পিটার ড্রুরি, ফুটবল ধারাভাষ্যের কবি

ফুটবল ধারাভাষ্যে প্রবাদপ্রতিম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব তিনি। মাইক্রোফোনের গর্জনে মাঠের ফুটবলার মেসি, রোনালদো, নেইমারদের আরো প্রাণবন্ত রূপে গোটা বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি নেই। মেসির একেকটা ড্রিবলিং কিংবা রোনালদোর আলোকঝলকানির সব দৃশ্যে তাঁর নান্দনিক, কাব্যিক শব্দের মিশেলেই সেই মুহূর্তগুলো হয়ে ওঠে আরো আইকনিক। তাঁকে বলা হয় ‘পয়েট অব ফুটবল’। বলছি বিখ্যাত ফুটবল ধারাভাষ্যকর পিটার ড্রুরির কথা।

বিখ্যাত এ ধারাভাষ্যকর এবার কাতার বিশ্বকাপেও ধারাবিবরণী দিচ্ছেন। পিটার ড্রুরি ধারাবিবরণী দিচ্ছেন, অথচ তাঁর কোনো ব্যবহৃত লাইন লাইম লাইটে আসবে না তা কি করে হয়! এরই মধ্যে ড্রাউরির বেশকিছু ম্যাচের কমেন্ট্রি পুরো বিশ্বে নাড়া দিয়েছে। বরাবরের মতো এবারও তিনি মুগ্ধতা ভাসিয়েছেন তাঁর শব্দচয়ন দিয়ে। সাধে কি আর তাঁকে ফুটবল ধারাভাষ্যের কবি বলা হয়!

মেক্সিকোর বিপক্ষে মেসি যখন গোল দিয়ে আর্জেন্টিনাকে বাঁচালেন তখন ড্রুরির ঐ একটা লাইনই তো পুরো আর্জেন্টাইন সমর্থকদের আলোড়িত করতে যথেষ্ট ছিল। মেসি গোল করলেন। তিনি মাইক্রোফোনে তাঁর গর্জন তুলে বললেন, ‘ইট কেম ফ্রম হিভেন’। মাইক্রোফোন থেকে ভেসে আসা এই একটি লাইনই যেন মেসির সেই অসাধারণ গোলটিকে পূর্ণতা দিয়েছিল। পিটার ড্রুরির ধারাবিবরণীতে কাব্যের মিশেল এখানেই শেষ নয়। মরক্কোর রুপকথাময় বিশ্বকাপ যাত্রায় তাঁর প্রতিটা শব্দ যেন সহস্র দর্শককে আরো বেশি রুপকথার রাজ্যে ভাসিয়ে দিয়েছিল।

৫৫ বছর বয়সী পিটার ড্রাউরি ইংল্যান্ডের নাগরিক। চার বছর বয়স থেকেই তিনি ওয়েস্টহ্যাম সমর্থক। অবশ্য পেশাদারিত্বের কারণে সেই সমর্থনের তীব্রতা তাঁর অনেক আগেই কমে গেছে। বর্তমানে এ ধারাভাষ্যকার বি টি স্পোর্টসের হয়ে মেজর সব ইভেন্টগুলো কাভার করেন। পাশাপাশি রেডিওতে মাঝেমধ্যে ধারাবিবরণী দেন।

পেশাদারিত্বের বাইরে পিটার ড্রাউরি পুরোদস্তুর একজন ফ্যামিলি ম্যান। ১৯৯০ সালে বিয়ে করেছিলেন ভিকি ড্রুরিকে। তাদের সেই যুগলবন্দী এখনো টিকে আছে। তিন সন্তান নিয়ে সুখী এক ফ্যামিলি ‘ড্রুরি ফ্যামিলি’।

যাহোক, পিটার ড্রাউরির বায়গ্রাফি এই লেখার উপজীব্য বিষয় না। ফুটবলার ছিলেন না, কিন্তু ফুটবলটাকে মিলিয়ন দর্শকদের কাছে আর প্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই পিটার ড্রাউরি অবদান অনেক। তাঁর কথামালায় ফুটবলটা টেলিভিশনের অপর প্রান্তে দর্শকদের কাছে হয়ে ওঠে আরো বেশি নান্দনিক, আরো বেশি আবেগীয় মুর্ছনায় ভেসে যাওয়ার মতো। পিটার ড্রুরি সেই সব বিখ্যাত ধারাবিবরণীর এক ফালি নিয়েই মূলত এই লেখাটা। চলুন দেখে নেওয়া যাক।

