সাল ১৯৫০। ইংল্যান্ড সফরে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। এর আগে কখনোই ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জিততে পারেনি ক্যারিবিয়ানরা। সেই সাথে সবশেষ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে লজ্জাজনক ভরাডুবির পর ইংলিশদের বিপক্ষে জয়ের আশা করাটাও যেনো ছিলো আকাশ-কুসুম চিন্তা। কিন্তু সেই ভাবনাকে বাস্তবে রুপ দিয়ে ইতিহাস গড়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তবে কোনো পেস ব্যাটারি নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে স্বপ্নের এই ফল এনে দিয়েছিলেন দুই তরুন স্পিনার। সনি রামদিন ও আলফ ভ্যালেন্টাইন সেবার ইংল্যান্ডের মাটিতে পুরো ক্রিকেট বিশ্বের সামনেই জন্ম দিয়েছিলেন বিস্ময়ের!
প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচে উস্টারশায়ারের বিপক্ষে খেলা ভেস্তে যায় বৃষ্টিতে। পরের ম্যাচে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে তিন উইকেটের কষ্টার্জিত জয় পায় ক্যারিবীয়রা। এরপর সারের বিপক্ষে চতুর্থ উইকেটে ২৪৭ রানের জুটির পথে ৫ উইকেটে ৫৩৭ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায় ক্যারিবীয়রা। ওই ম্যাচে অল্পের জন্য পরাজয় এড়ায় সারে। এরপর ক্যামব্রিজ ভার্সিটির বিপক্ষেও দুর্দান্ত পারফর্ম করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তিনটি প্রস্তুতি ম্যাচেই অনবদ্য পারফর্ম করেন দুই তরুণ ক্যারিবিয়ান স্পিনার সনি রামদিন ও আলফ ভ্যালেন্টাইন। ইংলিশ কন্ডিশনে বেশ নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন এই দুই তরুন। অবশ্য ওই ইংলিশ সফরের আগে এই দুইজনের দলে ডাক পাওয়ায় অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। কারণ এর আগে এই দু’জনই খেলেছেন মোটে দু’টি করে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। দু’জনের জন্মদিনের ব্যবধানও ছিল মাত্র তিন দিনের! এমনকি ওই ট্যুরেই ছিল দুই তরুণের জন্মদিন।
২১ বছর বয়সী রামদিন ছিলেন ডান হাতি অফ ব্রেক এবং ভ্যালেন্টাইন বাঁ-হাতি স্লো বোলার। প্রথম টেস্টের আগে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে ১৩ উইকেট শিকার করে একাদশে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছিলেন ভ্যালেন্টাইন। সেই সাথে অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যে দেখিয়ে প্রথম টেস্টে ডাক পান রামদিনও।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রথম টেস্টে অভিষিক্ত হন এই দুই স্পিনার। প্রথম ইনিংসে আলফ ভ্যালেন্টাইনের ম্যাজিকেল বোলিংয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ের পরেও ট্রেভর বেলির ৮২ ও গডফ্রি ইভান্সের ১০৪ রানে ৩১২ রান করতে সমর্থ হয় ইংলিশরা। ভ্যালেন্টাইন একাই শিকার করেন ৮ উইকেট! বাকি দুই উইকেট নেন রামদিন।
তবে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ২১৫ রানেই গুড়িয়ে যায় সফরকারীরা! দ্বিতীয় ইনিংসেও ভ্যালেন্টাইন-রামদিন জুটির দুর্দান্ত বোলিংয়ে ২৮৮ রানের বেশি করতে পারেনি ইংল্যান্ড। তবে ৩৮৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৮৮ রানে অলআউট হলে প্রথম টেস্টে ২০২ রানের অসাধারণ জয় পায় ইংলিশরা।
অবশ্য এটা অনুমিতই ছিল ইংলিশদের সামনে কোনো ম্যাচেই পাত্তা পাবে না ক্যারিবীয়রা। তবে ভ্যালেন্টাইনের ১৩ ও রামদিনের ৪ উইকেট শিকার বিশেষভাবে সবার নজর কেড়েছিল ওই টেস্টে! কিন্তু কেউ হয়তো তখনো ভাবেনি এই দু’জনই বাকি টেস্টগুলো রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে ইংলিশদের সামনে!
