শিরোনামের নামটা হালের ক্রিকেট প্রজন্মের কাছে কতটা পরিচিত সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেই শুরু করতে হচ্ছে। তবে নব্বইয়ের দশকে যারা ক্রিকেট অনুসরণ করা শুরু করেছিলেন তাঁদের মস্তিষ্কের কোনো অবচেতন কোষ-নিউরনে কি একটা সুক্ষ্ম ঘণ্টা বাজলো?
একটা হিন্টস দিয়ে বরং চেষ্টা করা যাক – ‘তৎকালীন সময়ের দ্য নেক্সট শচীন খ্যাত ক্রিকেটারকে কি স্মৃতির কোনো একটি অংশে ধারণ না করে পারা যায়!’
কাম্বলি-শচীনের সেই বিখ্যাত স্কুল ক্রিকেট পার্টনারশিপের গল্প সবার জানা। তৃতীয় উইকেট জুটিতে করা তাঁদের সেই অমর কীর্তিও কখনো হারিয়ে যাবে না কালের স্রোতে। কিন্তু অমল মুজুমদারের হারানোর শুরুও যে সেদিন থেকেই। গল্পের এই প্লটে এসে পাঠকের স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা হয়ত এটাই যে, এই জুটির সাথে অমল মুজুমদারের সম্পর্কটা ঠিক কোথায়?
সম্পর্কটা প্রত্যক্ষ না হলেও কিছুটা পরোক্ষ। প্রথম উইকেট পতনের পরই যে সেদিন একটি ১৩ বছরের ছেলে প্যাড, গার্ড পড়ে অপেক্ষায় ছিল মাঠে নামার। সারাটা দিন ধরেই সে কখনো নেটে প্রাকটিস করেছে, কখনো স্ট্রেচিং করেছে, আর হয়ত ভেবেছে এই বুঝি তাঁর সময় আসলো! না, ছেলেটির আর ব্যাট করার সুযোগ আসেনি, অপেক্ষা করতে করতে সে দেখেছে বাইশ গজে শচীন-কাম্বলির তাণ্ডব।
দল যখন ইনিংস ঘোষনা করলো, শচীন-কাম্বলি তখনও অপরাজিত!
ক্রিকেট ছেলেটিকে শেখালো অপেক্ষার প্রহরের ভয়াবহ যন্ত্রণা। শিক্ষাটা ছেলেটি বয়ে বেড়ালো তার ক্যারিয়ার জুড়েই! সেই রুপক অপেক্ষা ছেলেটির আর শেষ হলো না! রঞ্জির মহানায়ক সেই ছেলেটির গায়ে চাপানো হলো না বহু আরাধ্য ব্লু জার্সি। ছেলেটির নাম অমল মজুমদার – নব্বইয়ের দশকে যাকে নেক্সট শচীন বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল।
ট্রাজেডি ছাড়া নাকি ভালোবাসার গল্পগুলো পরিপূর্ণ হয় না। অমল মুজুমদার হতে পারেন সেই পাঠকদের পাথেয় নায়ক, যারা ট্রাজেডি ভালোবাসেন। দ্য মোস্ট আনলাকি ট্যালেন্টেড ক্রিকেটার লিখে গুগলে সার্চ দিলে উঠে আসবে স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল, অনিল গুরাভ সহ বেশ কয়েকটি নাম। এর মধ্যে আবার অনিল গুরাভকে চিনবে না এদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটপ্রেমীরাই। তাঁকে নিয়ে অন্য একদিন লিখবো নাহয়। যা হোক, লিস্টের প্রথমেই আপনি যে নামটা দেখবেন, সেটা অমল মুজুমদারের।
শুধু ‘প্রতিভাবান’ টার্মটি ব্যবহার করলে মজুমদারের সামর্থ্যকে অপমানিত করা হয়। প্রতিভা আছে, কিন্তু এক্সিকিউশন নেই এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা অগনিত। ‘মজুমদারের মধ্যে কি এমন ছিল?’ প্রশ্ন না করে ‘কী ছিলো না?’ প্রশ্ন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। স্কিল, টেমপারামেন্ট, প্যাশন, অথবা নীল জার্সির প্রতি টান- কোনটারই অভাব ছিলো না। তবে হ্যাঁ, অভাব একটা ছিল – ‘ভাগ্য’। বঞ্চিত? – না, স্রেফ দুর্ভাগা – হ্যাঁ! আপনি মাত্রই মুজুমদারের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সংক্ষিপ্ত রুপ এক লাইনে পড়ে ফেললেন!
