মোটামুটি থেকে খারাপ অতঃপর লজ্জাজনক – সাম্প্রতিক বছরে পাকিস্তানের পারফরম্যান্স গ্রাফটা এমন। এক একটা দিন পার হয়, আর তাঁদের পারফরম্যান্স নিচের দিকে যায়। ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আয়োজন করেও সেরা চারে জায়গা পায়নি দলটা, ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে বোধহয়। তবে খোঁজখবর রাখা সমর্থকদের জন্য ব্যাপারটা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।
আইসিসির সবশেষ মেজর টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচগুলোই প্রমাণ করে দেয় দেশটার অবনতি। ২০১৫ সালের পর থেকে তাঁরা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখোমুখি হয়েছে, অথচ স্রেফ ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল ছাড়া সুখস্মৃতি নেই একটাও। পরাজয়ের ব্যবধানও বিব্রতকর; কখনো ৭৬ রান, কখনো ১২৪ রান বা ২২৮ রান, আবার নয় উইকেট, আট উইকেট – সবশেষ ম্যাচে ছয় উইকেটে হার।
২০১৫, ২০১৯, ২০২৩ তিনটি বিশ্বকাপের একটিতেও সেমিফাইনাল খেলতে পারেনি পাকিস্তান। ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তো যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও হেরে বসেছিল, বাদ পড়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকে। আর টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপে তিন চক্রে তাঁদের অবস্থান যথাক্রমে ছয়, সাত এবং নয়; এ যেন অবনতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু কেন? উত্তরে সবার আগে উঠে আসবে ক্রিকেট বোর্ডের অস্থিতিশীলতা। দেশের রাজনীতির মতই ক্রিকেটাঙ্গনে ক্রমাগত পরিবর্তন দেখা যায়। ২০২১ সালে পিসিবি চেয়ারপারসন এহসান মানির পদত্যাগের পর থেকে চারজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি দায়িত্ব পেয়েছেন, আবার ছেড়েছেন। এদের প্রত্যেকেই আবার আলাদা আলাদা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা প্রতিনিয়ত দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির কবর খুঁড়েছে।
শুধু পিসিবিতে নয়, টিম ম্যানেজম্যান্টেও বার বার এসেছে বদল। পাকিস্তান কোচ বদলেছে পোশাকের মত, একেক দিন একেকজন এসেছেন। স্বদেশী মিসবাহ, হাফিজদের পাশাপাশি বিদেশী গ্যারি কার্স্টেন, জেসন গিলেস্পি অনেকেই তো এসেছেন কিন্তু স্থায়ী হতে পারেননি।
একই ভাগ্য বরণ করে নিয়েছে নির্বাচক প্যানেল এবং অধিনায়কত্বের আসন। শাহীন শাহ কিংবা বাবর আজম – এসেছিলেন বিশ্বসেরা হওয়ার প্রতিভা নিয়ে। কিন্তু পাকিস্তান গত দশ বছরে ক’জন সুপারস্টার তৈরি করতে পেরেছে। নাসিম শাহয়ের আগের সেই ধার নেই, হারিস রউফ যত জোরে বল করছেন তার চেয়ে বেশি জোরে বাউন্ডারি হজম করছেন।
পাকিস্তানকে একটা সময় ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ট্যাগ দেয়া হয়েছিল। ব্যাটারের মেরুদণ্ড কাঁপিয়ে তোলার মত পেসার ছিল, ট্যাকনিক্যালি সেরা যিনি তাঁকে বোকা বানানোর মত স্পিনার ছিল, নান্দনিকতা আর দাম্ভিকতার মিশেলে ব্যাট করতে পারা ব্যাটার ছিল – সবমিলিয়ে তাঁদের একটা আভিজাত্যময় সময় ছিল। কিন্তু এসব কিছুই আপাতত আক্ষেপের বিষয়।
ইডেন গার্ডেন্সে পরপর দুই বলে শচীন আর দ্রাবিড়ের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলা শোয়েব আখতার, সাঈদ আনোয়ারের ১৯৬ রানের অলৌকিক ইনিংস, ‘১৫ তে ওয়াহাব রিয়াজের সেই স্পেল কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে আমিরের ধ্বংসলীলা – ক্রিকেটপ্রেমীরা তো কিছুই ভোলেনি। ভোলা কি সম্ভব?
যে করেই হোক পাকিস্তানকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে; নিজেদের পুরনো সোনালী দিন ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্রিকেট বিশ্ব ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা শ্রীলঙ্কার মত দেখতে চায় না তাঁদের।
কেবল ভাল বা খারাপ খেলার প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা মানসিকতার। এক যুগ আগেও পাকিস্তান প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতো। এখন নেই সেই উত্তাপ, শরীরী ভাষায় নেই আগ্রাসন। কিন্তু সমর্থকেরা পুরনো দিনের মতই বিধ্বংসী রূপে দেখতে চায় দলকে।
আর সেই চাওয়া পূরণ করতে যা যা করা উচিত সবই করতে হবে পাকিস্তানকে, পাক ক্রিকেটারদের আর ক্রিকেট বোর্ডকে – কেবল তাঁদের টিকে থাকার জন্য নয়, বরং ক্রিকেট নামক খেলাটার জন্য হলেও পাকিস্তানকে ফিরতে হবে ফিনিক্স পাখির মত।