  • ম্যানচেস্টার ডার্বিতে স্কট ম্যাকটমিনাইয়ের গোল

ম্যানচেস্টার ডার্বি। উত্তাপ তাই একটু বেশিই। ম্যান ইউ ১-০ গোলে এগিয়ে। তবে রেফারির শেষ বাঁশি বাজার আগেই ম্যাকটমিনাই দূরপাল্লার এক শটে ফাঁকা গোলপোস্টে বল জড়িয়ে ফেললেন। আর সেই উত্তাপ আরো দ্বিগুণ গতিতে ছড়িয়ে গেল পিটার ড্রুরির মাইক্রোফোনের গর্জনে। তিনি বলেন উঠলেন, ‘আ রেড লেটার ডে, স্কট ম্যাকটমিনাই, এডারসন স্টে টু হাইড, ইটস শোলজারস ডে টু লুক টু প্যারাডাইজ এন্ড আই হ্যাভ ডান আ ডাবল ওভার দ্য নেইবারস।’

  •  লেস্টারসিটির বিপক্ষে ভিনসেন্ট কোম্পানির গোল

২০১৯ সালে ইপিএল শিরোপার একদম কাছাকাছি ছিল পেপ গার্দিওলার ম্যানসিটি। প্রয়োজন ছিল শুধু একটি জয়। আর সে জয়টা আসে লেস্টারসিটির বিপক্ষে। ম্যানসিটির অধিনায়ক ভিনসেন্ট কোম্পানি প্রথমে এগিয়ে দেন দলকে। আর ঐ গোলের পরে পিটার ড্রাউরি মাত্র দুই শব্দেই ম্যানসিটি সমর্থকদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দেন। তিনি বলে ওঠেন, ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক।’

মাত্র দুটি শব্দ।  কিন্তু সেই গোলের দৃশ্য এখনো দেখলে শুধু কমেন্ট্রির গর্জনেই ম্যানসিটি সমর্থকদের লোম দাঁড়িয়ে যায়।

  • গোল ফর অল আফ্রিকা 

২০১০ বিশ্বকাপ। মেক্সিকোর বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচ খেলতে নেমেছিল স্বাগতিম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথমবারের আফ্রিকান দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন। তাই সে বিশ্বকাপ ঘিরে উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। আর সেই উন্মাদনা আরো বহুগুণে বেড়ে গেল যখন দক্ষিণ আফ্রিকার শাবালালা প্রথম গোল এনে দিলেন। সে ম্যাচের কমেন্ট্রি বক্সে ছিলেন পিটার ড্রাউরি। ঐতিহাসিক এমন মুহূর্তে তাই তিনিও মাইক্রোফোন সামনে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘গোল ফর সাউথ আফ্রিকা, গোল অর ফর অল আফ্রিকা।’

  • ম্যানসিটির জার্সিতে সার্জিও অ্যাগুয়েরোর সেই ঐতিহাসিক গোল

আগুয়েরোর ক্লাব ক্যারিয়ারে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি? কোনো রকম ভাবনার ধন্দে না পড়েই বলে দেওয়া যায়, ২০১১-১২ মৌসুমে অতি নাটকীয়ভাবে আগুয়েরোর গোলে ম্যানচেস্টার সিটির ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জেতার মুহূর্ত। সেবার কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের সাথে লিগের শেষ ম্যাচটা জিতলেই প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতত ম্যানসিটি। কিন্তু ম্যাচের প্রায় নব্বই মিনিট ঘনিয়ে আসলেও ম্যানসিটি সে ম্যাচে পিছিয়ে ছিল ২-১ গোলে। এমন সমীকরণে অপর প্রান্তে খেলতে থাকা ম্যানইউ প্রায় শিরোপা যাচ্ছিল।

কিন্তু ম্যানসিটি গোল দিয়ে সমতায় এনে আবারো স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। কিন্তু স্বপ্ন দেখালেই তো হবে না। শিরোপা জিততে আরো একটি গোল তখন লাগবেই লাগবে। মরিয়া হয়ে উঠছিল ম্যানসিটির খেলোয়াড়রা। সাথে স্টেডিয়ামে থাকা ম্যানসিটি সমর্থকদের চাহনিও ছিল অনিশ্চয়তা ভরা। তবে সব অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে ম্যাচের ৯৩ মিনিটে গোল করে বসেন সার্জিয়ো আগুয়েরো।

