ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেখানে অন্য যেকোনো খেলার চেয়ে অধিনায়কের ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। দলের প্রয়োজনে অনেক সময় মাঠে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অধিনায়ককে। ফলে, অন্য সব খেলার চেয়ে ক্রিকেটে অধিনায়কের ভূমিকা রাখার সুযোগ বেশি।
অধিনায়ক সাধারণত কোচের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করেন না। কিন্তু এর বাইরেও অনেক সময় অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নেন। মাঠে কি ধরনের একাদশ নামবে সেই বিষয়েও সিদ্ধান্ত থাকে অধিনায়কের। কিংবা কোনো টুর্নামেন্ট বা সিরিজে দল কি রকম হবে এই বিষয়েও অধিনায়কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এছাড়াও ঘরের মাঠে হওয়া কোনো সিরিজে উইকেট কি রকম হবে সেখানেও সিদ্ধান্ত দেন অধিনায়ক। এতেই বোঝা যায় ক্রিকেট মাঠে অধিনায়কের ভূমিকা কত বেশি।
একজন অধিনায়ক কেমন? – ক্রিকেটে তাঁর মাপকাঠি অবশ্যই জয় ও পরাজয়। জয়ের পাল্লা ভারি হওয়ায় অনেকেই লম্বা সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। ম্যাচের সংখ্যায় দীর্ঘ সময় দলকে নেতৃত্ব দেওয়াদের নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন।
- মহেন্দ্র সিং ধোনি (ভারত)
বিশ্বের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন ভারতীয় দলকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল অধিনায়কদের মধ্যে অন্যতম তিনি। বিশ্বের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির সকল টুর্নামেন্ট জয়ের রেকর্ড আছে তাঁর।
মহেন্দ্র সিং ধোনি ভারতকে তিন সংস্করণে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোট ৩৩২ ম্যাচ। এর মধ্যে ভারতীয় দলকে জয় এনে দিয়েছেন ১৭৮ ম্যাচে। আর হেরেছেন ১২০ ম্যাচ। অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যের হার ৫৩.৬১ শতাংশ। এছাড়াও জয়-পরাজয়ের অনুপাত ১.৪৮।
- রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক রিকি পন্টিং। তিনি অস্ট্রেলিয়াকে টানা দুইবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ এনে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে সম্ভবত একটি আফসোস থেকেই যাবে রিকি পন্টিংয়ের। অধিনায়ক হিসেবে ভারতের মাটিতে যে কখনো টেস্ট সিরিজ জেতা হয় নি অধিনায়ক পন্টিংয়ের।
রিকি পন্টিং ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলে অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্ব একাদশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোট ৩২৪ ম্যাচে। এর মধ্যে দলকে জয় এনে দিয়েছেন ২২০ ম্যাচে। আর হারের পরিমাণ মাত্র ৭০। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে ৬৭.৯০ শতাংশ ম্যাচ জিতেছেন তিনি। এছাড়াও তাঁর অধিনায়কত্বের দলের জয়-পরাজয়ের অনুপাত ২.৮৫।
- স্টিফেন ফ্লেমিং (নিউজিল্যান্ড)
ব্যাটসম্যান হিসেবে যতটা বিখ্যাত ছিলেন স্টিফেন ফ্লেমিং, তাঁর চেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিলেন অধিনায়ক হিসেবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর থেকে আরো অনেক ভালো অধিনায়ক আছে সেটা তর্ক সাপেক্ষে মেনে নেওয়া যায়। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে দলকে সামর্থ্য এনে দেওয়া অধিনায়ক হলেন স্টিফেন ফ্লেমিং। ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’-এর আদর্শ উদাহরণ তিনি।
তিনি নিউজিল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৩০৩ ম্যাচে। এর মধ্য জয়ের থেকে পরাজয়ের পরিমাণই বেশি। দলকে জয় এনে দিয়েছেন ১২৮ ম্যাচে আর হার দেখেছেন ১৩৫ ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে ৪২.৪৪ শতাংশ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড আছে তাঁর। এছাড়াও জয়-পরাজয়ের অনুপাত ০.৯৪।
- গ্রায়েম স্মিথ (দক্ষিণ আফ্রিকা)
একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে ১০০ এর বেশি টেস্টে নেতৃত্ব দেবার রেকর্ড আছে গ্রায়েম স্মিথের। তিনি যখন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের দায়িত্ব নেন তখন তিনি ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী টেস্ট অধিনায়ক। অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়ের রেকর্ডও তাঁর দখলে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২৮৬ ম্যাচে। এর মধ্যে দলকে জয় এনে দিয়েছেন ১৬৩ ম্যাচে। অধিনায়ক হিসেবে তাঁর সফলতার হার ৫৬.৯৯ এবং জয়-পরাজয়ের অনুপাত ১.৮৩।
