ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর বিদায়ের পর থেকে বাঁ প্রান্তে রিয়াল মাদ্রিদের পোস্টারবয় হয়ে উঠছেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। ক্যারিয়ারের শুরুতে হাস্যকর সব মিসের জন্য সমর্থকদের ট্রলের পাত্র হলেও গত মৌসুম থেকে করিম বেনজামার সাথে আক্রমণভাগে গড়ে তুলেছেন বিধ্বংসী এক জুটি। পূর্বের সবকিছু ভুলিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছেন রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের নয়নের মণি।
সবকিছু পেছনে ফেলতে পারলেও বদলাতে পারেননি গায়ের রঙ। বিশ্বের কোনো মানুষের পক্ষেই আসলে স্রষ্টাপ্রদত্ত গায়ের বর্ণ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, ভিনিসিয়াসও পারেননি। আর সেটাই কাল হলো, মাঠের পারফরম্যান্স নয় বরং গায়ের রঙের জন্য বর্ণবাদী আচরণের স্বীকার হলেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। আর সেটা এসেছে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান স্বয়ং পেদ্রো ব্রাভোর কাছে থেকে।
গোল করার পরই ভিনিসিয়াসের কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে গিয়ে নেচে-গেয়ে উদযাপন করাটা একপ্রকার নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে গত মৌসুম থেকে। বয়স মাত্র ২২ বছর হলেও এরমাঝেই অসংখ্যবার বর্ণবাদী আচরণের স্বীকার হয়েছেন, ভিনিসিয়াস তাই এবার আর মন খারাপ করেননি।
সকল সংকট পার করেই এই পর্যায়ে এসেছেন, তিনি জানেন এরপর কি হবে। মৃদুমন্দ স্বরে ক্ষমা চাওয়া হবে, দাবি করা হবে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে বর্ণবাদী আচরণ থেমে থাকবে না। ভিনিসিয়াস তাই একজন ব্রাজিলিয়ান হয়েই খেলে যাবেন, উদযাপন করবেন তাদের মত করেই। তিনি জানেন তাঁর উদযাপন নয়, বরং তাঁর গায়ের রঙেই যত সমস্যা ব্রাভোর।
‘কাউকে সফল হতে দেখাটা কষ্ট দেয়। ব্রাজিলিয়ান কালো বর্ণের কাউকে ইউরোপে সফল হতে দেখাটা আরো বেশি কষ্ট দেয়।’, এভাবেই নিজের পেদ্রোর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান ভিনিসিয়াস।
বর্ণবাদী আচরণ বহু আগে থেকেই ঘটে আসছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে। মাঠের ফুটবল দিয়ে নয়, বরং ফুটবলারদের বিবেচনা করা হয়েছে তাদের গায়ের রঙ দিয়ে। কালো বর্ণের ফুটবলারদের তাদের চুলের রঙ, উদযাপন, তাদের পোষাক সবকিছু নিয়েই সমালোচনা করা হয়েছে। এবং পরিস্থিতি মোটেই উন্নতি হচ্ছে না। বর্ণবাদী আচরণের ঘটনা ফুটবলে দিন দিন বাড়ছে। মাত্র তিন মৌসুম আগে ক্যালিয়ারির বিপক্ষে প্রতিপক্ষের সমর্থকদের কাছে থেকে বর্ণবাদী আচরণের স্বীকার হন জুভেন্টাসের স্ট্রাইকার ময়েস কিন।
পুরো ম্যাচজুড়ে তাকে অকথ্য গালাগাল করে গেছেন সমর্থকরা। সেই ম্যাচে গোল করার পর দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে উদযাপন করেন এই স্ট্রাইকার। তাঁর প্রতি হওয়া আচরণের বিরুদ্ধে যা ছিল নির্বাক কিন্তু শক্তিশালী এক প্রতিবাদ। অথচ ম্যাচশেষে নিজের সতীর্থদের সমর্থনই পাননি এই তরুণ। জুভেন্টাস অধিনায়ক লিওনার্দো বনুচ্চি বলেন, ‘এই ঘটনায় কিনও সমান অপরাধী। তাঁর উচিত হয়নি ওভাবে উদযাপন করা।’ অথচ সতীর্থদের উচিত ছিল সবার আগে কিনের পাশে দাঁড়ানো। এর আগে আরেক ইতালিয়ান স্ট্রাইকার মারিও বালোতেল্লিও জানিয়েছিলেন কালো হওয়ার কারণে দলের সবাই তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। দলের সবার সাথে থাকলেও তিনি যেন ছিলেন অদৃশ্য।
