হার কে জিতনেওয়ালেকো বাজিগার ক্যাহতে হ্যায়!
ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনকে ঘিরে দাঁড়ানো দেয়াল যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল তখন থেকেই এবার এস্পার অথবা ওস্পার! সেই দেয়াল এখন সেমিফাইনালে, সিমোন ক্যার সেদিন যে চোয়াল শক্ত করেন সেই চোয়াল এখনো শক্তই আছে। রাশিয়াকে চারটা, ওয়েলসকে চারটা, চেক রিপাবলিককে দুইটা!
তিন ম্যাচে দশ গোলের বিপরীতে ডেনমার্কের জালে ঢুকেছে দুইটা গোল। আমাজন প্রাইম চাইলে সেদিনকার ড্রেসিংরুম, সেদিনকার সেই ৪৫ মিনিট নিয়ে একটা দুর্দান্ত রিয়েলিটি ডকু বানিয়ে ফেলতে পারে।
এরিকসেন এখন পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টে ডেনমার্কের সেরা ফুটবলার। ধুপ করে পড়ে গিয়ে ফিনিক্সের যে জাগরণ তুলে দিয়ে গেছেন সেটা নিয়ে বেশি কথা বলে ফেললে পলসেন, ডলবার্গের ফুটবল স্কিলকে কি খাটো করা হবে? তা না হয় হলো একবারের জন্য।
কিন্তু যুগে যুগে এই ফিনিক্স পাখিরা আমাদের বেঁচে থাকার না শুধু কর্মে, মননে ঝংকার তৈরি করে। দুর্দান্ত কোন হেভিমেটাল ব্যান্ডের বেইজ গিটারিস্ট যখন চোখ মুখ বন্ধ করে গোটা স্টেডিয়ামের মানুষের চোখ খোলা রাখে ঠিক তেমন।
কাজল ভাইয়ের পোস্ট করা এক ভিডিওতে সম্প্রতি এক গিটারিস্টের অভিব্যক্তি দেখছিলাম, গিটারের খুটিনাটি আমার জানা নেই, কিন্তু তার প্রতিটা কডে যে পারফেকশন মিলে পাওয়ার একটা সুন্দর দৃশ্য দেখা গেছে তাতে করে মনে হলো কোনও গণিতজ্ঞ তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন অঙ্ক সবচেয়ে সহজ করে তুলছেন, মেলাচ্ছেন একের পর এক সমীকরণ।
এই চরিত্রটা আমার কাছে গ্যারেথ সাউথগেট, ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসের করুণতম গল্প হচ্ছে সমীকরণ মেলানো, জেরার্ড, ল্যাম্পার্ড, বেকহাম, রুনি, ক্রাউচ, টেরিরা পারেননি মেলাতে। সব সুন্দর সুন্দর ফুল একটা সুন্দর ফুলদানিতে এলোমেলো অগোছালো।
সুন্দরতম সব সঙ্গীতজ্ঞ এক মঞ্চে, কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে কাঠি নাড়াচ্ছেন যিনি তিনি আসলে দলটাকে একটা সুনির্দিষ্ট হারমোনিকায় আনতে পারছেন না। এর চেয়ে করুণ গল্প আর কী হতে পারে? কিন্তু সাউথগেট পেরেছেন, তরুণ আর তারুণ্যের যে শক্তি সেটাকে পুঁজি করে। যেখানে তারা ভুলে গেছেন, কে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের, কে ম্যানচেস্টার সিটির, কে লিভারপুলের, কে চেলসির!
মানুষের মনের সবচেয়ে ভেতরের ক্রাইসিসটাকে ঝেড়ে ফেলে একই লক্ষ্যে এগুনো সাউথগেটের ইংল্যান্ড পর পর দুইটা বড় ইভেন্টের সেমিফাইনালে। কেভিন ফিলিপ, গ্রিলিশ, স্যাঞ্চো, ফডেন এরা কেউই জেরার্ড, ল্যাম্পার্ডের চেয়ে বড় নাম না, ফুটবল সমাজ কিংবদন্তির যে মানদন্ড তৈরি করে দেন, সেখানেও তারা এখনো মূল বেদীতে উঠে দাঁড়াননি।
কিন্তু, দলটাকে সামলেছেন সাউথগেট, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টারলিংকে নিয়ে মকারি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য পায়ে শেকল পরিয়ে দেয়নি, স্টারলিং তিন গোল করে এ পর্যন্ত এনে দলটাকে চার গোল করার মতো আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন। ম্যাচে যখন প্রয়োজন মোড় ঘোরানোর তখন গ্রিলিশ এসে বাড়িয়ে দিচ্ছেন গতি, স্যাঞ্চো গতকাল দেখালেন তাকে পেতে কেন ম্যানচেস্টারে এতো দর কষাকষি এতো অনুনয়!
