প্রত্যাবর্তনের অবিসংবাদিত নায়ক!

কাইল মেয়ার্স যেভাবে বাংলাদেশের স্পিনত্রয় সামলেছেন, পুরো দিন ব্যাট করেছেন আর দলকে জিতিয়ে ফিরেছেন তাতে একটি কথা আপনার মনে হতেই পারে মেয়ার্স স্পিনটা বেশ ভালই খেলেন।

ঘরোয়া ক্রিকেটে মেয়ার্সের স্পিনের বিপক্ষে বেশ ভাল রেকর্ড আছে। কিন্তু আপনি যদি তাঁর ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (সিপিএল) পারফরম্যান্সের দিকে তাকান তাহলে গল্পটা আরো ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের মত জমে উঠবে, হয়ে উঠবে কিছুটা আয়নার অপর প্রান্তের আপনির মতই রহস্যময়!

২০২০ এর মৌসুমটারা কথাই যদি ধরি, মেয়ার্সের স্পিনের বিপক্ষে সময়টা গেছে বিভীষিকার মতো। ৮৪ বল মোকাবেলা করে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন ৫ বার। শুধু তাই না, চট্টগ্রামে মহাকাব্য লেখার আগে স্পিনে বিপক্ষে তাঁর আচরণ নেহায়েৎ ছোটগল্প লেখার মতও ছিল না। এই ইনিংসের আগে তিনি অফ স্পিনার মিরাজের বলেই ওয়ানডে সিরিজে দুইবার আউট হয়েছেন। আর চট্টগ্রামের টেস্টটার প্রথম ইনিংসেও প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন মিরাজের স্পিন খেলতে না পেরেই।

তাই মেয়ার্সের এই রাতারাতি বদলে যাওয়ার একটাই ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়- তিনি মানসিকভাবে স্পিনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এমনিতে বাংলাদেশী বোলাররা বেশ কিছু লুজ ডেলিভারি করেছেন, মেয়ার্স সেগুলোরই ফায়দা তুলেছেন, বাজে বলে ব্যাট চালিয়েছেন।

এবার মেয়ার্সের ঘরোয়া ক্রিকেটের অলিগলি থেকে একটু ঢুঁ মেরে আসা যাক। নভেম্বর,২০১৫- মেয়ার্স তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে প্রথমবার খেলতে নামেন সেদিন। কিন্তু ২০১৯-২০ মৌসুমের আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে বলার মত ব্যাটিং তিনি কখনই করতে পারেননি। এ মৌসুমেই তিনি ৫০.৩০ গড়ে ৬৫৪ রান করে নির্বাচকদের নজর কাড়তে সমর্থ হন। সে মৌসুমে দুটি সেঞ্চুরিও করেন তিনি। আবার এই মৌসুমেই নিজের লিস্ট-এ ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি পান তিনি। কিন্তু তারপরও মেয়ার্স নির্বাচকদের রাডারে ছিলেন না!

পড়বেন নাকি?

মেয়ার্সের মানসিক শক্তি অনেক বেশি, যেটা আমরা একটু আগেই বলেছি। এমন কি কিছু ঘটেছিল যেটা মেয়ার্সকে মানসিকভাবে শক্ত করেছে?

উত্তর হল, হ্যা! সে ঘটনা অবশ্য এখন থেকে তিন বছর আগের। উইনওয়ার্ড আইল্যান্ড ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে খেলার সময় তিনি গেছিলেন ডমিনিকাতে, ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিতে।  সেসময় তিনি হ্যারিকেন মারিয়ার কবলে পড়েন। ডমিনিকাতে তিনি আর একজন কিছু সতীর্থ যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন সেটার ছাদ ভেঙে পড়েছিল। কোনরকমে অবশ্য মেয়ার্স নিজেকে দুর্ঘটনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। তবে এরপর তিনি প্রচন্ড খাদ্য আর পানিসংকটে পড়ে যান। কেননা হ্যারিকেনের জন্যে ডমিনিকাতে প্রবল বন্যাও হয়েছিল।

মেয়ার্সকে সেসময় সাহায্য করে সেখানকার লোকাল পুলিশ আর দলের কিছু কর্তাব্যাক্তিরা। ডমিনিকাতে তখন প্রবল দুর্যোগ চলছে, বার্বাডোজে থাকা মেয়ার্সের বাবা-মাও  ছেলের চিন্তায় কাহিল হয়ে যাচ্ছিলেন। অবশ্য একটা সময়ে মেয়ার্স তাদের ফোন দিয়ে নিশ্চিন্ত করতে সমর্থ হন। এখন এরকমটা হতে পারে, এই হ্যারিকেন মারিয়া তাকে মানসিকভাবে কিছুটা শক্ত করতে পেরেছিল।