ভিনিসিয়াস অবশ্য অতোটা দুর্ভাগা নন। এই দু:সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্বফুটবলের নামী ব্যক্তিত্বরা। নেইমার, এডের মিলিটাও, পেলেরা এর মাঝেই তাঁর সমর্থনে টুইট করেছেন, ব্রুনো গুইমারেস পেদ্রো ব্রাভোর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। স্প্যানিশ এক টিভি চ্যানেলে পেদ্রো বলেন, ‘ভিনিসিয়াসের উদযাপন প্রতিপক্ষের জন্য অসম্মানজনক। এমন নাচতে চাইলে ব্রাজিলে যাও, স্পেনে এসব বাদর নাচ চলবে না।’
অথচ গোলের পর এই ধরণের নাচ ব্রাজিলের ফুটবল সংস্কৃতির অংশ প্রায় শতবর্ষ আগে থেকেই। জোগো বোনিতোয় ছোঁয়ায় বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করা ব্রাজিলের ফুটবলাররা গোলের দর্শকদের হাত-কোমড় নাড়িয়ে নেচেই আনন্দটা ভাগাভাগি করে নেন। ১৯২০ সালের দিকে ব্রাজিলিয়ান বিখ্যাত ডিফেন্ডার ডমিংগোস ডে গুইয়া প্রথম এভাবে নেচে উদযাপন করেন। সে সময়ে ব্রাজিলে কালোদের ফুটবল খেলা একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। একবার একবার এক ট্যাকলে তিনি পড়ে গেলে তাঁর বড় ভাই তাকে ড্রিবল করার নাচতে বলেন।
ডে গুইয়া ম্যাচে প্রতিপক্ষকে ড্রিবল করার সময় কোমরটা একটু দোলান আর ড্রিবল করে বেরিয়ে যান। সেই থেকে এই নাচ আর জোগো বোনিতো হয়ে যায় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। পেলে, গ্যারিঞ্চা থেকে শুরু করে জিকো, সক্রেটিস, রোনালদো, রোমারিও, রোনালদিনহো সবাই ফুটবলের পাশাপাশি অঙ্গভঙ্গিমা করে উপভোগ করতেন ফুটবলটাকে। তারা নিজেদের খেলার ধরণ পাল্টাননি, কিংবা কখনো ক্ষমাও চাননি এবং তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিতও নয়।
ভিনিসিয়াসের সমর্থনে টুইটারে পেলে লিখেন, ‘ফুটবল হলো আনন্দ। এক ধরনের নাচ। যদিও বর্ণবাদের মতো খারাপ ব্যাপার এখানেও আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের হাসি থামানো উচিত নয়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাব, এবং এই লড়াই চালিয়ে যাবার মধ্য দিয়েই সুখী হবো।’ ভিনিসিয়াসও সেই পথেই আগাচ্ছেন, নীরবে-নিভৃতে বর্ণবাদ নির্মূলে কাজ করছেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেন পরবর্তী প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।
ভিনিসিয়াসের সাথে ঘটা এই ঘটনা ইংগিত দেয় সময়ের ঘড়িতে ১০০ বছর এগোলেও, আমাদের মন মানসিকতা এখনো রয়ে গেছে ১৯২০ সালেই। তবে ভিনিসিয়াস এত সহজেই দমে যাবার পাত্র নন। তিনি যেভাবে পুরো ঘটনাটা মোকাবেলা করেছেন, তা বাকি ফুটবলারদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। তিনি ফুটবলটা খেলবেন একজন ব্রাজিলিয়ানের মতো করেই।
‘আমি নাচ থামাবো না, সেটা সান্তিয়াগো বার্নাব্যু হোক কিংবা বিশ্বের অন্য কোথাও।’ এক ভিডিওবার্তায় দৃঢ়কন্ঠে জানিয়েছেন ভিনিসিয়াস। বর্ণবাদী আচরণকারীদের বিপক্ষে এটাই বিপক্ষে উচিত জবাব, ভিনি ভবিষ্যতের জন্য স্থাপন করে যাচ্ছেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।