে সিংহভাগ সদস্যের লক্ষ্য।
কপিল দেব সেই লক্ষ্যটাকে এক লাফে নিয়ে গেলেন বিশ্বকাপ শিরোপার দিকে। কপিল দেবের অমন ভাবনায় প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল বাকি সদস্যরাও। ভিভ রিচার্ডস তখন ব্যাট হাতে প্রতাপ দেখাচ্ছেন।
আর বোলিংয়ে অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়াল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিংদের বোলিংয়ে কথা শুনলেই তখন ব্যাটারদের শরীর হিম হয়ে যায়। এমন একটা দলকে হারানো তো দূরে থাক, কোনো মতে বিনা রক্তপাতে ম্যাচ শেষ করাই তো দুরূহ ব্যাপার।
বিস্ময়ের ব্যাপারটা হলো, কপিল দেবের ঐ দলটা, মানে ঐ বিশ্বকাপের আগে বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ না জেতা দলটা সেবার শিরোপা জিতেছিল। আগের দুই বারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত।
এর পরের গল্পটা ১৯৯৬ বিশ্বকাপের। শ্রীলঙ্কা তখন সম্ভাবনাময় একটা দল হয়ে ওঠার পথে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবে, এমন ভাবনা হয়তো লঙ্কাবাসীরাও করেনি। কিন্তু এবারে স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন অর্জুনা রাণাতুঙ্গা। তিনি জানিয়ে দিলেন, শ্রীলঙ্কা এবারের বিশ্বকাপে শুধু খেলতে আসেনি, চ্যাম্পিয়ন হতে এসেছে।
হ্যাঁ। রাণাতুঙ্গার ঐ কথাটা ঔদ্ধত্যপূর্ণই ছিল। কিন্তু বিশ্বজয় করতে হলে আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিমাটা যে এমনই হতে হয়। শ্রীলঙ্কা পরবর্তীতে তাই-ই করে দেখিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সেবার পুরো বিশ্বকে বিস্ময়ে ভাসিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল শ্রীলঙ্কা।
২০২৩ বিশ্বকাপ দিয়ে বাংলাদেশ ৭ম বারের মতো এ আসরে অংশ নিচ্ছে। বিশ্বকাপ খেলার ২৪ বছরের ইতিহাসেও কি একটা দল বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্নে পা বাড়াতে পারে না? সেটা নিশ্চয়ই আর যাই হোক, বাড়াবাড়ি হবে না। অধিনায়ক সাকিবও ঠিক বাড়াবাড়ি করছেন না।
তিনি জানিয়েছেন, এবারই সুযোগ সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার। সেই দেখিয়ে দেওয়ার যাত্রাটা কতটা অভাবনীয় কিংবা বিস্ময়ে পূর্ণ থাকবে ল, তা সময়ই বলে দিবে। তবে বিশ্বকাপ শিরোপায় চোখ রাখাটা মোটেই অতিরঞ্জিত কোনো প্রত্যাশা নয়।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে, কে ভেবেছিল পাকিস্তানকে হারিয়ে দিবে বাংলাদেশ? সম্ভবত সেই সংখ্যাটা শূন্যের কোঠায়। ধরে নেওয়া যাক, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সেমিতে খেলবে কিংবা জিতবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণীর পক্ষে থাকা মানুষের সংখ্যাটাও শূন্য। এর অর্থই যে বাংলাদেশ এবার অর্জনশূন্য বিশ্বকাপ কাটাবে, তা নয়। বরং এবারই মোক্ষম সময়, সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার, একটা ইতিহাস গড়ার। বাংলাদেশ ক্রিকেটের আজন্ম এক স্বপ্নপূরণ হোক এবারই।