মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের সেই রাতটাকে স্মরণ করতেই হবে। সত্যি বলতে, গত সাড়ে ১১ বছর ধরেই অপেক্ষা করছিলাম এই রাতের জন্য। এই মুহূর্তটির জন্য।
সেটি ২০১২ সালের ১৮ মার্চ। বিরাট কোহলি তখনও এরকম ফিটনেস-ফ্রিক হয়ে ওঠেননি। শরীরে চর্বির অস্তিত্ব ভালোভাবেই বোঝা যেত। মুখটাও তখনও বেশ গোলগোল, দিল্লির ‘চিকু’।
তবে গ্রেটনেসের ইঙ্গিত ততদিনে ভালোভাবেই দিয়েছেন। শ্রেষ্ঠত্বের পথে হাঁটা শুরু করেছেন। এশিয়া কাপের ম্যাচে সেদিন পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৩০ রান তাড়ায় উইকেটে গেলেন প্রথম ওভারেই। গৌতাম গম্ভীর শূন্যতে আউট হওয়ার পর।
মনে আছে, প্রথম বাউন্ডারি পেলেন ব্যাটের কানায় লেগে। একটু পর আইজাজ চিমার বলে পুল করে বাউন্ডারি। এরপর তাকে আর থামায় কে! সাচিন টেন্ডুলকার আর তিনি পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকলেন। একটা সময় গিয়ে শচীনকে ছাপিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন ভিরাট। ওয়াহাব রিয়াজকে কী মারটাই না মারলেন!
১৪৮ বলে ১৮৩ রানের ইনিংস খেলে যখন ভিরাট আউট হলেন, ভারত তখন জয়ের একদম নাগালে। তার একাদশ ওয়ানডে সেঞ্চুরি ছিল সেটি।
সেদিন ম্যাচ সেরা হয়ে সংবাদ সম্মেলনে এলেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘শচীন প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন ৭৯তম ম্যাচে, আপনার তো ৮৫ ম্যাচেই ১১টি হয়ে গেল। কি মনে হয়, শচীনের সেঞ্চুরির রেকর্ড ছোঁয়া সম্ভব?’
এক গাল হেসে বিরাট উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার জন্য বলতে পারেন এটা মিশন ইমপসিবল।’ সেদিন সংবাদ সম্মেলন শেষে ভারতীয় সংবাদকর্মীরা দারুণ খুশি। আমাকে এসে কয়েকজন বললেন যে, ‘জুতসই প্রশ্ন করেছো, দারুণ একটা হেডিং পেয়ে গেলাম আমরা।’
শচীনের রেকর্ড নিয়ে কোহলি বলছেন ‘মিশন ইমপসিবল’, সংবাদকর্মীদের জন্য আসলেই স্বপ্নের হেডিং। সেখানেই শেষ নয়। ওই বছরই ভারতে কোনো একটি টিভি অনুষ্ঠানেও শচীনের রেকর্ড নিয়ে ঠিক একই কথা বলেছিলেন বিরাট, ‘মিশন ইমপসিবল’।
এরপরের গল্পটা সবার জানা। কীভাবে তিনি ফিটনেসকে গুরুত্ব দিতে থাকলেন, নিজের প্রিয় খাবারগুলোর সঙ্গে আপোস করলেন, ডায়েট করার সময় ক্ষুধায় বিছানার চাদর খেতে চাইতেন, তবু নিজের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নিয়ত লড়াই, প্রতিভাকে পুড়িয়ে খাঁটি করলেন পরিশ্রম আর প্রতিজ্ঞার আগুন।
ক্রিকেটও তাকে দুহাত ভরিয়ে দিল। অবিশ্বাস্য ধারাবহিকতা, অভাবনীয় সব রেকর্ড, অকল্পনীয় কিছু অর্জন, চোখধাঁধানো সব পরিসংখ্যান এবং অদৃশ্য একটি মুকুট। শ্রেষ্ঠত্বের তাজ।
