মুস্তাফিজ ধাঁধার বিবর্তন

২০১৫ এর দিকে মুস্তাফিজ ছিলেন পুরোদস্তুর ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিকের বোলার। কিন্তু ২০১৮ তে তাঁর অ্যাকশনে পরিবর্তন এনে তাকে যে 'প্যারালাল ওয়ান' করে দেওয়া হল এমনটা বলব না। এমনটা আসলে সম্ভবও না। কিন্তু ঐ যে  হাত ভাঁজ করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল, এতে ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিকের মত করে পুরো সার্কেল তিনি তৈরি করতে পারেননি।

মুস্তাফিজ আবারও নতুন করে ফিরেছেন এটা তো পুরানো খবর।

বোলিংয়ে তিনি যোগ করেছেন সুইংয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়া বল, যেটা চামিন্দা ভাসের মত বোলারকেও শক্তিশালী করেছিল। কিন্তু আজকে আমরা মুস্তাফিজের এই পরিবর্তনকে আরেকটু কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করব।

মুস্তাফিজের পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে হলে প্রথমেই মুস্তাফিজের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কথা বলতে হবে। ২০১৫ এর দুর্দান্ত শুরুর পর ইনজুরিতে পড়ে যাওয়ায় কোচ কোর্টনি ওয়ালশের অধীনে নিজের অ্যাকশনে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন মুস্তাফিজ। সেই অ্যাকশনেই বেশ দীর্ঘদিন খেলতে দেখা গেছে তাকে। কিন্তু ওটিস গিবসনের অধীনে আবারও নিজের অ্যাকশন পাল্টে ফেলেছেন তিনি, মোটামুটি আগের ঘরানাতে ফিরে গেছেন মুস্তাফিজ।

তুলনার জন্যে নিচে তিন সময়কার বোলিং অ্যাকশনের ছবি যুক্ত করে দেওয়া হলো:

২০১৫-এ মুস্তাফিজ                         ২০১৮-এ মুস্তাফিজ                        ২০২১-এ মুস্তাফিজ

এই ছবিটি মূলত তিন সময়ে তিন কোচের অধীনে মুস্তাফিজের বোলিং অ্যাকশন। কারিগরি ত্রুটিকে সর্বনিম্ন রাখার চেষ্টা করে ছবিগুলি নেওয়া হয়েছে বল ছোঁড়ার আগ মূহুর্তে। পুরো চিত্র দেখতে হলে আপনারা ইউটিউবের সাহায্যও নিতে পারেন। যা হোক এই তিন বোলিং অ্যাকশনে কী পাওয়া গেলো সেটা একটু বলি এবার।

২০১৫: বল করার আগে তিনি একটা ছোটখাটো লাফ দিতেন। লাফ দেওয়ার কিন্তু একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। এটা জড়তাকে ব্যাবহার করে বলের গতিকে কিছুটা বাড়াতে সাহায্য করে, অবশ্যই আহামরি কিছু নয়। তবে বলের গতিকে বাড়াতে হলেও নিয়ন্ত্রণকে একটু কমিয়ে দেয় এটি। যা হোক, এখানে বল ছোঁড়ার মূহুর্তে মুস্তাফিজের শরীর ছিল ব্যাটসম্যানের সাথে ফ্রন্ট লাইনে।

২০১৮: এখানেও তিনি বল ছোঁড়ার আগে ছোটখাট একটা লাফ দিতেন। কিন্তু সে মুহুর্তে এবার আর তাঁর শরীর ‘ফ্রন্ট লাইন’ এ ছিল না। তিনি হাতকে ভাঁজ করে কিছুটা পিছে নিয়ে যেতেন, অনেকটা কাঁধের কাছাকাছি। সামনের হাতটাও ভাঁজ হয়ে ভেতরের দিকে চলে আসত, ২০১৫ তে যেটা একটু সামনাসামনি উপরে থাকত। শরীরটাও তাই একটু  ঘুরে যেত। এতে বোলিং টেকনিকেও কিছুটা ভিন্নতা চলে আসত। সেটা একটু পরে ব্যাখ্যা করছি।

২০২১:  এখানে মুস্তাফিজ আবারও ২০১৫ এ ফিরে গেছেন খানিকটা। বল ছোঁড়ার সময় আবারও তাঁর শরীর ‘ফ্রন্ট লাইন’-এ থাকছে পুরোপুরি। হাতও ভাঁজ হয়ে কাঁধের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে না। সামনের হাতটাও ভাঁজ হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ছে না। কিন্তু এখানে ২০১৫ এর অ্যাকশনের সাথে যে ব্যাপারে একটু ভিন্নতা দেখা যায় তা হল তিনি এখানে লাফ দিচ্ছেন না। এই লাফ না দেওয়াতে অবশ্য একটা ব্যাপার হয়েছে-তাঁর বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে।

একটু আগে টেকনিক ব্যাখ্যা করার কথা বলছিলাম। ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের বল ছোঁড়ার ‘টেকনিক’ দুই রকম-

