ওঁঝা, ম্যায় তুঝে মারুঙ্গা এক…

দক্ষিণ ভারতীয়রা স্বভাবগত ভাবেই উত্তর ভারতীয়দের থেকে বেশি ভদ্র, শান্ত হয়ে থাকেন। যেখানে হিন্দিভাষীদের কাছে বিভিন্ন বাছাই করা গালি ব্যবহার করা কোনো বড়ো ব্যাপার না, সেখানে দক্ষিণ ভারতীয়রা যেমন দ্রাবিড়, কুম্বলে, লক্ষ্মণ এরা একটু চুপচাপ, শান্ত ভাবে নিজের কাজটা করে যেতেই পছন্দ করতেন। এমন শান্ত স্বভাব ভিভিএস লক্ষ্মণ হঠাৎ তাঁর সতীর্থ, টিম মেট প্রজ্ঞান ওঝার উপর খাপ্পা হয়ে গেলেন কেন?

ব্যাপার আর কিছুই না, মোহালিতে ২০১০ সালের অস্ট্রেলিয়া সিরিজের প্রথম টেস্ট চলছে। দুই টেস্টের সিরিজ, তাই একটা হারলেই আর সিরিজ জয়ের স্কোপ নেই। আগের সিরিজ অস্ট্রেলিয়া নিজের দেশে জিতেছে তাই সিরিজ ড্র করলেই তারা বর্ডার গাভাস্কার ট্রফি নিয়ে যাবে দেশে। এই অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের ৪২৮ রানের জবাবে ভারত ৪০৫ অলআউট হয়ে গেছে। পিঠের অসহ্য ব্যথায় প্রথম ইনিংসে নিজের ব্যাটিং পজিশনে নামতেই পারেননি।

১০ নম্বরে নেমে মাত্র ৬ রানেই আউট হয়ে যান নাথান হারিজের বলে। দ্বিতীয় ইনিংসে বোলারদের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জোরে অস্ট্রেলিয়াকে ১৯২ অলআউট করে দিয়ে ভারত যখন অ্যাডিলেডের মত একটা চতুর্থ ইনিংসে জয় আশা করছে, তখনই বিপর্যয়! গম্ভীর, শেবাগ, দ্রাবিড়, রায়না ফিরে গেলেন প্রায় কোনো অবদান না রেখে! জহির খানকে পাঠানো হয় নৈশরক্ষক হিসেবে, তিনি একটা ছোট পার্টনারশিপ করেন শচীনের সাথে, কিন্তু পঞ্চম দিনের সকালে জহির ফেরেন, কিছুক্ষণ বাদে শচীন টেন্ডুলকার।

তার পরেই দলের অধিনায়ক ধোনি মাত্র ২ রানে আউট হতে দলের স্কোর দাঁড়ায় ১২২/৭ যেটা হরভজন ২ বল টিকেই আউট হতে দাঁড়ায় ১২৪/৮। বিপক্ষ দলে ম্যাকগ্রা, গিক্সপি, স্টার্ক বা কামিন্স ছিলেন না। ছিলেন হিলফেনহাস আর বোলিঙ্গার যাঁরা ৭ উইকেট নিয়ে ধ্বসিয়ে দেন ভারতীয় লাইন আপ। মিচেল জনসন থাকলেও তিনি চতুর্থ ইনিংসে উইকেট পাননি।

লক্ষ্মণ নেমেছিলেন যখন দলের রান ৭৬/৫! এক এক করে জাহির, শচীন, ধোনি আর হরভজন কে ফিরে যেতে দেখেছেন সাজঘরে। অস্ট্রেলিয়া রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে। রান বাকি ৯০ এর বেশি, উইকেট চাই মাত্র ২ টো! তার মধ্যে লক্ষ্মণ ইনজুর্ড, আর অন্যদিকে ইশান্ত আর ওঝা, যাঁদের ব্যাটিং দক্ষতার কথা বিশেষ কিছু শোনা যায়নি। এবারে কিন্তু তিনি, ভিভিএস, ইশান্ত শর্মাকে নিয়ে ডুবন্ত নৌকোর হাল ধরে তাকে তীরে ভেড়ানোর তোড়জোড় শুরু করলেন।

