টিম ডেভিড পেইন তখনও অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। সেই সময়ের কথা বলছি।
তিনি যে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলের অধিনায়ক, সবুজ ব্লেজার ও ব্যাগি গ্রিন পরে টস করতে নামেন তা হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করে না, মানতে পারে না, মেনে নিতে চায় না। একজন টিম পেইন হওয়া কতটা ‘পেইনফুল’ তা টিম পেইন ভালোভাবেই জানেন। যদিও, তিনি নিজেই তাঁর জীবনটাকে আরো ‘পেইনফুল’ বানালেন কৃতকর্ম দিয়ে।
২০১০ সালে যখন ব্র্যাড হাডিনকে সরিয়ে টেস্ট দলে জায়গা করলেন লম্বা রেসের ঘোড়া ধরা হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, যদিও সেই বছর চার টি টেস্টে প্রায় ৩৬ গড়ে ২৮৭ রান করেছিলেন যা একজন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে খুব খারাপ নয়। কিন্তু না, দলে ফিরতে আর পারেননি।
২০১০ এর পর থেকে ২০১৭ – এই ৭ টা বছর অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। একটা সময় ক্রিকেট ছেড়ে দিতেও চেয়েছেন। এমন সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পেইনের ঘরোয়া দল তাসমানিয়ার কোচ, অভিভাবকসম অ্যাডাম গ্রিফিত। ভাগ্য ভালো অবসর নেননি।
২০১৭-১৮ মৌসুমের অ্যাশেজে ডাক পেলেন। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রায় ৫০ এর গড়ে ২০০ এর কাছাকাছি রান করলেন। পরের সেই কুখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও নিজের জায়গা করে নিলেন, আর বাকিটা ইতিহাস।
স্যান্ডগেট কেলেঙ্কারি যখন দেশের দুই সেরা ক্রিকেটার ডেভিড ওয়ার্নার ও তখনকার অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথের ক্যারিয়ার এক বছর কেটে নিল তখন অস্ট্রেলিয়ান দল সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল তা হল – দলের হাল ধরবে কে, যে কিনা দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব নিয়ে আবার বিশ্ব ক্রিকেটে দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনবে? কারণ পরবর্তীতে ওই দুজন আবার ফিরলেও দলের হাল ধরতে পারবেন না সহসাই।
দেশের বোর্ড, মানে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) তখন এক অভিনব সিদ্ধান্ত নিল। টিম পেইন হাল ধরলেন দেশের জাতীয় দলের। মনে আছে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বললেন, তাঁর লক্ষ্য হবে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের ভাবমূর্তি আনবেন। তখন অনেকেই হেসেছিলেন আড়ালে কিংবা প্রকাশ্যে, আমি নিজেও ছিলাম সেই দলে।
‘একটা ক্রিকেটার যার দলে থাকবার যোগ্যতা নেই সেই মানুষ অস্ট্রেলিয়া দলের হাল ধরবে!’ কিংবা ‘কোটার প্লেয়ার’ – এমন মন্তব্য অনেকেই করেছিলেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট সাহস দেখাতে পেরেছিল পেরেছিল, মাত্র ১২ টি টেস্ট খেলা এক ক্রিকেটারের হাতে নিজেদের দেশের মানসম্মানের ভার তুলে দিতে। পেইনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন সেইসময়। আর আমাদের মতো মানুষরা ভেবেছিল নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে এই সুযোগ হাত পেতে নিয়েছে।
