দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর মিনিট, মাঝমাঠ থেকে বামের দিকে টনি ক্রুসের বাড়ানো বল ভিনিসিয়াস জুনিয়র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে হালকা একটু গতি বাড়িয়ে সোজা বরাবর ঢুকলেন। ২০১৮-১৯ এর ভিনিসিয়াসে খেলার ধরণ আন্দাজ করে রিয়াল সোসিয়াদাদের ডিফেন্ডার এগিয়ে যাচ্ছিলেন লাইন বরাবর।
কিন্তু, ডি-বক্সের কোণা থেকে নিজের গতিপথ পরিবর্তন করে দুইজন ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে বল বাড়িয়ে দিলেন লুকা জোভিক। দুইজন ওয়ান-টু খেলে আবার ভিনিসিয়াসের পায়ে বল জমানোর আগেই শট চালালেন বাম পাশের নিচের কোণা দিয়ে গোল আদায় করে নিলেন ভিনিসিয়াস।
খুব গুরুত্বপূর্ণ এক গোল করছেন ভিনিসিয়াস তা নয়। আবার খুব যে দৃষ্টিনন্দন এক গোল যে করেছেন ভিনিসিয়াস তাও নয়। তবে এই গোলের বিবরণে অন্তত বোঝা যায় ঠিক কি পরিমাণের পরিবর্তন এসেছে ভিনিসিয়াসের মধ্যে। তবে মনে করে দেখুন তো ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কি পরিমাণ ট্রলের স্বীকার হয়েছিলেন তিনি। ভিনিপেলে সম্বোধন করে ট্রল করা হতো আজকের এই ভিনিসিয়াসকে নিয়ে।
২০১৮-১৯ মৌসুমে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব থেকে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ ফুটবলের কিংবদন্তি হবার আশা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে। কথা ছিল প্রাচীনতম ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের ‘বি’ দলের হয়ে খেলে নিজেকে পরিপক্ক করে তারপর আসবেন মূল দলে।
কিন্তু, সেই বছর লস ব্ল্যাঙ্কোসদের অন্যতম তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো দল ছাড়ার পর, এক টালমাটাল অবস্থায় মূল দলে অভিষেক হয় অনভিজ্ঞ ভিনিসিয়াসের। দলের উপর বাড়তি প্রত্যাশার চাপ। একের পর এক কোচকে চাকুরিচ্যুত করার ঘটনার মধ্য দিয়েই রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারের শুরু তাঁর।
এক নবাগত কিশোর এসে যেন পড়লেন অথৈ সাগরে। নিজের স্কিলের উপর ভরসা করে খেলতে থাকলে। অসাধারণ গতি রয়েছে তাঁর সেই শুরু থেকেই। মুহূর্তেই গতির তারতম্য ঘটিয়ে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে ঘোল খাইয়ে দিতে পারতেন তিনি। তবে এটাকিং থার্ডে গিয়ে নিজেই খেই হারিয়ে ফেলতেন ভিনিসিয়াস।
তাছাড়া তাঁর ফিনিশিং দূর্বলতা ছিল সবচেয়ে দৃষ্টিকটু। নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাছাড়া রোনালদোর ফেলে যাওয়া পজিশনে খেলতে হচ্ছে তাঁকে সেক্ষেত্রেও রয়েছে বাড়তি চাপ। কিশোর ভিনিসিয়াস কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অভিষেক মৌসুমে মোট ৩১ ম্যাচে তাঁর গোল সংখ্যা কেবল চার।
একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে যেন বড্ড বেশি বেমানান একটি পরিসংখ্যান। তাঁর পরের মৌসুমেও অব্যাহত থাকলো ভিনিসিয়াসের ফিনিশিং দূর্বলতার ভাঙ্গা তরী। সেই মৌসুমে লিগে ভিনিসিয়াস ৭৫টা শট চালিয়ে গোলের দেখা পেয়েছিল মাত্র তিনটি।
সব মিলিয়ে তাঁর গোল সংখ্যা ৩৮ ম্যাচে কেবল পাঁচটি। আর ওদিকে তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রলের অন্ত নেই। দলের জন্যে খুব একটা কার্যকরী ভূমিকাও রাখতে পারছিলেন না ভিনিসিয়াস। সেই এক উইঙ্গ বরাবর দৌড়ে যাওয়া এবং পেনাল্টি বক্সের সামনে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন কিছুই বোধহয় তখন জানতেন না তিনি।