পরের টেস্টেও তখন বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ইংলিশরা। অপরদিকে, তখনো ইংলিশদের মাটিতে একটি জয়ের স্বপ্নে বিভোর ক্যারিবীয়রা। লর্ডসে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে অ্যালান রয়ের সেঞ্চুরি ও ফ্র্যাঙ্ক ওরেল-এভারটন উইকসের জোড়া ফিফটিতে প্রথম ইনিংসে ৩২৬ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ভ্যালেন্টাইন ও রামদিনের সামনে মুখ থুঁবড়ে পড়ে ইংলিশদের ব্যাটিং শিবির! এই দুই স্পিনারের স্পিন বিষে মাত্র ১৫১ রানেই শেষ ইংলিশরা। ভ্যালেন্টাইন ৪ ও রামদিন শিকার করেন মেইডেন ফাইফর।
প্রথম ইনিংসে ১৭৫ রানে এগিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে ক্লাইড ওয়ালকটের অপরাজিত ১৬৮ ও গ্যারি গোমেজের ৭০ রানে ৬ উইকেটে ৪২৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ক্যারিবীয়রা। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংলিশদের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৬০১ রানের! মাত্র তখন তৃতীয় দিনের শেষ ভাগ চলছে! ভ্যালেন্টাইন আর রামদিনের স্পিন বিষ আর বিশাল লক্ষ্যমাত্রার সামনে প্রথমবার যেন জয়ের স্বপ্ন দেখছিল ক্যারিবিয়ানরা।
বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ভ্যালেন্টাইন-রামদিনের দাপটে ৫৭ রানেই নেই ২ উইকেট। এরপর কাইরিল ওয়াশব্রুকের সেঞ্চুরিতেও শেষ রক্ষা হয়নি ইংলিশদের। চতুর্থ দিনশেষে ৪ উইকেটে ২১৮ রান থাকলেও শেষদিনে রামদিন-ভ্যালেন্টাইন দাপটে মাত্র ২৭৪ রানেই শেষ হয় ইংলিশদের ইনিংস।
টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবার ইংলিশদের মাটিতে জয়ের দেখা পায় ক্যারিবীয়রা। রামদিন ৬ ও ভ্যালেন্টাইন শিকার করেন ৩ উইকেট! ৩২৬ রানের বিশাল জয়ের ঐতিহাসিক ওই ম্যাচে ১১৬ ওভারে ৭৫ মেইডেন দিয়ে ১২৭ রানে ৭ উইকেট নেন ভ্যালেন্টাইন। ভ্যালেন্টাইনের সেই ৭৫ ওভার মেইডেন দেওয়ার রেকর্ডটি আজও অক্ষত!
অপরদিকে, ১১৫ ওভারে ৭০ মেইডেন দিয়ে ১৫২ রানে ১১ উইকেট নেন রামদিন! এই দুই স্পিনারের বিষাক্ত বোলিংয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ইংলিশরা। এরপরই পাল্টে যায় সিরিজের চিত্র। এই দুই স্পিনারের সামনে সিরিজে আর কামব্যাক করার সুযোগই পায়নি ইংলিশরা।
শেষ দুই টেস্টেও দাপটের সাথে আধিপত্য বিস্তার করে জয়লাভ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৩-১ এ ইংলিশদের মাটিতে ঐতিহাসিক এক সিরিজ জিতে নেয় ক্যারিবীয়রা। তৃতীয় টেস্টে রামদিন ৭ ও ভ্যালেন্টাইনের ৫ উইকেট শিকারে ১০ উইকেটের জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং শেষ টেস্টে ভ্যালেন্টাইন ১০ ও রামদিনের ৪ উইকেট শিকারে ইনিংস ও ৫৬ রানে জিতে ক্যারিবীয়রা।
পুরো সিরিজে এই দুই অভিষিক্ত স্পিনার শিকার করেন ৬১ উইকেট! ৪ টেস্টে ইংলিশদের ৮০ উইকেটের ৬১টি উইকেটই নেন ভ্যালেন্টাইন ও রামদিন! এই ৬১ উইকেটের মাঝে ৩৫ ট নেন ভ্যালেন্টাইন ও ২৬ উইকেট শিকার করেন রামদিন! এই দুই স্পিনারের বিস্ময়কর পারফরম্যান্সে ইংল্যান্ডের মাটিতে ইতিহাস গড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
রামদিন আর ভ্যালেন্টাইনের এই পারফরম্যান্সকে আপনি কেবল ক্রিকেট দিয়ে বুঝতে পারবেন না। এই দুই ছোট্ট জাদুকর ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেলেন। তাদের নিয়ে ক্যালিপসো সুর বেজে উঠল। গান বাঁধা হলো-দোজ দু লিটল প্যালস অব মাইন।
ক্রিকেট তো যুগে যুগে কত রথী মহারথী খেলেছেন। কিন্তু এমন করে সুরে বাঁধা পড়েছেন ক’জন!