ক্রিকেটটা প্রথম শুরু হয় দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে; সেও মধ্যযুগের কথা।
সে সময় এটা ছিল স্রেফ শিশুদের খেলা। এরপর ধীরে ধীরে যখন সময় গড়িয়েছে, শিশু থেকে তরুণেরাও খেলাটায় নিজেদের নাম তুলেছে। তবে আমরা যে সময়ের গল্প বলছি, তাঁর সময়কাল একেবারেই নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
আজ আমরা প্রথম আর্ন্তজাতিক ম্যাচের গল্পে ঢুকবো। সেই সাথে শুনবো এমন একটা সময়ের কথা, যখন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের সেরা দল ছিল কানাডা! সেটা করার আগে আরেকটু পেছন থেকে আসা যাক।
ক্রিকেটের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, জনসম্মুখে খেলাটা আসে ১৫৯৭ সালে; সারের একটা আদালতে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের মামলাতে! ঠিক কি কারণে জমিজমার মামলাতে একটা খেলার নাম এসেছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে সে সময় মামলাতে “ক্রেকেট (creckett)” নামে একটা খেলার উল্লেখ পাওয়া যায়।
এরপর খেলাটা পুনরায় জনসম্মুখে আসে আবারও এক মামলাতে। তবে সে মামলাতে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তির কারণ আগেরটার মত ধোঁয়াশা-পূর্ণ নয়। ১৬১১ সালে সাসেক্সের আদালতে দুই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার কারণ হিসেবে বলা হয় ঐ দুই যুবক রবিবারে চার্চে না গিয়ে ক্রিকেট নামে একটা খেলা খেলছিল।
এই মামলাতে যুবক দুইজনের দন্ড হলেও, ক্রিকেট শব্দটা প্রথমবারের মত সে বছরই অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে অন্তর্ভুক্তির সময় বলা হয়েছিল- এটি মূলত ছেলেদের খেলা। তবে এই অন্তর্ভুক্তির পরও মানুষ যে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিল এমনটা মোটেও নয়! তবে এটাও মিথ্যে নয়, ক্রিকেট খেলাটা তখন থেকেই আস্তে আস্তে ছড়াতে শুরু করেছিল।
তবে আঠারোশো শতকের দিকে খেলাটিতে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে যায়- ইংল্যান্ড তাদের জাতীয় খেলা হিসেবে ক্রিকেটকে স্বীকৃতি দেয়। ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে খেলাটা তখন যাত্রা শুরু করে উত্তর আমেরিকার কলোনিগুলোতেও। ইতিহাসে এমনটা পাওয়া গেছে যে, ১৭৩৯ সালের দিকে নিউ-ইয়র্কের মানুষেরা ক্রিকেট খেলত। তবে তথ্য সংরক্ষিত আছে এমন প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট ম্যাচ প্রথমবারের মত খেলা হয় ১৭৫১ সালে।
সে সময় ম্যাচটি যে দুটি দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় সেটা ছিল মূলত ভার্জিনিয়ার দাসদের দুটি দল। তবে এরপর আবার প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট ম্যাচ খেলার তথ্য পাওয়া যায় ১৭৯৩ সালে; ডার্টমাউথ কলেজের ছাত্ররা সেবার নিজেদের মধ্যে এই ম্যাচটা খেলে।
তবে আমেরিকার জন্যে ক্রিকেটের প্রধান চর্চাক্ষেত্র হয়ে ওঠে ফিলাডেলফিয়া। সেসময় ১৮৩৩ সালের দিকে হেভারফোর্ড কলেজ প্রথমবারের মত একটা ক্রিকেট ক্লাব গড়ে তোলে। তবে এরপর ক্লাবটির নাম পাল্টে ‘সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাব’ হয়ে যায়। আর তা নিউ-ইয়র্কে স্থানান্তরিত হয়। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের সাথে এই ‘সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাব’ এর নাম জড়িত আছে। এবার আমরা সেই গল্পেই ঢুকবো।
ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৮৪০ সালে।