এবং ইডেনের রাতে, সেই মিশন তিনি ‘পসিবল’ করে ছাড়লেন।
খেলাধুলায় একযুগের সঙ্গে আরেক যুগের তুলনা করা কঠিন। প্রায় অসম্ভব। তবু জগতের নিয়মেই তুলনা চলে। শচীন নাকি বিরাট, এই তুলনাও চলবে। আমি সেসবে যেতেই চাই না। আমি দেখি, ক্ষমতা। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, সেটিকে প্রমাণ করার ক্ষমতা।
শচীনের যেসব কীর্তি, একসময় কারও সুদূরতম কল্পনাতেও তা ছিল না। তার কীর্তি কেউ ছুঁতে বা ছাড়াতে পারবে, একজনও কি ভাবতে পেরেছিলেন? বিরাট ভাবাতে বাধ্য করেছে বেশ কজন আগেই। অনেকগুলোই করে দেখিয়েছেন। আরেকটিও করে দেখালেন। আরও দেখাবেন, নিশ্চিত।
কখনও কখনও তাদেরকে দেখে বিভ্রম হয়। মনে হয়, তাঁরাই বুঝি ঈশ্বর! আদতে, রক্ত-মাংসেরই মানুষ। আপনার-আমার মতো। শুধু ধাত আলাদা। ভেতরটা আলাদা। মানব সম্প্রদায়ের সামর্থের যে কোনো সীমানা নেই, সেই ঝাণ্ডা বয়ে চলেন তাঁরা।
এজন্যই একজন ভিভ রিচার্ডসকে আমাদের কুর্নিশ করতে হয়। ওয়ানডের কোনো সর্বকালের সেরা একাদশে ভিভকে না দেখলে আমি তা পাত্তাই দেই না। ঠিক তেমনি টেস্টের অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। কোনো পরিসংখ্যান, রেকর্ড, সংখ্যায় তাদের ধরা যাবে না। বোঝা যাবে না। তাদেরকে বুঝতে হলে গভীরে যেতে হবে, সময়টাকে ধরতে হবে, ক্রিকেটের পালাবদলটা বুঝতে হবে।
তাঁরা শুধু তাদের জমানায় নিজেদের উজ্জ্বল করে মেলে ধরেননি, নিজম্ব ঘরানা দিয়ে ক্রিকেট নামক খেলাটাকে বদলে দিয়েছেন, নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, পরের ধাপে পৌঁছে দিয়েছেন, আটপৌরে আমরা যা কখনও ভাবতেও পারিনি।
সাচিন-ভিরাটরা তো সেই ঘরানারই সম্রাট। কে সেরা, কে এগিয়ে—এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন অনেকে। চলতে থাকুক। ভিরাটদের ওসবে কান দিলে চলে না। একেকটি মাইলফলক মানে তাদের কাছে স্রেফ আরেকটু জ্বালানি, নতুন গন্তব্যে ছোটার জন্য, ঠিকানা খোঁজার জন্য।
ঠিকানা কোথায়? কেউ জানে না। আপনার-আমার ভাবনার সীমানা যেখানে শেষ, সেখান থেকেই বিরাটদের নতুন পথচলার শুরু।
মাঠের বিরাপের এই যে বুনো, খ্যাপাটে বিরাট, তার এই ‘অ্যাটিটিউড’ নিয়েই অনেকের আপত্তি। এসব দিয়েই ‘ভালো মানুষ-মন্দ মানুষ’ বিচার করেন অনেকে। আদতে এই অ্যাটিটিউডই তো তা ছুটে চলার রসদ!
অমুক-তমুকের সঙ্গে এখানে তুলনা করে লাভ নেই ভাই, চ্যাম্পিয়নদের সবার ধরন আলাদা, নিজেকে বয়ে নেওয়ার বাহন আলাদা। বিরাটের যেমন এই অ্যাটিটিউড। ওই যে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আর হুঙ্কার, এসবই বারবার বিরাটের কানে বলে, ‘থামিস না, ওই দূরে নতুন বিন্দু, ছুটে চল।’
– ফেসবুক থেকে