পুরো দলই যখন ম্যাচ সেরা!

ক্রিকেট, খেলাটাকে আপনারা দলগত খেলা হিসেবেই জেনে থাকবেন। কিন্তু ক্রিকেট খেলার রঙ তো এটাই, অন্য যেকোন খেলার চেয়ে ক্রিকেটে ‘একজন খেলোয়াড়’ এখানে অনেক বেশি অর্থ বহন করেন, যোগান দেন অনেক বেশি অবদানের!

একবার ভাবুন তো, বোলার বল করতে দৌড়ে আসছেন, ব্যাটসম্যান সেই বলকে মোকাবেলা করছেন, এই ছোটখাট যুদ্ধই তো ক্রিকেট ম্যাচটার গতি, বাঁক আর ফলকে নির্ধারণ করে।

তাই তো, ক্রিকেট খেলার ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়া হয় একজন খেলোয়াড়কে, হতে পারে সে কোন বোলার বা ব্যাটসম্যান, যে কিনা ঐ দিনের খেলাতে সবচাইতে বড় অবদানটা রাখেন!

তবে ব্যাপারটি কিন্তু একদমই এমন নয় যে জয়ী দলের খেলোয়াড়ই শুধু ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের মুকুট পরে থাকেন। ঐ ম্যাচের সেরা পারফর্ম্যান্স পরাজিত দলের কোন খেলোয়াড় করে দেখিয়েছেন, এমন ঘটনা তো কম দেখেনি ক্রিকেট!

কিন্তু, একটা দলের সবগুলো খেলোয়াড় একই সাথে ম্যাচ সেরা হয়েছেন, এমন কি কখনও হয়? অদূর ভবিষ্যতে দূরবীন দিয়ে আপনি হয়তো এই ঘটনা মনে করতে পারছেন না, তাতে আপনাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কেননা, ক্রিকেটের এই ১৪২ বছরের লম্বা পথচলাতে এমন ঘটনা ঘটেছে সাকল্যে মাত্র তিন বার – একবার টেস্ট ক্রিকেটে আর বাকি দু’বার ওয়ানডেতে!

ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় যে একটা দলের পুরো ১১ জনই ওইদিন ম্যাচটার সেরা পারফর্ম্যান্স দেখিয়েছেন একই সাথে। এটা অনেকটা স্যুভনিরের মত যেটা কিনা প্রমাণ করে – ক্রিকেট একটি দলগত খেলা। তো দেখা যাক, সেই তিনটে ঘটনার আদ্যপান্ত।

  • ৩ এপ্রিল,১৯৯৬। চতুর্থ ওয়ানডে, নিউজিল্যান্ডের উইন্ডিজ সফর

জর্জটাউনে সেবার নিউজিল্যান্ড উইন্ডিজকে হারিয়ে দিল ৪ রানের ব্যবধানে। ম্যাচটা খেলতে নামার আগে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটা নিউজিল্যান্ড পিছিয়ে ছিল ২-১ ব্যাবধানে। কিউই পাখির ছানারা জানত, সিরিজ বাঁচাতে ম্যাচটা জিততেই হবে যেকোন ভাবে।

তবে বাঁচা মরার এই ম্যাচের শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না ব্লাকক্যাপদের। কোর্টনি ওয়ালশের বোলিং তুবড়িতে নিউজিল্যান্ড গুটিয়ে যায় মাত্র ১৫৮ রানে। ক্রেইগ স্পিয়ারম্যান ব্লাক ক্যাপদের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪১ রান করেন, এছাড়া লি জার্মন, নাথান অ্যাস্টল আর ক্রিস কেয়ার্নস ছাড়া কেউ দুই অঙ্কেই যেতে পারেনি।

তবে ক্লোজ এই ম্যাচে নিউজিল্যান্ড হাল ছেড়ে দেয় না। দীপক পাটেলকে টানা তিনটে বাউন্ডারি মারা ব্রায়ান লারাকে প্যাভিলিয়নে ফেরানো গেভিন লারসেনই কিউইদের সবচাইতে বড় ব্রেকথ্রুটা এনে দেয়। মূলত ব্রায়ান লারার সাথে স্টুয়ার্ট উইলিয়ামস ফিরে গেলে ম্যাচটা পেন্ডুলামের মত এদিক ওদিক দুলতে থাকে আর ৪৯.১ ওভারে জয় থেকে মাত্র ৪ রান দূরে থেকে উইন্ডিজকে পরাজয় মেনে নিতে হয়।

  • ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬। পাকিস্তানের ইংল্যান্ড সফর, তৃতীয় ওয়ানডে

ক্রিকেটের এই একদমই ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ ঘটনা একই বছরে ঘটেছে আরেক বার। ম্যাচটা ছিল তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ। প্রথম দুটো ম্যাচ হারায় পাকিস্তান চাচ্ছিলো এই ম্যাচটা যেকোনভাবে হোক জিততে। তা তারা শেষ পর্যন্ত জিতেও গেছিল।

তবে পাকিস্তানের গলার কাঁটা হিসেবে ক্রিজে টিকে ছিল নিক নাইট। ইংলিশ এই ব্যাটসম্যান ১২৫ রানের ধ্রুপদী ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডের রান নিয়ে সায় ২৪৬ এ! ভাবা হচ্ছিল, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ তখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

তবে আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তানের পিঠ তখন দেয়ালে ঠেকে গেছিল। ২৪৭ রানের তাড়াতে পাকিস্তানকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন সাঈদ আনোয়ার। তবে ৬১ রানে সাঈদ আনোয়ার প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলে দ্রুত আরও এক উইকেট পড়ে যায় পাকিস্তানের। ১১৪/২ যখন স্কোরবোর্ডের অবস্থা, তখন ৬৩ রানের পার্টনারশিপ গড়েন আমির সোহেল ও ইজাজ আহমেদ। শেষ অব্দি রশিদ লতিফের ২৮ বলে ৩১ রানে পাকিস্তান ম্যাচটা জিতে নেয় ২ বল আর ২ উইকেট হাতে রেখেই। এই ম্যাচেও ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়া হয় পাকিস্তান দলের সবাইকেই।

  • জানুয়ারি ১৫-১৮, ১৯৯৯। পঞ্চম টেস্ট, উইন্ডিজ দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর

একটা দলের সবাই ম্যাচ সেরা এমন ঘটনা টেস্ট ক্রিকেট দেখেছে মাত্র একটি। আর সেটি ১৯৯৯ সালে। এমনিতেই পুরো সফরটাই উইন্ডিজের জন্য চলছিল ভুলে যাওয়ার মত। তবে পঞ্চম টেস্টে এসে বিশেষ কিছু করে দেখাবার ইচ্ছেটা দমাতে পারছিল না উইন্ডিজ। আর তাই তো, আগে ব্যাট করা প্রোটিয়াদের মাত্র ১৮ রানে তুলে নেয় ৩ উইকেট! তবে শুরুর এই ধকল বেশ ভালোভাবেই সামলে নেন জ্যাক ক্যালিস আর মার্ক বাউচার। মূলত জ্যাক ক্যালিসের ৮৩ রানই প্রোটিয়াদের ম্যাচে ফিরতে রেখেছিল বড় ভূমিকা।

তবে প্রোটিয়াদের প্রথম ইনিংসে ৩১৩ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ব্রায়ান লারা ছাড়া কেউই তেমন সুবিধা করতে পারেননি। মাঝের দিকে শিবনারায়ণ চন্দরপল কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে চেষ্টা করলেও ৩৮ রানে তিনি ফিরে গেলে উইন্ডিজ শেষ অব্দি ১৪৪ রানে অলআউট হয়ে যায়।

দুর্বল উইন্ডিজকে এরপর আরও ধরাশায়ী করে প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানেরা। ৩৯৯ রানের স্কোর গড়ে উইন্ডিজের সামনে ছুঁড়ে দেয় লম্বা রানের তাড়া। এমনিতেই সিরিজটা বেশ কঠিন যাচ্ছিল উইন্ডিজের, এর ওপর এই রানের পাহাড়ের নিচে পড়ে হাঁসফাঁস করতে থাকা উইন্ডিজ ২১৭ রানের বেশি টিকতে পারেনি। ম্যাচটা দক্ষিণ আফ্রিকা জিতে নেয় ৩৫১ রানের ব্যাবধানে। এই ম্যাচে ম্যাচসেরার পুরস্কার দক্ষিণ আফ্রিকার ১১ জনের হাতেই তুলে দেওয়া হয়!

১৯৯৯ সালের পর হয়তো ক্রিকেটে আর একটা দলের সবাইকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়া হয়নি। কিন্তু ১৪২ বছরে এই তিনটে ঘটনাই প্রমাণ করে না যে ক্রিকেট একটি দলগত খেলা?

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link