ব্যর্থতার গ্লানিতে ম্লান সাফল্যের গর্জন

কামরান আকমলের ইনজুরিতে দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। তরুণ উদীয়মান তারকা হিসেবে নিজেকে জানান দিতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। লোয়ার-মিডল অর্ডারে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেটরক্ষক হিসেবে ছিলেন দুর্দান্ত। ধীরে ধীরে মিডল অর্ডারে নিজের জায়গাটা পাঁকা করে ফেলেন।

লম্বা রেসের ঘোড়া হিসেবে কামরান আকমলকে হটিয়ে নিজের জায়গা পাঁকা করে নেন। উইকেটের পেছনে বনে যান দলের আস্থা আর ভরসার নাম। তিন ফরম্যাটেই বনে যান নিয়মিত মুখ। সময়ের ব্যবধানে অধিনায়কের গুরুদায়িত্বটাও পেলেন। সফলতা আর ব্যর্থতার মিশেলে পাড়ি দলেন লম্বা পথ।

ক্যারিয়ারের শেষভাগে এসে সমালোচনা আর বিতর্ক মাথায় নিয়েই দায়িত্ব ছাড়তে হল। দল থেকেও বাদ পড়লেন। জায়গা হারালেন তরুণ সম্ভাবনাময় তারকা মোহাম্মদ রিজওয়ানের কাছে। এখন স্কোয়াডে থাকলেও পানি টানা আর বেঞ্চ গরম করাই তাঁর কাজ। ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন সবটাই তিনি দেখেছেন।

তিনি একজন ভারতীয় বংশদ্ভূত। ভার‍তের উত্তর প্রদেশে একসময় সরফরাজের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন। সেখান থেকে তাঁর পরিবার পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। এরপর করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন সরফরাজ আহমেদ। সেখানেই বেড়ে ওঠা, ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়া।

২০০৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারত যুব দলকে হারিয়ে সরফরাজের অধীনেই যুব বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে পাকিস্তান। যদিও ব্যাট হাতে খুব ভাল সময় কাটাতে পারেননি তিনি। চার ম্যাচে করেন মোটে ৬৪ রান। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাট হাতে তুলেন রানের ফোয়ারা। ওই মৌসুমে ১০ ম্যাচে করেন ৫২৩ রান। সেই সাথে নির্বাচকদের নজরেও ছিলেন তিনি। পরের বছর ২০০৭ সালে সুযোগ পেলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তান ‘এ’ দলে।

একই বছর কামরান আকমলের আঙুলের ইনজুরিতে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ডাক পান। ওই সিরিজে দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। তবে ভাগ্য সহায় না হওয়ায় শেষ ম্যাচে অভিষেক হয়েও ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি তিনি। অভিষেকের পর প্রথম তিন ওয়ানডেতেই ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি তিনি। প্রথম আট ম্যাচে ব্যাট করেছিলেন মোটে দুই ম্যাচে; খেলেছিলেন ৭ ও ১৯ রানের ইনিংস।

বছর খানেক বাদেই ২০০৮ এশিয়া কাপে কামরান আকমলকে হটিয়ে পাকিস্তানের স্কোয়াডে জায়গা করে নিলেন সরফরাজ। এর দু’বছর বাদে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোবার্টে টেস্ট অভিষেক হয় এই উইকেটরক্ষক ব্যাটারের। এবারও সরফরাজের সামনে কাটা পড়লেন কামরান। যদিও এক ম্যাচ বাদেই বাদ পড়েন তিনি। ব্যাট হাতে দুই ইনিংসে করেছিলেন ১ ও ৫।

ওই বছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুবাইয়ে টি-টোয়েন্টি অভিষেক। টেস্ট, ওয়ানডের মতই টি-টোয়েন্টিতেও ব্যাট হাতে দেখান হতশ্রী পারফরম্যান্স। প্রথম দুই ম্যাচে মোটে ৫ রান করার পরই বাদ পড়েন।

পরের বছর এশিয়া কাপে সুযোগ পেলেন। ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৪৬ রান করেন। পাকিস্তানের ২ রানের জয়ে শিরোপা জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল বাংলাদেশের। সরফরাজের ব্যাটে সেবার এশিয়া কাপের শিরোপা ঘরে তুলে পাকিস্তান। ততদিনে তিনি বনে যান দলের নিয়মিত এক মুখ।