প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচেই বিশ্ব রেকর্ড! ২৬০ রানের ঝকঝকে ইনিংস! রেকর্ডটা টিকে ছিল ২০১৮ সাল অবধি। শুধু ভাগ্যের সাথে ব্যাটিংয়েই টিকতে পারেননি রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী অমল। কিন্তু ভাগ্য কেন তাঁকে নিয়ে এমন ছলনা করলো? প্রশ্নটা ভাগ্যকে করা হলে, ভাগ্য মহাশয় অবলীলায় বলটা পাঠিয়ে দেন সময়ের কোর্টে! চলুন, সময়ের পিঠে চড়ে ঘুরে আসি নব্বই দশকের ভারতীয় ক্রিকেট থেকে!
অমল তখন ফর্মের তুঙ্গে, ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা। অনূর্ধ্ব ১৯ দলের সহ-অধিনায়ক, তার মানেই নির্বাচকদের চোখে বেশ ভালোভাবে দৃশ্যমান! দর্শকরা ইতিমধ্যেই তাকে পরবর্তী শচীন ভাবা শুরু করেছে। দোষ দর্শকদের দেয়া যায় না, অমলের যোগ্যতা এবং সেই সাথে ‘ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে পারা’ তাঁকে নিয়ে স্বপ্নের ডানায় ভাসতে বাধ্য করছে!
সালটা ১৯৯৫। ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের ভারত সফর। বাতাসে তখন নভজ্যোৎ সিং সিধু এবং সঞ্জয় মাঞ্জেরেকারদের অবসর গুঞ্জন। ভারতের মিডল অর্ডারে জায়গা ফাঁকা হচ্ছে! নির্বাচকরাও তাই নড়েচড়ে বসলেন এ দলের সফর নিয়ে। তারুন্যের অগ্নিপরিক্ষা! অমল হেরে গেলেন টেস্ট সিরিজে ডাক পাওয়ার লড়াইয়ে, তবে নজর কাড়লেন আরেক তরুণ।
রাহুল নামের সেই তরুণের প্রতিরোধের দেয়াল ছিল ইস্পাত শক্ত, যা পরবর্তীতে ভারতের মিডল অর্ডারকে রক্ষা করে গেছে অজস্র তুফানের হাত থেকে। হ্যাঁ, দ্য ওয়াল খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়ের শুরুটা হয়েছিল অমল মুজুমদারের ভাইস ক্যাপ্টেন্সির আন্ডারে! অহ, আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখি, এই দলটাতে আরেকজন ক্রিকেটার খেলেছিলেন, সৌরভ গাঙ্গুলি, হুম দাদা – দ্য প্রিন্স অব ক্যালকাটা!
নির্বাচকদের নজর দ্রাবিড়ের উপর সেটে থাকলেও সুযোগ ছিল সকল উঠতি তরুণের জন্যই। রেসে কারা কারা ছিল জানেন? দ্রাবিড়, সৌরভ, লক্ষণ এবং অমল! ১৯৯৫/৯৬ সালে সেবারের দুলীপ ট্রফি ছিল ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের এক চকচকে অধ্যায়। সবার জন্য কি? কে বা কারা হতে যাচ্ছেন ইন্ডিয়ার মিডল অর্ডারের কাণ্ডারী? ড্রামা, সাসপেন্স, ভাগ্যের সেই দুলীপ ট্রফি সিজন!
সবাইকে চমকে দিয়ে লক্ষণ ‘টপড দ্য চার্ট’ উইদ ৩৯৫! দ্রাবিড় ৩৫৩ করে দ্বিতীয়, অমল খুব বেশি পিছিয়ে নেই, ৩৩৩, যার ভেতর আছে একটা ডাবল সেঞ্চুরি। সৌরভ ৩০৮ করে ৫ নাম্বারে। মধুর সমস্যা, কিন্তু সহজ গণিতে সমাধান করে ফেললেন নির্বাচকরা।
লক্ষণের অধারাবাহিকতাকে আমলে এনে, দ্রাবিড়কে সুযোগ দেয়া হল। এবার প্রতিযোগিতা অমল এবং সৌরভের! রানের দিক থেকে পিছিয়ে থেকেও সৌরভ এগিয়ে গেলেন ওয়েস্ট জোনের শক্তিশালী বোলিংয়ের বিপক্ষে করা ১৭১ রানের কল্যানে! অমলের অপেক্ষা বাড়লো!
সৌরভের সিলেকশনে অসন্তোষ বহু দর্শকের মধ্যেই ছিল। সৌরভ সেগুলো চাপা দিয়ে দিলেন ইংল্যান্ড সফরে, অভিষেকেই ব্যাট উঁচু করে! সেটাও একবার নয়, পরপর দুই টেস্টে দুইবার! দ্রাবিড়ও ভরসার প্রতিদান দেয়া শুরু করলেন! প্রথম ফেজের লড়াইয়ে অমলকে তাই হারতে হল কোন ভুল না করেই!