গ্যারি লিনেকার লিখে দিলেন, ‘আমি কি ব্রাজিলের খেলা দেখছি!’
এই ইংল্যান্ডের জিততে হবে না! কিন্তু এই ভিত্তি তাদের আসছে এক দশকে সেরা দল বানিয়ে দিতে পারে! কারণ মিডফিল্ডে পারফর্মারদের সকলের বয়স ২০-২৫! সম্মুখে এখনো তেমন মাঠেই নামেননি ২২ বছরের রাশফোর্ড, ২১ বছরের গ্রিনউড, তারাই হ্যারি কেইনের ব্যাটনটা হাতে নেবেন গোলের সামনে।
ড্যানিশ ও ইংলিশ ফিনিক্স পাখি নিয়ে কথা বললাম অনেক। এবারে বলি লুই এনরিকের গল্প। বার্সেলোনায় বছর পাঁচেক আগে এক মৌসুম শুরুর আগে লিওনেল মেসি কথা দিয়েছিলেন ন্যু কাম্পে আসবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।
সেই কথা এখনো রাখতে পারেনি তাঁর দল, বরং এগিয়ে থেকে চার গোল/তিন গোল খাওয়া, এক ম্যাচেই আট গোল খাওয়া, পর্যদুস্ত হয়ে ফিরেছে ইউরোপিয়ান মঞ্চে।
সেই বার্সেলোনা শেষবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফি পেয়েছিল লুই এনরিকের অধীনে। নেইমারের শেষ ট্রফি! এই মৌসুমের বিশ্বের সেরা তিন একই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে একই সাথে দশ গোল করেন, রোনালদো, মেসি, নেইমার! লুই এনরিকে এবারে শুরুতেই কাঠগড়ায়, আমিও অবাক ছিলাম, রামোসের মতো চরিত্রকে ছাড়াই কেন ইউরোর মতো বড় মঞ্চে?
শুধু অভিজ্ঞতা না, রামোস মানেই প্রতিপক্ষে মানসিক চাপ, স্কিল যার দ্বিতীয় অস্ত্র। কিন্তু লুই এনরিকের নিশ্চিত ভিন্ন ভাবনা ছিল।
তিতুমীর ভাইও একথার এমন ব্যাখ্যা দেন, বড় আসরে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কখনো কখনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। যেমনটা ২০০৮ ইউরোতে স্পেনের ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাউল গঞ্জালেসকে ছাড়াই খেলতে চলে যায়। এরপর তো ইতিহাস, চার বছরে ২ ইউরো, এক বিশ্বকাপ! লুই এনরিকে এখনি সেটা করতে পারবেন কি না সেই প্রশ্ন সময়ের কাপবোর্ডে তুলে রাখা যাক!
প্রথম দুই ম্যাচে দুই ড্রয়ের পরে স্প্যানিশ জয়কথা!
স্পেনের পরিসংখ্যান দেখে নেই একটু, পুরো ইউরোতে সবচেয়ে বেশি পথ পাড়ি দেন পেদ্রি, ৬১.৫ কিলোমিটার, কোকে নিয়েছেন সর্বোচ্চ কর্নার, গোলের মুখে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছেন পাঁচবার, জেরার্ড মোরেনো। পাসের তালিকা দেখলে হা হয়ে তাকিয়ে থাকবেন, পুরো ইউরোতে সর্বোচ্চ পাস দেয়ার চেষ্টা যারা করেছেন, আয়মেরিক লাপোর্তা ৫৪০, যর্দি আলবা ৪৪৭, পও তোরেস ৪২১, কোকে ৪০৪, পেদ্রি ৩৯৯! এরপর আসের ইতালির জর্জিনিও! এর মধ্যে সফল পাসের তালিকাও সদৃশ।
পায়ে বল রাখার লড়াইয়েও এই পাঁচজনই সবার ওপরে! ক্রস দেয়ার তালিকায় কোকে ২ নম্বরে, ২৮টি ক্রস! লুই এনরিকের দল নির্বাচন নিয়ে আর কথা হবে না, চুপ করিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। মোরাতার পরিবারকে নোংরামি সহ্য করতে হবে না, তিনিও দেখিয়েছে প্রেশার মোমেন্টে গোল করতে পারেন তিনি! তবে এই দলে আরেক ফিনিক্স পাখি আছেন, উনাই সিমোন, ক্রোয়েশিয়ার সাথে ওমন একটা আত্মঘাতি গোল হজমের পর তিনি যেইভাবে কামব্যাক করলেন, অবিশ্বাস্য।
টুর্নামেন্টে এখন যা তা হতে পারে! সেমিফাইনাল নিয়ে প্রেডিকশন বিশ্লেষণ পরে দেবো, এসব পরিসংখ্যান দুদিন বাদেই তুচ্ছ হয়ে যাবে, কারণ একটাই! জো জিতা ওহি সিকান্দার!