বিরোধীতা মানে কোনোকিছুর প্রতি নীতি ও আদর্শগতভাবে একমত হতে না পেরে সমর্থন প্রত্যাহার করা। তবে নীতি এবং আদর্শের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত না থাকলে বিরোধীতা অচিরেই বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সীমান্ত হত্যা ইস্যুতে ভারত বিরোধীতার ইতিহাস সুপ্রাচীন। এই বিরোধীপক্ষ মূলত রাজনীতি সচেতন, খেলাধুলা নিয়ে বিশেষ ভাবান্তর নেই।
পক্ষান্তরে শ্রীনিবাসন প্রস্তাবিত বিগ থ্রি নীতি, ক্রিকেট দুনিয়ায় ভারতের অর্থকর্তা হয়ে উঠা, আইসিসির ইভেন্টগুলোতে মাঠ বহির্ভূত কিছু বিষয়ে ভারতের বাড়তি সুবিধা পাওয়া, বাংলাদেশকে সফরে আমন্ত্রণ না জানানো এবং ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে বিতর্কিত নো-বল সিদ্ধান্ত – ঘটনাগুলো যোগ করলে ক্রিকেটপ্রিয় এক গোষ্ঠী ভারত মানেই তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র- চক্রান্ত আবিষ্কার করে বিরোধীতা হাজির করেন।
যদিও এই গোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশই রাজনীতি সচেতন নয়, তবু বিরোধীতাকে বৃহত্তর আকার দিতে তারা সীমান্ত এবং অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের প্রসঙ্গগুলো সামনে নিয়ে আসেন, এবং ক্রিকেট মাঠে ভারতকে হারানো মানে সেইসকল বৈষম্যের জবাব দেয়া এরকম তত্ত্ব হাজির করেন।
যেহেতু বিরোধীতার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল এবং আরোপিত, এটি আদর্শিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে বিদ্বেষের হেমলক সরোবর হয়ে উঠেছে। বিদ্বেষ ব্যাকটেরিয়ার মতো দ্রুতবর্ধনশীল, যে কারণে ভারত দিয়ে যার শুরু শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ঘুরে তা আফগানিস্তানে এসে ঘাঁটি গেড়ে অপেক্ষায় থাকবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সাউথ আফ্রিকা পাড়ি দেয়ার।
ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ উপলক্ষ্যে সুনীল গাভাস্কারের কলাম পড়লাম। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি খেলে বেড়ায়, যে কারণে তাদের ফিটনেসও টি-টোয়েন্টি মানের। এদের একজন আন্দ্রে রাসেল, তার ব্যাটিং-বোলিং করার সামর্থ্য ওই ৪ ওভার পর্যন্তই।
তার এই কথার মধ্যেই বর্তমান ক্রিকেটের মূল সংকটটা নিহিত।
ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের দাপটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচির টালমাটাল অবস্থা। মার্চ-এপ্রিল আইপিএল কারণে কোনো সিরিজ থাকে না, অস্ট্রেলিয়াতে বিগব্যাশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিপিএল, শ্রীলংকায় এসপিএল, বাংলাদেশে বিপিএল; এই সমস্ত ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে অল্প পরিশ্রমে যে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে উপার্জন সে তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা নেহায়েতই সিভি ভারি করার প্ল্যাটফরম।
এমনকি ভালো মানের কোচ পাওয়াটাও দুরূহ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ তাদের কোচ স্টিভ রোডসকে অব্যাহতি দেওয়ার পর নতুন কোচ পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল চান্দিকা হাতুরুসিংহে যাওয়ার পরও। সেরকম মনো:পুত কাউকে পাওয়াটা কালক্রমে আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মূল আকর্ষণ টাকা, এবং আইপিএল এর টাকার ঝনঝনানি অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি, যে কারণে আইপিএল এর দিকেই সবার চাতকের চোখ থাকে।
ভারতের কোনো ক্রিকেটার কি আইপিএল বাদে অন্য দেশের প্রিমিয়ার লীগে খেলে? উত্তর হলো ‘না’।
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা আইপিএলে খেলে, নিজেদের দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে, এবং অ্যাশেজ বা অন্য কোনো সিরিজ থাকলে আইপিএল এর মাঝপথে চলেও আসে। এর কারণ কী?
প্রথমত, তাদের ক্রিকেট বোর্ড ধনী, দ্বিতীয়ত তাদের ক্রিকেট কালচারে স্বজাত্যবোধ এবং অহম তীব্র।
অন্যদিকে ইংল্যান্ডের মূল দলের দিকে যদি তাকাই তারা বরাবরই বিভিন্ন দেশের ভাড়া করা ক্রিকেটার নির্ভর দল। এখনো তাদের স্কোয়াডের ৫-৭ জন ক্রিকেটার ভিন্ন দেশের। কলপ্যাক চুক্তির মাধ্যমে বহু ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছে। ক্রিকেটাররা তবু সেই চুক্তিতে সই করে উন্নত জীবনের আশায়।
এখানেও অর্থনৈতিক কারণটাই মূখ্য।
ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আর কলপ্যাক চুক্তির কারণে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকা। এদের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘটনাটা ব্যতিক্রম। তাদের দলে যেহেতু অনেকগুলো দেশের খেলোয়াড়রা খেলে, তাদের মধ্যে ন্যাশনালিজমের কোনো স্পিরিটই নেই। বোর্ডের হয়ে খেলা আর ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলার মধ্যে ফারাক কী?