তবুও কোচ জিনেদিন জিদান তাঁকে বেশ সুযোগ দিয়েছিলেন। কাজে আর লাগাতে পারছিলেন না। ২০২০-২১ মৌসুমেও ভিনিসিয়াসের মোট গোল সংখ্যা কেবল ছয়। যেখানে কিনা একেবারে ছোটবেলা থেকে পেলের সাথে তুলনা শুনেই বড় হয়েছেন ভিনিসিয়াস। মানুষজন হয়ত ভাবতে লাগলেন কেবল শারীরিক গঢ়নের কারণেই বোধহয় এমন তুলনা। খুবই অবান্তর, খুবই অযৌক্তিক। গেলো তিন মৌসুমে তাঁর অ্যাসিস্ট সংখ্যা মোট মিলিয়ে আটটি।
কিন্তু ২০২১-২২ মৌসুমে এসে ভিনিসিয়াস যেন বেড়িয়েছেন খোলস ছেড়ে। অভিজ্ঞতা বেড়েছে। সাথে যেন বেড়েছে খেলার ধার। অন্যদিকে ফুটবলের ডন খ্যাত কার্লো আনচেলত্তি এই মৌসুমেই এসেছেন রিয়ালের দায়িত্বে। তিনি নিশ্চয়ই দিয়েছেন এমন কোন সঞ্জীবনী মন্ত্র যাতে ট্রল হওয়া ভিনিসিয়াস বর্তমানে কুড়াচ্ছেন বিশ্বব্যাপী প্রসংশা।
রিয়ালে এখন ভিনিসিয়াস ও করিম বেনজেমা জুঁটিকে দমিয়ে রাখা প্রায় দুষ্কর। দলের অধিকাংশ গোলে রয়েছে তাঁদের দুইজনের সমান অবদান। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও লা লিগা মিলিয়ে ভিনিসিয়াসের এই মৌসুমের মোট গোল সংখ্যা ১২টি। অন্যদিকে করিয়েছেন সাত গোল। যা কিনা গত তিন মৌসুমের যোগফল থেকে এক কম।
ভিনিসিয়াসকে আটকাতে প্রতিপক্ষ কোচকে বাড়তি পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। গেলো মাসে লা লিগার মাসসেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জিতেছেন ভিনিসিয়াস। এতে খানিক আন্দাজ করে নেওয়া যায় দলের প্রয়োজনে ঠিক কতটুকু অবদান রাখছেন তিনি। তাঁর ফিনিশিং এর দূর্বলতা যে ঘুচেছে তা প্রমাণ করে তাঁর এই মৌসুমের গোল সংখ্যা। এখনো মৌসুমের অর্ধেকের বেশি বাকি পড়ে রয়েছে ভিনিসিয়াসের গোলের পরিসংখ্যান বাড়ানোর জন্যে।
তাছাড়া নিয়ের গতি এবং তাঁর দ্রুত পরিবর্তন করে প্রথম গিয়ার থেকে ছয় কিংবা সাত গিয়ারে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা ভিনিসিয়াস ব্যবহার করছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণদূর্গে ছেঁদ তৈরিতে। তাছাড়া বল নিয়ন্ত্রণে রাখার দক্ষতাও বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর।
তাছাড়া ম্যাচের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার দক্ষতাও তাঁর মধ্যে স্পষ্ট প্রতীয়মান। তাছাড়া প্রতিপক্ষের পরিকল্পনার ছকে কাটাছেড়া করাতে বাধ্য করছেন ব্রাজিলিয়ার নব্য তারকা। উড়ছে দলকে সাথে নিয়েই। লা লিগায় রিয়ালের অবস্থান এখন সবার উপরে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সেভিয়ার সাথের পয়েন্টের ফারাক পাঁচ। তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও রিয়াল পার করেছে গ্রুপ পর্ব।
দারুণ ছন্দে থাকা ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে দলে নিতে ইতোমধ্যে বেশকিছু দল আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে লিভারপুলের মতো বড় দল। তবে রিয়াল হয়ত ছেড়ে দেবে না তাঁর এই উদীয়মান তারকাকে। তাঁকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাই হয়ত করছে লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। উড়তে থাকুক ভিনিসিয়াস, পেলে না হোক অন্তত একজন ভিনিসিয়াস হয়েই ইতিহাসের অন্যতম সেরাদের তালিকায় নিজের নামটি লিখিয়ে যাবেন ভিনিসিয়াস এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।