বিরাট বনাম বাবর: শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই

ক্রীড়াক্ষেত্রে যে কোনো প্রতিযোগিতা সব সময়ই অভিভূত করে দর্শকদের। কখনও কখনও দল ছাড়িয়ে প্রতিযোগিতা হয় দুই ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের মাঝে। আর সেটা যদি হয় সেরাদের মাঝে তবে ভক্তদের অনুভূতি কোন সীমারেখায় বাঁধা যায় না। ফুটবলের লিওনেল মেসি-ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এর লড়াই যেমন মোহিত করে রেখেছে ফুটবল প্রেমীদের, তেমন করেই ক্রিকেট বিশ্বকে মুগ্ধ করে রেখেছে বিরাট কোহলি এবং বাবর আজমের লড়াই।

জাভেদ মিয়াদাঁদ,সেলিম মালিকদের মতই ব্যাটিংয়ের নান্দনিকতা নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় আসা বাবর আজমের সবচেয়ে বড় অর্জন, তিনি ফিরিয়ে এনেছেন ভক্তদের বহুল কাঙ্খিত এক ক্রিকেটীয়-দ্বৈরথ। যেখানে তার সঙ্গী ভারতের ব্যাটিং অহংকার বিরাট কোহলি।

বিরাট বনাম বাবর – টক অব দ্য ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড এখন নিশ্চয়ই। সাদা পোশাকের টেস্ট কিংবা সাদা বলের ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি; তিন ফরম্যাটেই দলের সবচেয়ে ভরসার ব্যাটসম্যান দুজন। আইসিসির তিন ফরম্যাটের র‍্যাংকিংয়ে দুইজন আছেন উপরের দিকেই। বিরাট যেমন লিখেছেন অ্যাডিলেডের মহাকাব্য, তেমন বাবরের ঝুলিতে আছে করাচি-গাঁথা।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিরাট কোহলি অবশ্য অনেক আগেই পা রেখেছেন, সে তুলনায় বাবর আজমের শুরুটা অনেক দেরিতে হয়েছে। তবু দুইজন মেতে উঠেছেন একে-অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশায়। কিন্তু সময়ের পার্থক্য একটু বেশি হওয়ায় শুধু পরিসংখ্যান আর সংখ্যায় দুজনের এই লড়াই পুরোপুরি ফুঁটিয়ে তোলা যায় না। বরং বলা যায় ভারতীয় তারকার এতদিনে যা অর্জন করেছেন সেসব অর্জনের দিকে প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন পাকিস্তানের বর্তমান অধিনায়ক।

বিরাট কোহলি’র টেস্ট রান আট হাজারের বেশি, ওয়ানডেতে রান সংখ্যা ১২৩৪৪। অন্যদিকে বাবরের টেস্ট রান তিন হাজার এর বেশি, আর ওয়ানডেতে ৪৬৬৪ রান। অপেক্ষাকৃত নতুন ফরম্যাট টি-টোয়েন্টিতে বিরাট ১৩৮.০৬ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৩৬৬০ রান অন্যদিকে বাবর করেছেন ২৯৩৯ রান; স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৩০।

সংখ্যাগুলো দেখে মনে হতে পারে তুলনাই হয় না দুজনের। এজন্য আগেই বলে রেখেছিলাম বিরাটের চেয়ে বছর সাতেক পরে আসা বাবর আজমকে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে দেখলে ভুল বোঝা হবে। তবে ব্যাটিং এভারেজ দেখে অন্তত কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন। ওয়ানডেতে বিরাটের এভারেজ ৫৭.৬৮ আর বাবরের ৫৯.৭৯। টেস্টে বিরাটের এভারেজ প্রায় ৫০ আর বাবরের সেটা প্রায় ৪৭.৩০। বিশ ওভারের ফরম্যাটে বাবরের এভারেজ যেখানে ৪৩.২২ সেখানে বিরাটের অবশ্য ৫০.৮৩। সমান না হলেও কাছাকাছি বলাই যায়।

