ভিভ রিচার্ডস, এক হেলমেটহীন বিদ্রোহ!

ভিভ রিচার্ডস শুধু খেলেননি, তাঁর প্রত্যেকটা শট ছিল একেকটা চিৎকার, একেকটা স্বাধীনতার গর্জন। আর সেই গর্জনে মিলিয়ে গিয়েছিল স্কোরবোর্ড, টিভি কমেন্ট্রি, রানের হিসাব। থেকে গিয়েছিল শুধু এক ‘অরা’ যা আজও ঘুরে বেড়ায় বাইশ গজ জুড়ে।

রান কিংবা রেকর্ডকে ভিভ রিচার্ডস বলতেন জহরত। যা রেখে যাওয়া যায়, সিন্দুকে ভরে রাখার মতো। কিন্তু রাজা তো সম্পদের মালিক নয়, রাজা হয় তাঁর চালচলনে, চোখের ভাষায়, উপস্থিতির গরিমায়। ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে চওড়া ব্যাটটা যখন উঠে আসে চোখে, সেই ব্যাটে লেখা থাকে একটাই নাম, ভিভ।

ফেনিল সাগরের মতোই তাঁর শরীর জুড়ে ছিল আত্মবিশ্বাসের ঝাপটা। সেই শরীর জুড়ে গেঁথে ছিল ইতিহাস, প্রতিরোধ আর গর্জনের নকশা। এমন মানুষরা জন্মায় না, তাঁরা তৈরি হয় সময়ের চাপে, জাতির আহবানে, ইতিহাসের দাবিতে।

ক্রিকেট ক্যারিবিয়ানদের কাছে শুধু খেলা নয়, ছিলো প্রতিশোধের ভাষা। ব্রিটিশদের সেই রাজসিক খেলাকে নিজেদের অস্ত্র বানিয়ে, তাঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছিল, কৃষ্ণাঙ্গরা দাস নয়, অচ্ছুৎ নয়, রক্তে মাংসের মানুষ। সমান গরিমার, সমান গৌরবের।

এই লড়াইয়ে ভিভ ছিলেন সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠ। তিনি কেবলই চার-ছক্কা হাঁকাতেন না, তিনি নিজের উপস্থিতি দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন যে, একজন কৃষ্ণাঙ্গও হতে পারে বিশ্বমঞ্চের সর্বোচ্চ আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা নায়ক। তাঁর হাঁটার ভঙ্গি, ব্যাট তোলার ঢঙ, চুইংগাম মুখে, খেলার আগে ক্যামেরার দিকে একটা হালকা তাকানো, একেকটা ঘোষণা, একেকটা বিপ্লব।

ক্রিকেট ভিভের জন্য কখনও রানের খেলা ছিল না। তাঁর কাছে ক্রিকেট ছিল এক ধরনের সাহসের চর্চা। রেকর্ড? সেগুলো থাকত জহরতের মতো সিন্দুকে। কিন্তু তিনি জানতেন— রাজা হয় ব্যক্তিত্বে, চলনে, চোখের ভাষায়।

তাঁর শরীরী ভাষায় ছিল মালভূমির বাতাস, ক্যালিপসোর সুর, আর হঠাৎ করে উঠে আসা একদম অনিয়ন্ত্রিত সাহস। ব্যাট তুলতেন, আর বল উড়ত বাউন্ডারির বাইরে। তাঁর চোখে ছিল এমন এক দৃষ্টি, যা বলত, ‘তুমি যদি ঔপনিবেশিক শাসক হও, তবে আমি সেই স্বাধীনতার ঘোষক যে ব্যাট দিয়ে ঘুম ভাঙাবে তোমার ইতিহাসের।’

এবং তিনি লড়েছেন। শুধু ব্যাট দিয়ে? উঁহু, বুক চিতিয়ে, ব্যাটটাকে তরবারি বানিয়ে। লিলি, থম্পসন, হ্যাডলি, ইমরানরা ছুঁড়ে দিতেন আগুনে বাউন্সার, আর তিনি দাঁড়াতেন হেলমেট ছাড়া, বুক ঠুকে। একেকটা হুক, একেকটা খুনে জবাব।

১৯৭৬, ইংল্যান্ড সফরের আগে ইংলিশ অধিনায়ক টনি গ্রিগ বলে বসেন, ‘আমরা ওদের আবার ঠাণ্ডা করে দেব।’ কালোদের প্রতি সেই ঔপনিবেশিক সুর। ভিভের ব্যাটে জবাব এলো, চার টেস্টে ৮২৯ রান। কাউকে ঠাণ্ডা করেননি, আগুনে পুড়িয়েছেন ইংলিশ বোলিংকে। এটাই ছিল তাঁর উত্তর, ব্যাটে লেখা এক ধরনের ইতিহাস, যার ভাষা কেবল সাহসীরা বোঝে।

১৯৭৫, প্রথম বিশ্বকাপে ফাইনালে তিনটি রানআউট। ১৯৭৯, দ্বিতীয় বিশ্বকাপে অপরাজিত ১৩৮ রান, ভিভ শুধু দলকে ট্রফি এনে দেননি, তিনি বিশ্ব ক্রিকেটকে চিনিয়েছেন ক্যারিবিয়ান লাল আগুনের ভয়ঙ্কর গন্ধ।

তিনি ছিলেন ইতিহাসের গায়ে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াত প্রতিপক্ষ বোলাররা, যারা জানত এই মানুষটাকে থামানো যায় না। ভিভ রিচার্ডস শুধু খেলেননি, তাঁর প্রত্যেকটা শট ছিল একেকটা চিৎকার, একেকটা স্বাধীনতার গর্জন। আর সেই গর্জনে মিলিয়ে গিয়েছিল স্কোরবোর্ড, টিভি কমেন্ট্রি, রানের হিসাব। থেকে গিয়েছিল শুধু এক ‘অরা’ যা আজও ঘুরে বেড়ায় বাইশ গজ জুড়ে।

Share via
Copy link