২০১৫ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে থাকলেও প্রথম চার ম্যাচে সুযোগ পাননি তিনি। পঞ্চম ম্যাচে ওপেনিংয়ে সুযোগ পেয়ে খেলেন ৪৯ রানের এক ইনিংস। ওই ম্যাচে শিকার করেন ৬ ক্যাচ; বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ডে অস্ট্রেলিয়ান তারকা অ্যাডাম গিলক্রিস্টের পাশে নাম লেখান। নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে করেন সেঞ্চুরি। সরফরাজের সেঞ্চুরিতে কোয়ার্টার ফাইনালে পা দেয় পাকিস্তান।

ওই বিশ্বকাপের পর অবসরে যান তৎকালীন অধিনায়ক মিসবাহ উল হক। আজহার আলীকে অধিনায়ক করে সরফরাজকে সহ অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হল। ওই বছরই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে খেলেন ৯৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। মাত্র চার রানের জন্য সেঞ্চুরি বঞ্চিত হলেও সপ্তম পাকিস্তানি উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে টেস্টে ১ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সরফরাজ। ২৮ ইনিংসে হাজার রানের মাইলফলকের পথে পাকিস্তানের দ্রুততম উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে ইমতিয়াজ আহমেদের পাশে নাম লিখান তিনি।

সেবার বিশ্বকাপের পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আজহার আলীর ইনজুরিতে প্রথমবার ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করেন তিনি। আর অধিনায়ক হিসেবে নিজের অভিষেক ম্যাচেই দেখা পান জয়ের।

এরপর হুট করেই টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। সমর্থকরাও ক্ষোভে ফুঁসে উঠেন। সাবেক পাকিস্তানি তারকা ওয়াকার ইউনিস বলেছিলেন, ‘সরফরাজ আমাদের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। ওকে পরবর্তী টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক করা হোক।’

সমালোচনার জেরে সরফরাজকে টি-টোয়েন্টিতে ফেরায় নির্বাচকরা। আর পরের বছর ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সে শহিদ আফ্রিদিকে হটিয়ে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পান প্রথম ম্যাচেই। ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টিতেও অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক ম্যাচে জয়ের দেখা পান সরফরাজ।

বছর দুয়েকের মাথায় সরফরাজের অধীনে টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে আসে পাকিস্তান। সরফরাজের অধীনে টানা এগারো টি-টোয়েন্টিতে জয় পায় পাকিস্তান। এই জয়ের ধারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েকে হারায় সরফরাজের দল।

২০১৭ সালে ওয়ানডেতেও পূর্ণ মেয়াদে অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি। তাঁর অধীনেই ভারতকে হারিয়ে ২০১৭ আসরে প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জেতে পাকিস্তান। আইসিসি ঘোষিত ‘টিম অব দ্য টুর্নামেন্টে’র অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। পরের বছর পাকিস্তান দিবসে সর্বকনিষ্ঠ পাকিস্তানি ক্রিকেটার হিসেবে সিতারা-ই-আজম (পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড) পুরষ্কার লাভ করেন সরফরাজ।

ওই বছরের সেপ্টেম্বরে টেস্টেও অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয় পাকিস্তান। রঙিন জার্সি অধিনায়ক হিসেবে দুর্দান্ত শুরু করলেও সাদাপোশাকের শুরুটা ছিল হতাশার।

২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে ক্যারিয়ারর একশোতম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন সরফরাজ। একই সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার আন্দাইলে ফেহলুকওয়াওকে বর্ণবাদী মন্তব্য করে চার ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা পান সাবেক এই অধিনায়ক।

ওই বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে তাঁর অধীনে নয় ম্যাচের পাঁচটিতে জয় পায় পাকিস্তান। সেবার নেট রান রেটে পিছিয়ে থেকে সেমিফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান। এরপর ওই বছরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে অধিনায়কের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় সরফরাজকে। আজহার আলীকে টেস্ট ও বাবর আজমকে দেওয়া হয় রঙিন পোশাকে অধিনায়কের দায়িত্ব।

সরফরাজের অধীনে ৩৭ টি-টোয়েন্টির ২৯টিতেই জয় পায় পাকিস্তান। অপরদিকে, অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট পরিসংখ্যানটা বড্ড বাজে। ১৩ টেস্টের মধ্যে তার অধীনে মাত্র চার জয় ও বিপরীতে আট ম্যাচে হেরেছে পাকিস্তান। ওয়ানডে পরিসংখ্যানও সাদামাটা। ৫০ ম্যাচে জয়ের দেখা পেয়েছেন ২৮টিতে। ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) তাঁর অধীনে একবার শিরোপা জেতে কোয়েটা গ্লাডিয়েটরস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link