সাদা পোশাকে ঘরের মাঠে বিরাটের ফর্ম ঈর্ষনীয়, ৬১ এভারেজে ৩৭৪৮ রান। আর অ্যাওয়ে-তে ৪২.২৭ এভারেজে রান করেছেন ৪২২৭। অন্যদিকে বাবর আজম পাকিস্তানের মাঠে টেস্ট খেলেছেন মোটে আটটি। ৮৩.৩৬ গড়ে রান করেছেন ৯০০ এর মত। আর বিদেশে প্রায় ৪০ গড়ে দুই হাজারের বেশি রান সংগ্রহ করেছেন বাবর আজম।

ওয়ানডে ফরম্যাটে হোম কন্ডিশনে বিরাটের সংগ্রহ ৫৮.৩৭ গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি রান। অ্যাওয়ে সিরিজে বিরাটের ব্যাটে এসেছে ৭৩২৪ রান, এভারেজ ৫৭.২২। অন্যদিকে ঘরের মাঠে মাত্র ১২ ম্যাচ খেলা বাবর রান করেছেন ৮৭৮, গড় ৮৭.৮০! এছাড়া দেশের বাইরে তার সংগ্রহ ৫৫.৬৮ গড়ে ৩৭৬৮ রান।

দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণ, ভিনদেশী পরিবেশ,বোলিং স্বর্গ হয়ে ওঠা বাইশ গজ; এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাই যদি হয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই তবে দুই দেশের দুই মহারথীকে দিতে হবে লেটার মার্কস। সংখ্যার হিসেব বাদ থাকুক; দল যখন চাপের মুখে, খাঁদের কিনারায় তখন এই দুজনের পারফরম্যান্সই বলে দেয় তাদের লড়াইয়ের যৌক্তিকতা।

অবশ্য গত তিন বছর বিরাটের ব্যাট থেকে কোহলি-ময় ব্যাটিংটা দেখা যায়নি। শতকের দেখা পাননি প্রায় হাজারদিন হয়েছিল। শচীনের সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙ্গা যার জন্য ছিল সময়ের ব্যাপার সেই বিরাট এখন অন্ধকারে হাতড়ে মরেন একটা শতকের জন্য। কিন্তু বিরাট কোহলি ঘুরে দাঁড়াতে জানেন বলেই তিনি আজকের ‘কোহলি’৷ তাইতো এশিয়া কাপে আবারও ফিরেছেন স্বরূপে; করেছেন নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি।

অন্যদিকে প্রতিদিন নিজেকে আরও উপরে তুলে নিচ্ছেন বাবর। এশিয়া কাপ খুব একটা ভাল না গেলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে নিজের অস্তিত্ব ভালভাবেই জানান দিয়েছেন পাকিস্তান অধিনায়ক।

বাবর আজম আর বিরাট কোহলি কে যদি সূর্য ধরা হয় তবে বিরাটের সূর্য গত একযুগ ধরে আলো ছড়িয়ে এখন পশ্চিম আকাশের দিকে হেলে পড়েছে। অন্যদিকে বাবর আজম নামক সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়ে এখন মধ্য আকাশের দিকে আসছে; বয়ে বেড়াচ্ছে তেজস্বী এক ক্রিকেটীয় অধ্যায়ের সম্ভবনা।

এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়া অবশ্য বাকি আছে। বিরাট কোহলির এতদিনের অর্জন সবাই ছুঁয়ে দেখতে পারে না, তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে এসেছেন বাবর তার জন্য খুব একটা কঠিন হওয়ারও কথা নয়। সেটির জন্য বাবরকে বেছে নিতে হবে এক কঠোর সংগ্রামের পথ। ফিটনেস থেকে পারফরম্যান্স সব হতে হবে নিঁখুত; তবেই তিনি কোহলির রাজত্বের সমান কিংবা তারও বেশি কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন।

একজন নিরপেক্ষ ক্রিকেট ভক্ত হিসেবে সবাই নিশ্চয় চায় বিরাট-বাবর দ্বৈরথ স্থায়ী হোক আরও কিছুকাল। ক্রিকেটের আকাশে দুজনের সূর্য একই সাথে অবস্থান করে উত্তপ্ত করুক দর্শকদের। বাবর হয়ে উঠুক আরও ধারালো আর কোহলি জ্বলতে থাকুক আপন মহিমায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link