  • প্যারালাল ওয়ান টেকনিক
  • ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিক

মুস্তাফিজের এই টেকনিকের বিবর্তন ব্যাখ্যা করার আগে এই দুই টেকনিক সম্বন্ধে জেনে আসা যাক-

  • প্যারালাল ওয়ান টেকনিক

প্যারালাল ওয়ান টেকনিকের প্রচুর উদাহরণ পেতে আমাদের ঘুরে আসতে হবে আশির দশকেরও আগের জোয়েল গার্নারদের সময়ে। হাতের কাছে বড় উদাহরণ সাবেক উইন্ডিজ পেসার ফিদেল এডওয়ার্ডস। প্যারালাল ওয়ান টেকনিকে ‘হিপস’ এবং ‘শোল্ডার’ একই সমান্তরালে থাকে। বোলার যখন পা সামনে ফেলেন তখন সেই পায়ের হাঁটুসন্ধিতে ঐটুকু সময়ের জন্যে তাঁর দেহের ৫ গুণ বেশি ওজন ক্রিয়া করে। এতে নিচের অংশ যখন ভারী হয়ে যায় তখন গতি জড়তায় থাকা দেহের প্রায় বেশিরভাগ গতি কাজ করে উপরের অংশে, যে গতির জোরে পেস বোলাররা ভীষণ জোরে বল করে ফেলেন।

  • ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিক

ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিক বুঝতে আমাদের তাকাতে হবে ব্রেট লির দিকে। এই টেকনিকে ফ্রন্ট ফুটই পেস বোলারের মূল সম্বল বা ‘ফোর্স পয়েন্ট’। ‘প্যারালাল ওয়ান’ টেকনিকে ওজন পায়ের হাঁটুসন্ধিতে ক্রিয়া করলেও ‘ফ্রন্ট ওয়ান’ টেকনিকে ওজন কাজ করে গোড়ালি বরাবর। গতি জড়তায় থাকার পরও রানআপ এর ঠিক শেষ মুহুর্তে বোলার নিজের হাতকেই ভিন্নভাবে গতি জড়তায় নিয়ে আসেন।বোলার হাত সামনে থেকে এনে আরেকটি সার্কেল তৈরি করেন। ওজন গোড়ালীতে থাকার দরুণ এই সার্কেল তৈরিতে ওজন কোন প্রভাব ফেলে না। এবং হাত মাথার উপরে এনে পুরো একটি রোটেশন (আবর্তন) হওয়ার আগেই বোলার বল ছুড়ে দেন। শাই করে বল ব্যাটসম্যানের দিকে ছুটে যায়!

২০১৫ এর দিকে মুস্তাফিজ ছিলেন পুরোদস্তুর ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিকের বোলার। কিন্তু ২০১৮ তে তাঁর অ্যাকশনে পরিবর্তন এনে তাকে যে ‘প্যারালাল ওয়ান’ করে দেওয়া হল এমনটা বলব না। এমনটা আসলে সম্ভবও না। কিন্তু ঐ যে  হাত ভাঁজ করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল, এতে ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিকের মত করে পুরো সার্কেল তিনি তৈরি করতে পারেননি। তাঁর বোলিং টেকনিকই তাই শুরুর সময় থেকে সরে গেছিল। মুস্তাফিজের টেকনিকে এই যে পরিবর্তন আনা খুব সম্ভবত কাল হয়েছিল তাঁর জন্যে।

কিন্তু ২০২১ এ আবার তাঁর শরীর সোজা ব্যাটসম্যানের দিকে থাকায় ফ্রন্ট ওয়ান টেকনিক ব্যাবহারে তাকে যথেষ্ট সাবলীল দেখা যায়। এ ব্যাপারটাও তাকে পুরনো ফর্ম ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারে।

আরো একটা ব্যাপার অবশ্য খেয়াল করা যায়। মুস্তাফিজ ডেলিভারি ছোঁড়ার সময়টা বেশ কমিয়ে এনেছেন। ক্রিজের কাছাকাছি এসে তিনি দ্রুত বল ছুঁড়ে দিচ্ছেন। শরীর সোজা থাকায় দ্রুত ছুঁড়ে দেওয়া তাঁর জন্যে সহজও হচ্ছে। এ ব্যাপারটা ২০১৫ সালেও ছিল। কিন্তু ২০২১ সালের সময়টা ২০১৫ সালের চাইতেও দ্রুত হচ্ছে। এ ব্যাপারে আবার ২০১৮ সালের সময়টা বেশ ধীর বলতে হবে। এর কারণও আছে। বল ছোঁড়ার আগে তাকে এ সময় হাত ভাঁজ করে কাঁধের কাছে নিয়ে আসতে হত। স্বাভাবিকভাবেই এতে তাঁর ডেলিভারি ছুঁড়তে একটু সময় বেশি লাগবে।

এখন এই যে ডেলিভারি ছোঁড়ার সময় কমিয়ে আনা, এটা কী কাজে লাগবে?

