দু’জনেই ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন, দু’জনেই শতরান করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, দু’জনেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, দু’জনেরই প্রথমদিকের কোচ ছিলেন কিংবদন্তি ফ্রাঙ্ক উলি, দু’জনেই অক্সফোর্ড ব্লু, দুজনেই উইজডেনের ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার হয়েছেন।
প্রতিভার ছাপ রেখেছেন দু’জনেই। রুসি মোদির কথায় একজন যদি কিংবদন্তি লেন হাটনের মতন ধ্রুপদী হন, আরেকজন তবে গ্যারি সোবার্সের মতন বিস্ফোরক।
পতৌদির নবাব। ইফতেখার আলী খান আর তার ছেলে মনসুর আলী খান।
ইফতেখারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন পাঞ্জাবে ১৯১০ সালে। তাঁর শ্বশুর ছিলেন ভোপালের নবাব হামিদুল্লা খান। তাঁর শুধু নবাবিচাল নয়, তিনি নিজে পোলো খেলতেন ,রাইফেল শুটার ছিলেন অব্যর্থ এবং ক্রিকেটেও তাঁর হাত মন্দ ছিল না। তিনি বোর্ড অফক্রিকেট কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন ১৯৩৬ এ।
ইফতিকারের ক্রিকেট জীবনের বেশিরভাগ টাই কেটেছিল বিলেতে, কারণ ভারতের টেস্ট খেলার তকমা আসে ১৯৩২ সালে।
ইউনিভার্সিটি ম্যাচে প্রথম বছরেই সেঞ্চুরি করেছিলেন ক্যামব্রিজের বিরুদ্ধে। তখন বয়স মাত্র ১৯। দুবছর পরেই একই প্রতিপক্ষকেদুরমুশ করেছিলেন লর্ডসে ২৩১ রান করে।
সেই বছরটিই ইফতেখারের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর। সেই মরসুমে পাতৌদির নবাব রান করেছিলেন ১৩০৭, মাত্র ১৬ টি ইনিংসে। গড় ছিল অবিশ্বাস্য ৯৩।
এই ২৩৮ নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। তখনও অবধি ইউনিভার্সিটি ম্যাচে রেকর্ড রান ছিল মার্শের ১৭২, তাও ১৯০৪ সালে। তারপর বহু রথী মহারথী এসেছেন,কিন্তুইউনিভার্সিটি রেকর্ড অক্ষত।
সেই রেকর্ড ভাঙলেন কেমব্রিজের অ্যালান র্যাটক্লিফ প্রথম দ্বিশতরান করে।
দিনের শেষে সেই নিয়ে আলোচনায় মশগুল সবাই। এইসময় ইফতেখার সবাইকে অবাক করে বলে উঠলেন, ‘ওর রেকর্ড ২৪ ঘন্টাও টিকবে না। আমিই ভেঙে দেব রেকর্ড!’
হাসির রোল উঠল স্বাভাবিকভাবেই। খেলার পরের দিন। ব্যাট করতে নামলেন ইফতেখার।
পাঁচ ঘন্টা ব্যাট করে একাই রান তুললেন ২৩৮। তাও অপরাজিত।
বাকি দুই অতিপরিচিত কিংবদন্তি রঞ্জি আর দুলীপের মতন ইফতেখারও প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ইংরেজদের হয়ে। প্রথম টেস্টেই শতরান সিডনির মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ইংরেজরা জিতে দশ উইকেটে।
কিন্তু ইফতেখারকে অধিনায়কের রোষে বাদ পড়তে হয় দ্বিতীয় টেস্টের পরেই। ইংরেজদের অধিনায়ক ছিলেন ডগলাস জার্ডিন। কুখ্যাত সেই বডিলাইন সিরিজে জার্ডিনের স্পষ্ট বার্তা ছিল ব্যাটসম্যান সপাটেহুক করলেও ক্লোজ ইন ফিল্ডাররা যেন কোনভাবেই তাতে ভয় না পায়।
কিন্তু কপাল এমনই জার্ডিন নিজেও এই বারেতা মানতে পারেননি। ব্যাটসম্যানের হুকের সামনে সবার সামনেই কুঁকড়ে গেলে সেইআগুনে ঘিঁ ঢালেন স্বয়ং নবাব। মজার ছলেই বলে ওঠেন, ‘ওহে ক্যাপ্টেন,তুমি তো নিজের ইনস্ট্রাকশনটাই ভুলে গেছ দেখছি!’