ইশান্ত শর্মাকে সম্ভবত নির্দেশ দিয়েছিলেন একটা দিক পুরো ঝাঁপ বন্ধ করে ডিফেন্স করে যেতে, বাকি রানটা তিনিই করবেন। ইশান্ত দুজনের পার্টনারশিপের অধিকাংশ বল খেললেন, ৯২ বলে ৩১ করে যখন এলবি হয়ে ফিরলেন, তখনও ১১ রান বাকি। লক্ষ্মণের ওই ভাঙ্গা পিচে অবিশ্বাস্য সব স্ট্রোক, পিঠের ব্যাথায় পুরোপুরি নিচু হতে না পারলেও!

তার সাথে ইশান্তের জমাট রক্ষণ হয়তো অস্ট্রেলিয়াকে একটু অধৈর্য আর হতাশ করে তুলেছিল, কিন্তু ইশান্তের এলবিডব্লিউ ( যদিও ভুল সিদ্ধান্ত) পেতেই তারা নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই সময়ে আবার লক্ষ্মণ পিঠের ব্যথায় শুয়ে পড়েন, শুশ্রূষা শুরু হয়। এক দশক আগের চেন্নাই টেস্টের স্মৃতি ফিরে আসে; এবারেও কি তাহলে শেষ রক্ষা হবে না?

কিন্তু না, লক্ষ্মণ বুদ্ধি করে রানার নিলেন, যেটা তখনও আইসিসি নিয়মে বৈধ ছিল। নামলেন সুরেশ রায়না। রানার থাকলে একটু রানিং বিটুইন দা উইকেট এ কনফিউশন হয়, কেননা কে চোটগ্রস্ত ব্যাটসম্যান, কে দৌড়াবেন, কে দাঁড়িয়ে থাকবেন এগুলো চট করে অ্যাডজাস্ট হয়না এবং তিনজনের মধ্যে কার কলে কে দৌড়াবেন, সেগুলো নিয়েও একটু ধোয়াঁশা থাকে।

এই পরিস্থিতিতে একবার লক্ষ্মণের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে প্রজ্ঞান ওঁঝা নিশ্চিত রানআউট থেকে বাঁচলেন। ওঁঝারই সম্ভবত ভুল ছিল, তিনি লক্ষ্মণের কল না শুনে বলের দিকে দেখছিলেন। রায়না প্রায় নন স্ট্রাইকার অবধি দু রান নেবার মত দৌড়ে আবার ফেরত আসেন। এরপরেই লক্ষ্মণ মেজাজ হারিয়ে ফেলেন, কেননা এটাই শেষ উইকেট, রান আউট মানে অস্ট্রেলিয়ার হাতে ম্যাচ তুলে দেওয়া।

ব্যাট দিয়ে মারার ভঙ্গি করে ওঁঝার প্রতি লক্ষ্মণের চিৎকার টিভিতেও শোনা গেছিল। এরপরে ওঝা আর কোনো ভুল করেননি। লক্ষ্মণ কে যোগ্য সঙ্গত করে এক অভাবনীয় রোমাঞ্চকর জয় এনে দেন ভারতকে।

গোটা ইনিংসে লক্ষ্মণ ৭৯ বল খেলে ৭৩* করেন, অন্যদিকে ইশান্ত একাই ৯২ বল, ধোনি ১৪ বল ও ওঁঝা ১০ বল খেলেন। অস্ট্রেলিয়া লক্ষ্মণ কে স্ট্রাইক না দিয়ে অন্যদিক থেকে উইকেট ফেলে দেবার ছক করলেও সেটা সফল হয়নি।

ম্যাচ জয়ের পরে ওঝা আর লক্ষ্মণের তৃপ্তির হাসি, সেলিব্রেশন, জড়িয়ে ধরা দেখে মনে হয়নি মিনিট দশেক আগের সেই ক্রুদ্ধ চিৎকারের কথা কেউই মনে রেখেছেন। কেননা দিনের শেষে, কেবলমাত্র দেশের জয় ম্যাটার করে, আর কিছু না।

যিনি দেশের বিপদের সময় একাধিকবার ভ্রাতা লক্ষ্মণের মতই বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেছেন, নিজের চোট আঘাত তুচ্ছ করে, তিনিই তো দ্য ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link