ওগো দুখজাগানিয়া, তোমায় গান শোনাব

সূদুর সাইবেরিয়া থেকে সাদা পাখির ঝাঁক উড়ে আসে। ঘুম ভাঙে শীতের শহরের। একটু একটু করে প্রবাসী রোদ ছুঁয়ে যায় সেই পাখিদের ডানা। আমরা অবাক হয়ে দেখি। সেই মসৃণ ডানায় চেপে কেটে যায় এ শহরের শীতকালগুলো।

ওরা চলে যায়। আমরা জানতে চাই না কত পথ উড়ে আসে সে একটু উষ্ণতার খোঁজে। আমরা জানতে পারি না কত সন্তান তার হারিয়ে যায় এ দীর্ঘ পথে। কত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সে প্রতিদিন মেলে দেয় ডানা-আকাশের বুকে পাখিদের স্বরলিপি লিখে হারিয়ে যায় নিজের দেশে, নিজের মায়ের কাছে।

উইনিং স্ট্রোকটা মারার পর উত্তাল গ্যালারি। উচ্ছ্বসিত হাজার হাজার সমর্থক। সকলের আলিঙ্গনের ছোঁয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁকে। তবু যেন কোথাও মলিন হাসি। আলতো করে ননস্ট্রাইকিং এন্ড থেকে উইকেট দুটো তুলে নিয়ে ডাগআউটের দিকে হাঁটলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় – এ বিশ্ব আজ দেখছে ক্রিকেট ঈশ্বরের পরম যত্নে বানানো এক প্রতিভাকে।

কিন্তু দেখতে পায়নি এতগুলো বছর ধরে একটু একটু করে সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠার লড়াইটা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে মসৃণ চাকু হয়ে ওঠা সাকিব নিজের অস্ত্রে শান দিয়েছেন বছরের পর বছর। সারাবিশ্বের আড়ালে গোকুলে বেড়ে উঠেছেন, তাই শাণিত চাকুর ধার আর শীতল স্পর্শ দুই নিয়ে আজ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে৷

বাংলাদেশ ক্রিকেটের আজ স্বর্ণযুগ। কিন্তু এমনটা তো ছিল না, দিনের পর দিন টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে গিয়েও পরদিন সকালে নেটে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন মুশফিকুর রহিম। সকলে হাল ছেড়ে দিলেও দিনের পর দিন আইপিএল খেলে সারাবছর নিজেকে আন্তর্জাতিক স্ত্বরের ফিটনেসে রেখে বোলিংকে ধারালো করতে পেরেছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের দূর্বলতা যে অনভিজ্ঞতা সেটা বুঝতে পেরেই নিজেকে লম্বা ইনিংস খেলার জন্য ভেতরে ভেতরে তৈরী করতে পেরেছেন তিনি। তাই যখন বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে ডাক এল তিন নম্বরে ব্যাটিং-এর তখন সে নিজের চওড়া কাঁধে তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দেবার যাদুদণ্ড।

এক দক্ষ ম্যাজিশিয়ান যেমন জানেন আগুনের ভেতর থেকে অক্ষত শরীরে তিনি ফিরে আসতে পারবেন দর্শকদের মাঝে, সাকিব জানতেন এই সুযোগে তিনি বদলে দিতে পারবেন ক্রিকেট নিয়ে বেঁচে থাকা একটা আপামর জাতির ইতিহাস। ইংল্যান্ডের উইকেট- বিপক্ষের কঠিন বোলিং সবকিছুকে তিনি সামলে নিতে পারবেন যার ছায়ায় বেড়ে উঠবে লিটন, সৌম্যর মতো বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরের প্রজন্ম, ঠিক যেভাবে সাইবেরিয়ান পাখি এতটা পথ আগলে নিয়ে আসে তাঁর সন্তানকে

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডারের খেতাব, বিশ্বকাপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রান সংগ্রাহক – তবু যেন সাকিব বড় শান্ত। বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের স্বভাবসিদ্ধ আগ্রাসনের থেকে বহু বহু দূরে বসে সাকিব যেন এক ক্রিকেট দার্শনিক যার অসমাপ্ত কাজগুলো গোলাপ হয়ে ফুটেছে ব্রিটিশ উদ্যানে।

সাকিব জানেন তাঁর দেশের মাটি তাকে উদ্ধত হতে শেখায় নি। তাঁর জাতীয় সংগীতের স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে আছে তাঁর সমস্ত শরীর। বাংলাদেশের মায়ের সমস্ত কলঙ্ক মুছে দিতে ব্রিটিশ মুল্লুকে তিনি এসেছেন মেঠো বাঁশিওয়ালা হয়ে। যার সুরে যাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে গোটা বিশ্ব। সে সুরের কোথাও আস্ফালন নেই, আগ্রাসন নেই। রয়েছে মাটির সেতার।

পাখি নীড়ে ফিরে আসে, তবু রাতের শেষ আলো জ্বেলে জেগে থাকেন সাকিব। বাংলার মাটির শীতল স্পর্শ বুকে নিয়ে প্রথমবার কেউ বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলার আদি ঐতিহ্য। নিজের বুকের সমস্ত ব্যথা যন্ত্রণার ওপর মিষ্টি হাসি দিয়ে সোনার বাংলা বশ করে নিচ্ছে উদ্ধত ব্রিটিশদের। চড়া অর্কেস্ট্রার পাশে ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে মাটির সেতার। ক্রিকেট বৃত্তের বাইরে গিয়ে যে সাকিবের জিতে যাওয়া ঠিক এইখানেই, লুকোনো মাটির টানে এখানেই তাঁর হয়ে ওঠা ‘দুখজাগানিয়া’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link