আর সেই ঐতিহাসি মুহূর্ত যেন ফেটে বেরিয়ে আসছিল পিটার ড্রুরির কমেন্ট্রিতে। তিনি বলে উঠলেন, ‘অ্যাগুয়েরো! ইটস জাস্ট দ্য মোস্ট এক্সট্রা অর্ডিনারি সিনারিও ইউ কুড হ্যাভ ড্রিমট আপ।’

  • ওয়েইন রুনির বাইসাইকেল গোল

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে আজীবন রাইলভালরি ম্যানচেস্টার সিটির। আর ২০১১ সালে এক ম্যাচে তখনকার ম্যান ইউ তারকা ওয়েইন রুনি দারুণ বাইসাইকেল কিক দিয়ে করে বসলেন গোল। এমন গোলের পর তো পিটার ড্রাউরিরই তো কথা ভেসে আসা উচিৎ। সৌভাগ্যক্রমে, সে ম্যাচে মাইক্রোফোন হাতে ছিলে ঐ পিটার ড্রাউরিই। এমন গোলের পর তিনিও উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠেন, ‘হোয়াট আ গোল, এট হোয়াট আ টাইম, ইন হোয়াট আ প্লেস, হোয়াট আ প্লেয়ার।’

  • গ্রিক গড ইন রোমা

চ্যাম্পিয়ন লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। আগের লেগেই ৩-১ গোলে জিতেছিল বার্সেলোনা। রোমার মাঠে তাই নির্ভারই ছিল মেসির বার্সা। কিন্তু কী নিয়তি! এ ম্যাচে ৩-০ গোলে হেরে অপ্রত্যাশিতভাবে বাদ পড়ে যায় বার্সেলোনা। আর সে ম্যাচে কস্তাস মানোলাসের যে গোলে বার্সার বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায়, সে গোলের পরেই পিটার ড্রাউরি বলে ওঠেন, ‘গ্রিক গড ইন রোমা!’

পিটার ড্রুরির যে শুধু গোলের পরের লাইনগুলোই বিখ্যাত তা কিন্ত নয়। তিনি তাঁর ২০ বছরের ক্যারিয়ারে অনেক দলের বিদায় গাঁথাও তাঁর কাব্যের মুর্ছনায় পুরো বিশ্বকে শুনিয়েছেন। এর মধ্যে একটি হলো, ২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে ইংল্যান্ডের বাদ পড়ার পর। সেখানে তিনি বলেন, ‘দ্য থ্রি লায়নস ওয়ের টুথলেস, ভয়েসলেস অ্যান্ড দেয়ার ড্রিম ইন ট্যাটারস। ইটস নট কামিং হোম, ব্রিটেইন, ইট হ্যাজ জাস্ট লিম্পড অ্যাওয়ে, মে বি ফরেভার।’

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, পিটার ড্রাউরির কন্ঠে মেসি কিংবা রোনালদোর গোলের একটিও কি বর্ণনা নেই? অবশ্যই আছে। তবে পিটার ড্রাউরি তাদের এত সংখ্যক গোলে কণ্ঠ বাজিয়েছেন যে তাঁর কাব্যে সেই লেখা একটা মহাকাব্য হতে পারে। মেসি, রোনালদো আর পিটার ড্রাউরি নিয়ে শুধু একটি অধ্যায় হতে পারে।

পিটার ড্রুরিকে নিয়ে এখন শুধু একটিই কামনা, আরো কিছু বছর, তাঁর এই পোয়েটিক সব ধারাবিবরণী চলতে থাকুক। কারণ ফুটবল টা তো লক্ষ কোটি সমর্থকদের কাছে এই পিটার ড্রাউরিদের জন্যই এত বেশি সুন্দর। একটা ম্যাচের পর প্রিয় খেলোয়াড়ের গোলের গালগল্পের পিছনে তো ঐ স্বল্পকথার কাব্যগুলোই বেশি বাজে। আর ওটাই তো খেলোয়াড়দের সেলিব্রেশনকে আরো পূর্ণতা এনে দয়।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link