ফলস্বরূপ পরের টেস্টেই বাদ।
এরপরে আর একটি মাত্র টেস্ট খেলেছিলেন ইংরেজদের হয়ে। যদিও কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছিলেন চুটিয়ে। টেস্টে সুযোগ মেলে আবার অনেক দিন বাদে। ১৯৪৬ সালে, ভারতের অধিনায়কত্ব করার। যদিও এই সিদ্ধান্তে খুশি হননি অনেকেই। তার কারণ ছিল দুটি। এক,তখন অধিনায়ক হবার প্রধান দাবিদার ছিলেন বিজয় মার্চেন্ট।
আর দুই, একজন ‘বিদেশি’ভারতীয় ক্রিকেটারদের আর দেশের অধিনায়ক হবেন,এটাও বোধকরি তখন সবার ভালো লাগেনি। তাই এই সিদ্ধান্ত সবাই খুশিমনে মেনে নিতে পারেননি। সিরিজের ফল হয় ভারতের বিপক্ষে ২-০।
দল হারলেও ইফতেখার তাঁর ব্যাটিং জৌলুস দেখিয়েছিলেন ভালভাবেই। গোটা ট্যুরে চারটি শতরান করেছিলেন তিনি। বিশেষ করে গ্লস্টারশায়ারের আঠালো পিচে অপরাজিত ৭১ সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল যথেষ্টই।
ইফতেখার নবাব হলেও, মেকি ছিলেন না। যথেষ্ট ধারণা ছিল নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে। শুধু ক্রিকেট নয়, একজন অসাধারণ হকি খেলোয়াড়, বিলিয়ার্ডসে যথেষ্ট পটু ছিলেন তিনি। আবার রসবোধ এবং অভিজাত্যও ছিল তাঁর রক্তে। ছেলে মনসুরের উইনচেস্টার কলেজের ফর্মে অন্যান্য দক্ষতার কলামে লিখেছিলেন ‘আমার ছেলে’ ! ছেলের ডাকনাম রেখেছিলেন টাইগার।মনসুরের কাছেও তাঁর বাবা ছিলেন হিরো। ঘরের দেওয়ালে বাবার বড় বড় ছবি টাঙানো থাকত, সেই সোনালী মূহূর্তগুলোর।
১১ বছর বয়সে জন্মদিন উদযাপনের সময় মনসুর খবর পান তাঁর বাবা গত হয়েছেন হার্ট অ্যাটাকে। সেইসময় পোলো খেলছিলেন আদ্যন্ত স্পোর্টসম্যান ইফতেখার। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪১।
বাপকা বেটার মতনই মনসুর দাপিয়েছিলেন ক্রিকেট সার্কিটে। ইফতেখার মাত্র ছয়টি টেস্ট খেললেও কাউন্টিতে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন যথেষ্টই। সেই দু:খ মনসুর মিটিয়ে দেন চল্লিশটা টেস্টে ভারতের অধিনায়কত্ব করে। মনসুরও তাঁর প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন ইফতেখারের মতনই ,অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে।
উইনচেস্টার কলেজের চতুর্থ বছরে ২০০০ রান করার মাত্র ১৬ বছরে সাসেক্সের হয়ে অভিষেক হয় তাঁর। গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পরে একটি চোখ হারাতে হয়।
চোখে কনট্যাক্ট লেন্স পরার পরেও একই সাথে বল দেখতে পেতেন দুটি, ছয় থেকে সাত ইঞ্চি দূরত্বে। এই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও থামানো যায়নি টাইগারকে। এক চোখে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই শতরান করেছিলেন ছটি বিশ্বের তাবড় তাবড় বোলারদের শাসন করে। মাত্র ২১ বছরে দেশের অধিনায়কত্বের রেকর্ড ছিল বহুদিন অক্ষত। ষাটের দশকে ভারতীয় ক্রিকেটের সংজ্ঞা বদলে দেন মনসুর তাঁরমানসিকতা ও ক্রিকেট বুদ্ধি দিয়েই।
বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় উইজডেনের ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার হওয়ার পর। ঠিক তাঁর বাবারই মতন, ৩৬ বছর পরে। বাবা ও ছেলের মধ্যে কে বেশি ভালো, এই প্রশ্নের উত্তরে দুজনকেই দেখা একজন কিংবদন্তি লিখেছিলেন, ‘Pataudi senior was a fine player, but from observation I feel Pataudi junior, taking into account his physical affliction, displayed even greater qualities, & the full flower of Mansur’s prowess never quite blossomed.’
স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের এই কথাটাই হয়ত সঠিক মূল্যায়ন পতৌদির নবাবদের জন্য।
ইংল্যান্ডের উইনচেস্টার স্কুল ক্রিকেটে মৌসুমে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ৪০ বছর নিজের করে রেখেছিলেন ডগলাস জার্ডিন, সেই ডগলাস যার জন্য টেস্ট ক্যারিয়ার বিকশিত হয়নি টাইগার সিনিয়রের। পরে এক মৌসুমে ৭১.২০ গড়ে ১০৬৮ রান করে সেই রেকর্ড ভাঙেন টাইগার পতৌদি। সেই রেকর্ডটা ৫৬ বছর টিকে থাকে। টাইগার নিশ্চিত করে যান যে, পতৌদিদের নামটা যেন সেই তালিকায় ডগলাসের ওপরে থাকে!