না, রূপকথার মতো কিছু হয়নি। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সাত টেস্টে চার টি হার, জয় কেবলমাত্র একটিতে। এর মধ্যে ভারতের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ও ছিল। পেইনকে সরানোর দাবিও উঠেছে। তবে, এর পর থেকেই বদলে যাওয়ার শুরু, এর পর থেকেই অস্ট্রেলিয়া দলের জয়যাত্রা শুরু। এর মধ্যে ২০০১ সালে স্টিভ ওয়াহ’র পর প্রথম অধিনায়ক হিসেবে অ্যাশেজ শিরোপা ধরে রাখার কৃতিত্বও রয়েছে। আর শেষ এক বছরের বেশি অস্ট্রেলিয়া সব ম্যাচ জিতে বিশ্বের একনম্বর দল এবং টেস্ট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জেতবার প্রধান দাবিদার।
এতো কিছুর পরও কিন্তু তার নাম কখনো সামনে আসেনি। কখনো দলের ব্যাটসম্যানদের, কখনো দলের বোলারদের কৃতিত্ব দিয়েছি আমরা কিন্তু আমরা বারবার ভুলে গেছি দলের অধিনায়কের ভূমিকা। আর আমরাও তার কৃতিত্ব মেনে নেব কেন, তাকে তো আমরা সারাজীবন আন্ডাররেটেড হিসেবেই ভেবে এসেছি।
উইকেটরক্ষক হিসেবে সাফল্য পেয়েছেন, কিন্তু ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫৯ টি ইনিংসে মাত্র আটটি নয়টি সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটারকে নিয়ে কেই বা উচ্চবাচ্য করে। কিন্তু সংখ্যা বলছে গড় মধ্য ৩০-এর কাছাকাছি যা কোনোমতেই ফেলনা নয়। কয়েকমাস আগেই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অসাধারণ একটি হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন।
আর এই তো গতবছরই দলের দু:সময়ে ভারতের বিপক্ষে অ্যাডিলেডে টেলএন্ডারদের নিয়ে যে ইনিংসটা খেললেন তার গুরুত্ব যে কি ছিল তা আমাদের বলে দিতে হবে না, সঙ্গে আমাদের যেনো কড়কড়ে অনেকগুলো থাপ্পড়ও কষিয়ে দিলেন যা আমাদের সত্যিই প্রাপ্য ছিল। এই ইনিংস অনেক অনেক দিন মনের মনিকোঠায় আবদ্ধ থাকবে।
আর ওই ইনিংসটাই এনে দিল তার টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ সেরার পুরস্কার। ওয়ানডেতে একবার পেলেও টেস্টে এই পুরস্কার তাঁর জন্য অধরাই ছিল। আহ! কি প্রশান্তি! কিন্তু, তিনি বরাবরের মতো শান্ত।
ম্যাচের শেষে সমস্ত কৃতিত্ব বোলারদের দিলেন, অবশ্যই বোলারদের কৃতিত্ব। তার ব্যাটিং না হয় বাদই দিলাম কিন্তু তার অধিনায়কত্ব, উইকেটের পিছনে বিশ্বস্ত হাত, দলকে ভরসা জোগানো সবসময় এইসব আমরা অস্বীকার করবো কি করে। আজও কি তিনি আন্ডাররেটেড হিসেবেই আমাদের কাছে মান্য হবেন।
তিনি অবশ্য এসব নিয়ে ভাবেন সামান্যই। থাকেন নিজের মত, অন্যদের মত সব কিছুতে উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ফায়দা কি! নি:সন্দেহে বলা যায় তিনি ভবিষ্যতেও এমনই থাকবেন। হয়তো কোনোদিন যদি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা হাতে নেন, সেদিনও থাকবেন নির্বিকার।
কারণ, তিনি জানেন ক্রিকেট ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের খেলা নয় – এখানে খেলতে হয় দল হয়। আর সেই দলকে যথাযথ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন একজন দক্ষ নেতার। আর সেই নেতাটিকে অস্ট্রেলিয়া খুঁজে পেয়েছিল টিম পেইনের মাঝে। সে কারণেই কি না, খুবই ন্যাক্কারজনক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হওয়ার পরও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) বেশ ছাড়ই দিল তাঁকে।
তিনি হয়তো বড় কোনো পরিসংখ্যান নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করার সুযোগ পাবেন না। তবে, অস্ট্রেলিয়া তাকে মনে রাখতে বাধ্য। শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, পুরো ক্রিকেট বিশ্ব তাঁকে মনে রাখবে দু:সময়ের দু:সাহসী এক নাবিক হিসেবে – কিংবা খলনায়ক হিসেবে।