তবে মেয়ার্সের উইন্ডিজ দলে আসাটাও কম রোমাঞ্চকর নয়।

লম্বা গল্প, তবে ক্লাইম্যাক্সটা সেই ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগের ২০২০ এর আসরই! এক হাফ-সেঞ্চুরিতে তিনি সে আসরে করেন ২২২ রান। তবে স্পিন নয়, তাকে নিয়ে আলোচনাই হচ্ছিল তিনি যেভাবে পুরো আসরে পেসারদের মোকাবেলা করেছেন সেটা নিয়ে। তবে সিপিএলের এই সুখস্মৃতির আগে দুঃখগাঁথাও আছে মেয়ারের। ২০১৮ এর আসরে তিনি সিপিএলেও দল পাননি, খেলতে হয়েছিল নরওয়ে প্রিমিয়ার লীগের দল ভলকানোর হয়ে। ২০১৮ থেকে ২০২০- প্রত্যাবর্তনের গল্প যে তিনি শুধু চট্টগ্রাম টেস্টেই নয়, নিজের জীবনেও লিখেছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছেন!

এরপর উইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফরে গেলে সেখানে তিনি রিজার্ভ প্লেয়ার হিসেবে দলে সুযোগ পান এবং গোটা সবগুলো অনুশীলন ম্যাচই খেলেন। তবে আন্তর্জাতিক অভিষেকটা মেয়ার্সের হয়েছে নিউজিল্যান্ডের সাথে, টি-টোয়েন্টিতে। কিন্তু দুঃখজনক হল, মাউন্ট মঙ্গানুইতে তিনি দলে কোন অবদানই রাখতে পারেননি!

এমনকি, নিউজিল্যান্ডের ‘এ’ দলের সাথে দুটো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেও দুই ইনিংস মিলিয়ে মেয়ার্সের রান ছিল মাত্র ৩০! ফলে যেটা হল, মেয়ার্সকে আর খুব বেশি গোণায় ধরতে চায়নি উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু, ‘ব্লেসিং ইন ডিজগাস্ট’ এর মত মেয়ার্সও আশীর্বাদপ্রাপ্ত হন যখন উইন্ডিজের প্রথম সারির খেলোয়াড়েরা খোঁড়া অজুহাতে বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইল না। আর এখানেই ওয়ানডে আর টেস্টে অভিষেক ঘটে গেল মেয়ার্সের!

কিন্তু, এই কবছরে এই দৈন্যদশা হলেও মেয়ার্সের কিন্তু ক্যারিয়ারের  শুরু থেকেই প্রতিভার কমতি ছিল না। মেয়ার্সের বেড়ে ওঠা বার্বাডোজে। সেই বার্বাডোজেরই ক্রিকেটার কার্লোস ব্রাথওয়েট ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে বলেছেন, বার্বাডোজের সাড়া জাগানো তরুণ ক্রিকেটারদের একজন ছিলেন মেয়ার্স। ২০০৮ সালেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনূর্ধ্ব-১৫ দলে জায়গা করে নেন, খেলেন পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, আমেরিকা আর বাংলাদেশের সাথে। এখন উইন্ডিজের টেস্ট স্কোয়াডে যে ক্রেইগ ব্রাথওয়েট, জন ক্যাম্পবেল আর ক্যাভেম হজকে দেখি এরা সেসময় মেয়ার্সের সতীর্থই ছিল। মেয়ার্স অবশ্য লিটন দাসকেও মনে করতে পারেন, অনূর্ধ্ব-১৫ তে লিটন তখন বাংলাদেশ দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান! ২০১০ এ মেয়ার্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও ছিলেন।

এখন প্রশ্ন হল, মেয়ার্স তো সুযোগই পেয়েছেন বড় নামের অনুপস্থিতিতে। এই নামগুলো দলে ফিরলে মেয়ার্স কি একাদশে থাকবেন? সত্যি বলতে, চট্টগ্রামে তিনি যা করেছেন এরপর তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া খুব মুশকিলের ব্যাপার। পাঁচ নম্বরে নেমে তিনি এমন কন্ডিশনে সাবলীল ব্যাট করেছেন যেখানে স্বাগতিক ব্যাটসম্যানেরাও রান করতে হিমশিম খাচ্ছিল। আশা করা যাচ্ছে, মেয়ার্স অন্তত এর পরের কিছু সিরিজে দলে জায়গা পাবেন। কিন্তু মেয়ার্সকে মনে রাখতে হবে, ক্রিকেটের চিরন্তনন আপ্তবাক্যটি- ‘সেই দলে থাকবে যে পারফর্ম করবে’।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link