- অ্যালান বোর্ডার (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সফল অধিনায়ক হলেন অ্যালান বোর্ডার। তিনি অস্ট্রেলিয়া দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। তাঁর অধীনেই প্রথম বারের মত, বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়া দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২৭১ ম্যাচে। এই সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া দলকে এনে দেন ১৩৯ টি জয়। অ্যালান বোর্ডারের অধীনে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের হার ৫১.২৯ শতাংশ এবং জয়-পরাজয়ের অনুপাত ১.৫৬।
- অর্জুনা রানাতুঙ্গা (শ্রীলঙ্কা)
সাফল্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে শ্রীলঙ্কাকে খুব বেশি সংখ্যক ম্যাচ জেতাতে পারেননি তিনি। তবে আন্ডারডগ হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতিয়েছেন তিনি। এছাড়াও মুরালিধরনের বোলিং অ্যাকশনের প্রতিবাদ করে পুরো দলকে নিয়েও মাঠ ছেড়ে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন রানাতুঙ্গা।
রানাতুঙ্গার অধীনে শ্রীলঙ্কা দল খেলেছিল ২৪৯ টি ম্যাচ। এর মধ্যে দলকে সাফল্য এনে দিতে পেরেছেন মাত্র ১০১ ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অধীনে শ্রীলঙ্কার জয়ের পরিমাণ ৪০.৫৬ শতাংশ। এছাড়াও জয়-পরাজয়ের অনুপাত ০.৮৮।
- মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন (ভারত)
মোহাম্মদ আজহার উদ্দিন, ভারতের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। কিন্তু ফিক্সিং কেলেঙ্কারির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থেকে অকালেই বিদায় নিতে হয় তাঁকে। তবুও তাঁর অধিনায়কত্বের প্রশংসা করতেই হয়।
ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২২১ ম্যাচে। এর মধ্যে দলকে সাফল্য এনে দিয়েছেন ১০৪ ম্যাচে। সাফল্যের হার খুব বেশি না, তবুও বেশ আলোচিত ছিলেন তিনি। তাঁর অধিনায়কত্বে ভারতের সাফল্যের হার ছিল ৪৭.০৫ শতাংশ এবং জয়-পরাজয়ের অনুপাত ছিল ১.১৫।
- বিরাট কোহলি (ভারত)
ভারতের বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতকে বড় কোনো শিরোপা এনে দিতে পারেননি তিনি। তবুও তাঁর আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্বের উপর ভরসা রেখেছে ভারতীয় দল।
বিরাট কোহলি ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০ ম্যাচ। তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় দল জয় পেয়েছে ১২৮ ম্যাচে এবং পরাজয় ৫৫ টি ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অধীনে ভারতীয় দল জয় পেয়েছে ৬৪ শতাংশ ম্যাচে। এছাড়াও জয়-পরাজয়ের অনুপাত ২.৩২।
- সৌরভ গাঙ্গুলি (ভারত)
ভারতীয় ক্রিকেটে সেরা অধিনায়ক কে, এই নিয়ে তর্ক শুরু করলে সেটা কখনো শেষ হবে না। পরিসংখ্যান বলে মহেন্দ্র সিং ধোনি সেরা অধিনায়ক কিন্তু এই ধোনির এই সাফল্যের মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলি।
সৌরভ গাঙ্গুলির অধিনায়কত্বে ভারত দেশের বাইরে নিয়মিত ম্যাচ জেতা শুরু করে। তাঁর হাত ধরেই বিদেশের মাঠে বিড়াল এই ডাক নাম ঘোচাতে শুরু করে ভারত দল। এছাড়াও জাতীয় দলে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সব তরুণ ক্রিকেটারদের। যাদের সাফল্যে ভর করে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয় করে ভারত।
সৌরভ গাঙ্গুলি ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯৬ ম্যাচে। এর মধ্যে দলকে জয় এনে দিয়েছে ৯৭ ম্যাচে। তাঁরা নেতৃত্বে ভারতীয় দলের সাফল্যের হার ৪৯.৪৮ শতাংশ। আর জয়-পরাজয়ের অনুপাত ১.২২।
- হ্যান্সি ক্রনিয়ে (দক্ষিণ আফ্রিকা)
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ছিলেন হ্যান্সি ক্রনিয়ে। অধিনায়ক হিসেবে যতটা আলোচিত ছিলেন, পরবর্তীতে তাঁর চেয়েও বেশি সমালোচিত হন। ফিক্সিং-এ জড়িত হয়ে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হন তিনি। এর পর ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাসে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯১ ম্যাচে। এর মধ্যে তিনি দলকে জয় এনে দিয়েছেন ১২৬ ম্যাচে। তাঁর অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকার সাফল্যের হার ৬৫.৯৬ এবং জয়-পরাজয়ের অনুপাত ২.৭৩।