মূলত মুস্তাফিজ এখন যে নিজের অস্ত্রভান্ডারে নতুন তূণ যোগ করছেন এটাতেই সময় কমিয়ে আনাটা কাজে দেবে। ব্যাটসম্যান ডেলিভারিতে কী আসতে যাচ্ছে সেটা অনুমান করতে যথেষ্ট সময় পাবেন না এতে।

বোলারের বল ব্যাটসম্যানেরা কীভাবে খেলেন একবার এ সংক্রান্ত একটি পরীক্ষণ করেন ইংল্যান্ডের লিভারপুলের স্পোর্টস সায়েন্টিস্ট মার্ক উইলিয়ামসন! তিনি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে একজন ব্যাটসম্যানকে দ্রুত গতির বলের সম্মুখীন করেন।শুধু তাই না, মার্ক উইলিয়ামসন ব্যাটসম্যানের হাত-পা – মস্তিষ্ক সহ বিভিন্ন অর্গানে সেন্সর স্থাপন করেন। এতে দেখা যায়, ব্যাটসম্যান কি শট খেলবেন তা ৯০ শতাংশ ঠিক করে ফেলেন বোলারের রানআপ নেওয়ার সময়! বাকি ১০ শতাংশ পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঠিক করেন!

এই পরীক্ষণে একাধিক ব্যাটসম্যান ব্যাবহার করা হলে উঠে আসে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য- ব্যাটসম্যান শট খেলার সময় তার ‘আই-সেন্সর’ তিনদিকে কাজ করতে পারে। বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান বল কে অনুসরণ করা শুরু করেন বল ছোড়ার পরমুহূর্ত থেকে। অল্পসংখ্যক ব্যাটসম্যানই বোলারের আঙুলের গ্রিপ থেকে বল কে ফলো করা শুরু করেন। খুবই অল্পসংখ্যক ব্যাটসম্যান তীক্ষ্ণভাবে বোলারের আঙুলের দিকে লক্ষ করেন।

মার্ক বলেন, শেষের ক্যাটাগরির ব্যাটসম্যানের দক্ষতা অন্য সবার চেয়ে বেশি হয়। পরে দেখা যায়,শচীন টেন্ডুলকার তীক্ষ্ণভাবে গ্রিপ লক্ষ করতেন।

এখন এই যে ব্যাটসম্যান বল ছোঁড়ার মূহুর্ত থেকে বোলারকে লক্ষ্য করেন, যদি বোলারের ডেলিভারি ছোঁড়ার সময় কম হয় তাহলে এই ব্যাটসম্যানের অনুমান করতে কষ্ট হয় যে বোলার ঠিক কোন ডেলিভারিটা ছুঁড়তে যাচ্ছে। ব্যাটসম্যান ঠিকমত অনুমান করতে না পারায় বোলার তাঁর কাছে আরেকটু দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেন। এতে অবশ্য বোলারেরও বৈচিত্র্য থাকতে হয়, যেটা মুস্তাফিজের এখন কিছুটা আছে। রশিদ খানের তাবৎ পৃথিবীর কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠার কারণও কিন্তু এই দ্রুত সময়ের ডেলিভারি ছোঁড়াটাই । ৬-৭ রকম লেগ স্পিন জানা  রশিদ কোন ডেলিভারিটা করবেন এটা তিনি দ্রুত সময়ের জন্যে ব্যাটসম্যানকে বুঝতে দেন না।

এখন এই যে এতসব কিছু বললাম তার জন্যে কিন্তু মুস্তাফিজকে স্টাম্পের কাছ থেকে বল করতে হচ্ছিল আর ওভার দা উইকেটে বল ছুঁড়তে হচ্ছিল। এই কারণেই একটু আগে যে ব্যাটসম্যানকে সময় না দেওয়ার যে ব্যাপারটা বলছিলাম সেটা সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু গতকাল আম্পায়ার মুস্তাফিজকে ডেঞ্জার জোন সংক্রান্ত সতর্ক করলে মুস্তাফিজ আবার স্টাম্পের থেকে দূরে সরে যান। এতে মুস্তাফিজের পরিবর্তনগুলো আর কার্যকরী হচ্ছেনা।

বিশেষজ্ঞ কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতে এতে মুস্তাফিজের ব্যাটসম্যানের জন্যে যে ভেতরে ঢোকানো ডেলিভারী এতে আপস করতে হচ্ছেনা। ব্যাটসম্যানের সময় না পাওয়ার যে ব্যাপারটা বললাম তাতেও আবারও ব্যাটসম্যান সময় পাচ্ছেন, শট খেলার জন্যে জায়গা পাচ্ছেন। মুস্তাফিজের আত্মবিশ্বাসেও খামতি পড়ে যাওয়া বিচিত্র নয় এতে।

মুস্তাফিজ আর পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসনের কাজ হবে এখন এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করা!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...