সে সময় সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাবের খেলোয়াড়েরা স্টিমারে করে নিউ ইয়র্ক পার হয়ে লেক অন্টারিওতে গেছিলেন। লম্বা ভ্রমণ করে খেলোয়াড়েরা ছিলেন ক্লান্ত। ঠিক এমন অবস্থায় দৃশ্যপটে আসেন জর্জ ফিলপটস নামের এক ব্যাক্তি; যিনি নিজেকে টরেন্টো ক্রিকেট ক্লাবের সেক্রেটারি বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাবের সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর দেশে এসে একটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে। খেলোয়াড়েরা সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়; তাঁরা টরেন্টোর দিকে যাত্রা শুরু করে।
লম্বা ভ্রমণ শেষে ১৮৪০ সালের ২৮শে আগষ্ট সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাবের খেলোয়াড়েরা কানাডার টরেন্টোতে পৌঁছে যায়। সে সময় যে ব্যপারটা ঘটে সেটাকে মজার বলব না দুঃখজনক বলব তা অবশ্য ঠাওর করা বেশ মুশকিল। কেননা, খেলোয়াড়েরা কানাডাতে পৌঁছালে দেখা যায়, তাদের জন্য বন্দরে কেউই আসেনি। এরপর তাঁরা টরেন্টো ক্রিকেট ক্লাবের খোঁজ করতে শুরু করলে টের পায়, জর্জ ফিলপটস আসলে একজন ধাপ্পাবাজ।
আমেরিকান এই খেলোয়াড়দের কানাডা আগমনের খবর তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে কানাডা এক অভিনব উদ্যোগ নেয়। ধাপ্পাবাজির আমন্ত্রন সত্যি করে দিয়ে, কানাডাই তখন একটা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করে। ম্যাচটার আয়োজন কিন্তু হয়েছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই ।
কানাডায় সে আমলেও ক্রিকেট অতটা জনপ্রিয় না হওয়া সত্ত্বেও সে ম্যাচে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক এসেছিল। ম্যাচ রাঙাতে একটা ব্যান্ডও এনেছিল কানাডা। তবে এটুকুই শেষ না, ম্যাচ দেখতে মাঠে এসেছিলেন স্বয়ং কানাডার গভর্নর স্যার জর্জ আর্থুর। সে ম্যাচে নিউ ইয়র্কের খেলোয়াড়েরা ১০ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে জিতে গেলেও, ম্যাচের মূল গুরুত্ব কিন্তু মোটেও এখানে নয়। বরং বলতে পারেন, মূল গল্পের শুরুটা এখানে।
ম্যাচ খেলে ফিরে যাবার সময়, সফরকারীরা কানাডাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসে আমেরিকাতে গিয়ে ম্যাচ খেলে আসার। কানাডার গভর্নরের উপস্থিতিতে কানাডাও সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সাদরে। ম্যাচ খেলতে পরে আমেরিকা যায় কানাডা।
ক্রিকেট ইতিহাসে সে ম্যাচটার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। কানাডাতে সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাব ম্যাচ খেলে এলেও আমেরিকাতে কানাডার সাথে যে দলটা ম্যাচে অংশ নেয় সেটা মোটেও একটা ক্রিকেট ক্লাবের দল নয়। বরং সে ম্যাচের জন্য ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি, বোসটন আর নিউ ইয়োর্ক থেকে সেরা খেলোয়াড়দের খুঁজে দল সাজানো হয়। দলটা ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ‘আমেরিকা’ হিসেবে; ম্যাচটা হয় ‘আমেরিকা বনাম কানাডা’ ক্রিকেট ম্যাচ। আর এটাই আসলে ক্রিকেট ইতিহাসে আন্তর্জাতিক দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম কোন ক্রিকেট ম্যাচ।
আমেরিকা কিভাবে দল সাজিয়েছিল সেটা তো বললামই, কানাডারটাও বলা যাক। সেখানে অবশ্য খুব বেশি খোঁজাখুঁজি নেই। দলটার বেশিরভাগ খেলোয়াড় নেওয়া হয়েছিল টরেন্টো ক্রিকেট ক্লাব থেকে। কিছু পরিমাণ ক্রিকেটার অবশ্য গুলেফ ক্রিকেট ক্লাব, ওয়েস্টার্ন অন্টারিও আর অন্টারিওর ‘আপার কানাডা কলেজ’ থেকেও ছিল।
ক্রিকেট ম্যাচের গল্প বলা যাক এবার। ম্যাচটা ছিল দুই দিনের। ম্যাচের শুরুতেই আমেরিকা টসে জিতেছিল আর ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ব্যাট করতে নেমে সব উইকেট হারিয়ে কানাডা করতে পারে মাত্র ৮২ রান। এরপর আমেরিকা ব্যাট করতে নামলে প্রথম দিন শেষে আমেরিকার স্কোর দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ৬১ রান।
