এমন চিত্রনাট্য ভেবেছিল কে!

২০১৫-২০১৬ সালের কথা। বাংলাদেশ ক্রিকেট তখন হাওয়ায় উড়ছে। বসন্তের বাতাসে প্রেমিকার আচল ওড়ার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার মত করে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ঐ মৌসুমটা দেখছিলাম আমরা। কিন্তু ঐ যে হয়না, সব প্রাপ্তির খোঁজ করতে গেলে অপ্রাপ্তির হিসেব আসে। আমাদেরও একটা অপ্রাপ্তি ছিল। দেশের ভেতরে জয়ের পতাকা উড়ছে, মিরপুরে এসে মাথা নিচু করে ফিরে যাচ্ছে রথী মহারথীরা, কিন্তু দেশের বাইরে হবে তো?

বাংলাদেশের সামনে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত সুযোগ এসেছিল ২০১৭ সালে। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একেকটা ওয়ানডের আগে কি তিতীক্ষাতেই না আমি বসে থাকতাম টিভি স্ক্রিনের সামনে। আমার মনে হত, সিরিজ জেতা লাগবেনা। একটা , মাত্র একটা ওয়ানডে যদি আমরা জিততে পারতাম। সেবার ওয়ানডে সিরিজের জার্সিটা দারুণ বানিয়েছিল, কে ডিজাইন করেছিল মনে করতে পারিনা।

সম্ভবত মুশফিক তিন ওয়ানডের একটা ম্যাচে ভাল খেলেছিলেন। স্মৃতির পাতা হাতড়ে একদম পাই টু পাই হিসেব দিতে পারছিনা। মুশফিকের সাথে এক ম্যাচে কায়েসও মনে হয় ভাল খেলেছিলেন। কিন্তু, তাও! একটা ম্যাচ আর জেতা হয়না আমাদের।

তবে না জিতলেও হয়তো ক্ষতি ছিল না, যদি একটুখানি লড়াই করতে পারত সাধের দলটা। তাও তো হচ্ছিল না। ওই সিরিজে বাংলাদেশের সাথে যেটা হয়েছিল সেটাকে আসলে হিউমিলিয়েশন বললেও কম বলা হয়। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটা আমরা হেরেছিলাম দশ উইকেটে। হ্যা, একদম দশ উইকেটে। বাংলাদেশের দেওয়া ২৭৯ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা একটা উইকেটও হারায়নি, বাংলাদেশও ৪৩ ওভার বল করেও একটা উইকেটও নিতে পারেনি।

এরপরের দুই ম্যাচের গল্প ছিল আরো করুণ। দ্বিতীয়টা ১০৪ রানে, আর তৃতীয়টা বাংলাদেশ হেরেছিল ২০০ রানের বিশাল ব্যাবধানে। বাংলাদেশকে নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঐ সিরিজ থেকে ফিরেই ছিল বিপিএলের আসর। ঐ সিরিজে এতটাই অসহায় ছিল বাংলাদেশ, এতটা হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হয়েছিল যে লিটন দাস বিপিএলের মাঝে একটা সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ভুত এখনও তাড়া করে ফিরছে তাঁদের।

নাহ, সেই ভুত বহুদিন যায়নি দল থেকে। এরপর বহু চন্দ্রভূক অমাবশ্যা চলে গেছে, বড় হতে হতে সুনীলের মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে ছাদ, নাদের আলীর মত তিন প্রহরের বিল দেখাতে যাবার অপূর্ণ সাধের মত বাংলাদেশও আর দেশের বাইরে ম্যাচ জিততে শেখেনি।

আমার মনে আছে, ঐ সিরিজটাই আমাদের বাস্তবতা শিখিয়েছিল। দেশের ভেতরে জিতলেও যে দেশের বাইরে আমরা এখনও প্রকান্ড কোন দল হয়ে উঠিনি তা বুঝতে শিখিয়েছিল ঐ সিরিজটাই। কিন্তু বুঝলে কি হবে, ম্যাচ আর জিততে পারিনি আমরা।

আর তাই, যখন মাহমুদউল্লাহর রিভিউতে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে নিলেন আম্পায়ার । আমার ঐ ২০১৭ সালের কথাই মনে হচ্ছিল। সেবার আমরা ভেবেছিলাম, আমরা জিতব। বিনিময়ে ফিরেছিলাম একরাশ অপমান নিয়ে। এবার আর সেরকম আশা করিনি, আর তাতে এমন এক অপূর্ণ সাধ পূর্ণ হয়ে যাবে- ভাবতেই কেমন গায়ে কাটা দিচ্ছে।

তবে তাসকিন আজকে একটুখানি নস্টালজিক হতে বাধ্য। এই যে ম্যাচটাতে তাসকিন দুর্দান্ত পারফর্ম করলেন। ওয়ানডেতে নিজের ফিরে আসার জয়গান শোনালেন। আপনি কি মনে করতে পারেন তাসকিন বাদ গেছিলেন কিভাবে? মনশ্চক্ষুতে দেখতে পাচ্ছি, আপনার কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করছেন। কবে বাদ পড়েছিল তাসকিন। থাক, আমিই মনে করিয়ে দিচ্ছি।

তাসকিন বাদ পড়েছিলেন ২০১৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর। তাসকিনের ওপর সেবার আশা ছিল অনেক। এমনিতে জোরে বল করতে পারেন, দক্ষিণ আফ্রিকার পিচ তার জন্যে স্বর্গ হওয়ার কথা। কিন্তু বিধিবাম। তাসকিনই ছিলেন সেবার সবচাইতে বাজে বোলার। সেই তাসকিন, সেই দক্ষিণ আফ্রিকাতেই কি দুর্দান্তভাবেই না একটা ম্যাচ জেতালেন আমাদের। ৬০টা ডেলিভারির মধ্যে তার ৪০ টা ডেলিভারিই ডট বল।

জীবন বড্ড অনিশ্চিত। বড্ড বেশি অনিশ্চিত। যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে অপমানের চূড়ান্ত হয়ে ফিরেছিলাম, যে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পরই তাসকিন আহমেদ হয়ে গেছিলেন দেশের ক্রিকেটের এক অতীত অধ্যায়- সেই দক্ষিণ আফ্রিকাতেই বাংলাদেশের আজ জয়ের পতাকা উড়ছে, সেটাও আবার তাসকিনের জাদুকরী বোলিংয়ে!

এমন চিত্রনাট্য আমাদের কপালে লেখা ছিল, তা কে জানত!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link