স্মরণকালের গভীরতম দু:সময় পার করছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট। একদিকে ১০ দলের বিশ্বকাপে নবম হয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসির টুর্নামেন্ট মিস করার তিক্ততা। অন্যদিকে এই দু:সময়ে প্রলেপ না দিতেই আইসিসি কর্তৃক ক্রিকেট বোর্ডের সদস্যপদ স্থগিতের ঘোষণা। সব মিলিয়ে বেহাল দশায় রয়েছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট। আর এমন অবস্থা থেকে তাঁরা সহসাই উত্তরণ ঘটাতে পারবে কিনা তা নিয়েও তৈরি হয়েছে প্রবল সন্দেহ।
এবারের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার অবস্থা কতটা নাজুক ছিল তা পরিলক্ষিত হয়েছে মাঠের পারফরম্যান্সেই। ৯ ম্যাচ একবারই মাত্র তাদের ওপেনিং জুটি ২৫ পেরিয়েছে। টপ অর্ডারের অন্যতম ভরসা পাথুস নিসাঙ্কা গড়পড়তা একটা আসর পার করেছেন বটে। ৪১.৫০ গড়ে করেছেন ৩৩২ রান। তবে সেই রান শ্রীলঙ্কার কাজে এসেছে অতি নগণ্যই। বরং তাঁর মন্থর গতির ব্যাটিং ভুগিয়েছে গোটা দলকে।
অপর ওপেনার কুশাল পেরেরা যদিও বা ওপেনিংয়ে নেমে আক্রমণাত্বক ব্যাটিং করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গড়ের দিক দিয়ে আবার এ ব্যাটার পেরোতে পারেন ২৫ এর ঘর। ৭ ম্যাচে করেছেন মোটে ১৪৯ রান।
গোটা বছর ধরেই ছন্দে ছিলেন কুশল মেন্ডিস। এশিয়া কাপের পর বিশ্বকাপের শুরুতেও ছিলেন রানের ভিতরে। প্রথম ম্যাচে ৭৬ রান করার পর পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১২২ রানের ইনিংস। কিন্তু যেই না অধিনায়কত্বে গুরুদায়িত্বর তাঁর কাঁধে পড়লো, তখনই যেন চাপে নুয়ে পড়লেন এ ব্যাটার। প্রথম দুই ম্যাচেই ১৯৮ রান তুলে ফেলা মেন্ডিস পরের ৭ ম্যাচে রান করলেন মাত্র ১৩.৭১ গড়ে। যেখানে একবারের জন্যও লঙ্কান এ ব্যাটার পেরোতে পারেননি চল্লিশ রান।
টপ অর্ডারদের মতো ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী ছিল মিডল অর্ডার ব্যাটাররাও। সাদিরা সামারাবিক্রমা, চারিথ আসালাঙ্কা কিছু ম্যাচে জ্বলে উঠলেও তা জয়ের নির্ধারক হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া শেষ ১০ ওভারে রান তোলার দিক দিয়েও শ্রীলঙ্কা এবারের বিশ্বকাপে ছিল সবার পিছনে। ইনিংসের শেষ ১০ ওভারে ৮৩.৪৩ স্ট্রাইকরেটই তার অকাট্য প্রমাণ।
ব্যাটিংয়ের মতো লঙ্কান শিবিরে বড় ব্যর্থতা হয়ে এসেছিল তাদের বোলিং ইউনিটেও। দিলশান মাদুশাঙ্কা ২১ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীদের দৌড়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি বাদে আর একজন বোলারও নিতে পারেননি ৮ উইকেটের বেশি। সবচাইতে নাজুক অবস্থা ছিল স্পিনারদের। ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার অভাব তো কেউ মেটাতে পারেই নি, উল্টো টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বাজে স্পিন ইউনিটের তালিকার শীর্ষে ঠাই হয়েছে লঙ্কান স্পিনারদের।
পুরো টুর্নামেন্টে তাদের স্পিনাররা নিতে পেরেছে মাত্র ১১ টি উইকেট। যা ১০ দলের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া বোলিং গড়ের দিক দিয়েও লঙ্কান স্পিনাররা রয়েছে সবার তলানিতে। মাহিশ থিকশানা কিংবা দুনিথ ভেল্লালাগে, কেউই প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে পারেননি। প্রতিপক্ষের উইকেট তুলে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। একই সাথে ব্যর্থ হয়েছে রান আটকাতেও। আর তাই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বল হাতে তেমন কোনো ম্যাচেই প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি লঙ্কান বোলাররা।
বিশ্বকাপ ব্যর্থতাকে এক পাশে রাখলেও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট গত কিছু দিন মাঠের পাশাপাশি মাঠের বাইরেও টালমাটাল সময় পার করছে। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডে (এসএলসি) ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে অভিযোগ করে ক্রীড়ামন্ত্রী রোশান রানাসিংহে বোর্ডের কর্তাদের ওপর অনেক দিন ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন। গত সপ্তাহে দেশটির পার্লামেন্টে ক্রিকেট বোর্ডকে পদত্যাগ করতেও বলা হয়।
এর দুই দিন পর ক্রীড়ামন্ত্রণালয় শাম্মি সিলভার নেতৃত্বাধীন বোর্ডকে বরখাস্ত করে অর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে অন্তবর্তী কমিটি করে, যা আদালতের আদেশে আপাতত দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত রয়েছে। আর এমন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই শ্রীলঙ্কার সদস্যপদ স্থগিত করে আইসিসি।
যদিও এরই মধ্যে জানা গিয়েছে, আইসিসির এমন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আপিল করবে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড। তারপরও এখন পর্যন্ত অনিশ্চয়তার বেড়াজালেই আটকে থাকতে হচ্ছে দেশটির ক্রিকেটকে। অবশ্য সব কিছুর সুরাহা হলেও শ্রীলঙ্কা এই ব্যর্থতা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
অথচ, এই দলটিই এবারের এশিয়া শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে রানার্সআপ আর আগের বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু হঠাতই ছন্দপতন হলো দলটির। দিশেহারা এই শ্রীলঙ্কা কীভাবে ক্রিকেটে ফেরে, কেমনভাবে ফেরে, সেটিও থাকবে বিশ্ব ক্রিকেটের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।