প্রথম দিন শেষে আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় দ্বিতীয় দিনে আর ম্যাচটা মাঠে গড়ায়নি, এতে দুই দলের সম্মতিক্রমে ম্যাচটা তৃতীয় দিনে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তাতে ১ উইকেট হাতে নিয়ে খুব বেশিদূর যেতে পারেনি আমেরিকা। স্কোরবোর্ডে আর মাত্র ৩ রান যোগ করে তাঁরা অল-আউট হয়ে যায় মাত্র ৬৪ রানেই।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে কানাডা অল-আউট হয়ে যায় ৬৩ রানে, এতে আমেরিকার সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৮২ রানের। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে আমেরিকান ব্যাটসম্যানেরা গুটিয়ে যায় মাত্র ৫৮ রানে; ২৩ রানে ম্যাচ জিতে যায় কানাডা। এ ম্যাচে মজার যে ব্যাপারটা ঘটে তা হল-আমেরিকান ব্যাটসম্যান জর্জ হোয়েটক্রফট তৃতীয় দিন মাঠে আসতে দেরি করে ফেলেন আর তাঁর বদলি হিসেবে আলফ্রেড মার্শ ফিল্ডিংয়ে নেমে যান, যদিও তিনি ব্যাট করেননি।
ম্যাচ সংক্ষেপ
কানাডা বনাম আমেরিকা
তারিখ– ২৪-২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৪৪
ভেন্যু– সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাসব, নিউ ইয়োর্ক
দর্শকসংখ্যা– ২০ হাজার
আম্পায়ার– জে.এইচ কনোলি, এইচ রাসেল, আর ওয়ালার
প্রথম ইনিংস
কানাডাঃ ৮২ (উইংকওর্থ, শার্পে , ফ্রিলিং ১২ রান, রাইট ৫ উইকেট)
আমেরিকাঃ ৬৪ (টিনসন ১৪ রান, উইংকন ও ফ্রেঞ্চ ৪ উইকেট)
দ্বিতীয় ইনিংস
কানাডাঃ ৬৩ (উইংকওর্থ ১৪ রান, গ্রুম ৫ উইকেট)
আমেরিকাঃ ৫৮ (টার্নার ১৪ রান, শার্পে ৬ উইকেট)
ফলাফলঃ কানাডা ২৩ রানে জয়ী
এভাবেই ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটা জিতে নেয় কানাডা। এই ম্যাচের ঠিক এক বছর পর কানাডার সাথে আবার মাঠে নামে আমেরিকা। সে ম্যাচটা খেলা হয় মন্ট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে।
তারিখটা ছিল ৩০ জুলাই, ১৮৪৫। এ ম্যাচেও শুরুতে টস ভাগ্য সহায় হয় আমেরিকার, আর এবারও টসে জিতে তাঁরা ব্যাটিংয়ে পাঠায় আমেরিকাকে।
দুই দিনের এ ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে কানাডা প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়ে যায় ৮০ রানে, ম্যাচে কানাডার হয়ে সি জি বার্চ ২৯ রান করেন আর আমেরিকান বোলার হেনরি গ্রুম নেন ৬ উইকেট। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে আমেরিকা থেমে যায় কানাডার স্কোর থেকে ১ রান দূরে; ৭৯ রানে। কানাডার হয়ে এবার ৬ উইকেট শিকার করেন জর্জ শার্পে।
দ্বিতীয় ইনিংসে কানাডা গড়ে তোলে পাহাড়সম রান। বোলিংয়ে ছড়ি ঘোরানোর পর শার্পের ৩১ রানের অলরাউন্ডিং পারফর্ম্যান্স আর লেফটেন্যান্ট হর্নবির ৩৫ রানের সৌজন্যে কানাডার স্কোর থামে ১৩৫ রানে! আমেরিকার হয়ে সে ইনিংসে আবারও বোলিংয়ে উজ্জ্বল হেনরি গ্রুম, নেন ৪ উইকেট।
যা হোক, দ্বিতীয় ইনিংসে আমেরিকার সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৩৭ রানের, যা মোটামুটি সে সময় কঠিনই বলা চলে। তা উইংকওর্থ একাই ৮ উইকেট নিয়ে সেই ‘কঠিন’কে করে তোলেন ‘অসম্ভব’; আমেরিকাকে দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে দেন মাত্র ৭৫ রানে। এবারও ম্যাচ জিতে নেয় কানাডা।
সে বছর শেষদিকে আবারও কানাডার সাথে ম্যাচ খেলতে নামে আমেরিকা; এবার ভেন্যু ছিল নিউ ইয়র্ক। তা দানে দানে তিন দান হয়ে এবারও কানাডা ম্যাচ জিতে নেয় দুই উইকেটে। সে সময়ে কানাডা চাইলে কিছু সময়ের জন্য নিজেদের সেরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেশ বলে দাবি করতে পারত, যদিও সেরকম কোন দাবি তাঁরা করেনি বলেই ইতিহাসে পাওয়া যায়।
আমেরিকার সাথে কানাডার এই তিন জয়ে একটা বেশ বড়সড় লাভ হয়ে যায় ক্রিকেটের। কানাডাতে ক্রিকেট সে সময় জনপ্রিয় হতে শুরু করে, একটা অংশ তো ক্রিকেটকে জাতীয় খেলা করার দাবিও করে। এরপর ১৮৬৭ সালে, কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জন এ. ম্যাকডোনাল্ড দেশটির প্রথম জাতীয় খেলা হিসেবে ঘোষণা করে ক্রিকেটকে!