ভারতীয় দলে তখন তিন কিংবদন্তির এগিয়ে চলা, এদিকে রঞ্জিতে অমলের রান বন্যা। সুযোগ কি আসবে? ১৯৯৩/৯৪ – ২০০৩/০৩ সময়ে ৫০ গড়ে ৬০০০-এর ওপর রান! অমল আর কিই বা করতে পারতেন? সুযোগ এসেছিল দুয়েকবার ফিফথ/সিক্সথ পজিশনে, কিন্তু অমলের শক্তির জায়গা যে নাম্বার থ্রি/ফোর!
লক্ষণ সুযোগটা নিলেন, অনেক প্রশ্নের জবাব সিডনির সেঞ্চুরিতে দিলেন, এরপর কলকাতার সেই ম্যাজিক ইনিংসে সকল সমালোচনার সমাপ্তি! ভারতীয় ব্যাটিং অর্ডারে তখন কারা? শচীন, দ্রাবিড়, সৌরভ, লক্ষণ – দ্য গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম ফর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিল নাও। হয়তো ক্রিকেট বিশ্বেও এখন অবধি সেরা! আর অমল? নিরবে শুধু চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু কি করার ছিল তাঁর?
কোচ হিসেবে এখন তিনি সুপরিচিত। আইপিএলে কাজ করেন, কাজ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবেও।
শচীন দ্রাবিড়কে সরিয়ে ৩/৪ নাম্বারে সুযোগ পাবার কথা হয়ত খোদ অমলও ভাবেননি, কিন্তু অমলের কি ক্যালিবার ছিলো না? তাকে খেলতে দেখা অনেকেই কিন্তু তাকে সমপর্যায়ের মনে করতেন! হ্যাঁ, গ্রেট শচীন, দ্রাবিড়ের সমপর্যায়ের! সৌরভের ইনকন্সিস্ট্যান্সি যদিও দরজা খুলে দিতে পারত, কিন্তু দাদা ক্যাপ্টেন হয়ে সেই পথটাও বন্ধ করে দিলেন। ইতিহাস জানলো চারজন কিংবদন্তীর কথা, বেমালুম ভুলে গেল পঞ্চম জনকে, যে কিনা কিংবদন্তি হবার সব রকম উপকরণ সাথে নিয়ে এসেছিল।
কোন এক ইন্টারভিউতে অমল জানিয়েছিলেন, তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কখনোই কোন বন্ধু বা ফ্যামিলির সাথে ঘুরতে যাননি তিনি, এমনকি নিজের জন্মদিন পর্যন্ত পালন করতেন না। ডিসিপ্লিন, ক্রিকেট লাভ, প্যাশন, সব কিছুর নিবেদন ছিল শুধু একটা উদ্দেশ্যে, ইন্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করা! সময়ের কি পরিহাস- এক কাম্বলি, যে কিনা ইন্ডিসিপ্লিনের ঝড়ে নিজের প্রতিভাকে উড়িয়ে দেয়, আর এক অমল মজুমদার, যে কিনা ডিসিপ্লিনের মুর্ত প্রতীক হয়েও ভাগ্যের পালে প্রতিভার হাওয়ায় উড়তে পারে না!
নাহ, অমল পারেননি সেই অপেক্ষার প্রহরকে পরাভুত করতে, পারেননি নীল জার্সির নতুন সুবাসে নাক ঘসতে, পারেননি নিজের তীব্র ইচ্ছার প্রতিদান দিতে! তবে, অমল পেরেছেন! তিনি পেরেছেন অপেক্ষা করতে, তিনি পেরেছেন শেষ পর্যন্ত নিজের স্বপ্নকে তাড়া করতে, তিনি পেরেছেন নিজের ভালোবাসাকে শেষদিন পর্যন্ত ভালোবাসতে! হোক না সেটা ওয়ান সাইডেড লাভ, হোক না সেটা রোমান্সবিহীন শীতলতা!
অমলকে ভুলতে হলে আপনাকে ভুলে যেতে হবে দ্রাবিড়, লক্ষণ অথবা সৌরভের কথা। আপনি অমলকে মনে রাখবেন সেই ক্রিকেটার হিসেবে, যিনি তিন ভারতীয় লিজেন্ডকে নিজেদের সেরাটা দিতে বাধ্য করেছিলেন প্রতিনিয়ত! কারন তারা জানতেন, কেউ একজন আছেন যে কিনা শুন্যস্থান পুরন করতে মরিয়া, কে জানে হয়ত শুন্যস্থানের সঠিক শব্দটাই ভারতীয় নির্বাচকরা মিস করে গিয়েছিলেন!
অমলদের গুরুত্ব তাই ক্রিকেটে কোন অংশেই কম নয়, বরং হাজারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার থেকে বেশি। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও এমন কিছু অমল দরকার, যারা কিনা শুন্যস্থান পুরনে নিজেকে সবসময় প্রস্তুত রাখবে, অন্যরা জানবে, কেউ একজন আছে তার চেয়ারের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে, চেয়ারে বসার তীব্র পিপাসা নিয়ে!