সাউথ আফ্রিকার প্রধান সংকট কোটা নীতি। খেলোয়াড়ি যোগ্যতার চাইতে গায়ের রঙের ভিত্তিতে ৩-৪ জন খেলোয়াড়কে একাদশে জায়গা দিতেই হবে, এই নীতির কুপ্রভাবে নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্বে লিপ্ত তারা৷ খেলার স্পিরিটের চাইতে তাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রাধান্য পায়। এবিডি ভিলিয়ার্স বা ডি কক যখন বিশ্বকাপের চাইতে আইপিএল কে বড়ো করে দেখে, এটা সেই দ্বন্দ্ব আর স্পিরিটহীনতার ফলাফল হিসেবেই প্রতিভাত হয়ে উঠে।
আপনি বিগব্যাশকে সমস্যা মনে করেন না, বিপিএলকে দেখেন নতুন প্লেয়ার তৈরির কারখানা হিসেবে, অথচ আইপিএলকে বলছেন ক্রিকেট ধ্বংসের হোতা; এটা কি সেন্সিবিলিটির লক্ষণ আদৌ?
যদি কখনো বিপিএল বা বিগব্যাশে আইপিএল এর চাইতেও বেশি টাকার যোগান নিশ্চয়তা দেয়া হয়, নিশ্চিতভাবেই আইপিএল পিছিয়ে পড়বে।
দোষ দিলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে দেন, নয়তো বিপিএল-বিগব্যাশেরও বিরোধীতা করেন।
আইপিএলে কেন টাকার ছড়াছড়ি? কারণ ক্রিকেটের বৃহত্তম বাজার ভারতে। এটা নিশ্চয়ই ভারতের দোষ হতে পারে না।
আমরা কেবল আইপিএল নিয়ে পড়ে আছি, ভারতের ক্রিকেট স্ট্রাকচার নিয়ে একটু পড়োশোনার চেষ্টা করি, তাহলে যে কোনো সেন্সিবল মানুষ চুপ হয়ে যেতে বাধ্য। মাত্র ২০ বছর আগেও ভারত ছিল এক মিডিওকর দল, টেন্ডুলকার আউট হয়ে যাওয়া মানেই ম্যাচের অর্ধেক হেরে যাওয়া, টেস্ট ম্যাচে সারাদিন অনিল কুম্বলে বল করতো, বিদেশ সফরে পেস সহায়ক উইকেটে ব্যাটসম্যানরা নাস্তানাবুদ হতো।
সেই দলে এখন এতগুলো পেসার কোত্থেকে এলো যারা সিমিং পিচে উলটো প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলে দেয়? এটা কি ২০ ওভারের আইপিএল থেকে এসেছে মনে করেন?
অনেককেই দেখি স্রোতে গা ভাসিয়ে বলেন, ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামা মানে ১৩ জনের বিপক্ষে লড়াই করা। ধরলাম আম্পায়ার নেই। এবার ভারতের একাদশের সাথে তুলনা দেয়ার মতো একটা একাদশ দাঁড় করান। তারাই একমাত্র টিম যারা ৪ জন উইকেট টেকিং বোলার খেলায়, তাদের ফিল্ডিং পারদর্শীতা এবং খেলোয়াড়দের ফিটনেস অস্ট্রেলিয়াকেও চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো, আপনার ক্রিকেট জীবনে বিরাট কোহলির মতো অবিশ্বাস্য মেন্টালি টাফ ব্যাটসম্যান দেখেছেন কখনো? কিংবা রোহিত শর্মা ওয়ানডেতে তিনটা ডাবল সেঞ্চুরি করেছে, আর কারো দু’টিও নেই কেন?
এরকম এক দলের সাথে আপনি সেদিনই জিতবেন যেদিন তাদের অফ ডে যাবে, অথবা আপনি ১৩০ পারসেন্ট এফোর্ট দিবেন। পক্ষান্তরে তারা নিজেদের স্বাভাবিক এফোর্ট দিলেই বাংলাদেশের মতো দলের বিপক্ষে ১১ বারের মধ্যে ১০ বারই জিতবে।
এই দলের তবুও আম্পায়ারের আনুকূল্য নিতে হবে জেতার জন্য, এটা কি ক্রিকেটিয় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হলো?
তার চাইতে কি এটা বলা সঙ্গত নয় যে আম্পায়ারিংয়ের মানই নিম্নমুখী? আম্পায়াররা মানুষ, এবং মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা, ধৈর্যিশক্তি লুপ্ত হচ্ছে, তারই প্রভাব পড়ছে আম্পায়ারিংয়ে; এটা মানতে বাঁধছে কোথায়?
১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সময়কে বলা যায় অস্ট্রেলিয়ার একাধিপত্যের যুগ, কেবলমাত্র সাউথ আফ্রিকাই তাদের সাথে টক্কর দিতে পারতো।
২০০৭ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটাকে ভারত এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে নিয়েছিল। সিনিয়রদের বিশ্রাম দিয়ে উইকেটরক্ষক ধোনিকে অধিনায়ক করে একঝাঁক তরুণকে সুযোগ দিয়েছিল, সেই এক্সপেরিমেন্ট পে-অফ করেছে। যেহেতু ভারতে ফিল্ম আর ক্রিকেটে বিনিয়োগের অভাব হয় না, টি-টোয়েন্টি এর সেই বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ খেলাটির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু তারা কি টি-টোয়েন্টি তে মজে গেছে? বরং ওয়ানডে আর টেস্টকে তারা এখনো সর্বাধিক সিরিয়াসনেস দিয়ে বিবেচনা করে?
আমরা কী করি?
আমাদের টেস্ট-ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি সহ সকল ফরম্যাটের টিম এক, মুশফিক কিপিংয়ে অনবরত ভুল করা সত্ত্বেও বোর্ড থেকে তাকে সরানোর উদ্যোগ নেয়া হয় না, তামিম জীবনে ওপেনিং ছাড়া কোনো পজিশনে খেলেনি বলে তাকেও ওয়ানডে ওপেনার হিসেবেই খেলিয়ে যেতে হবে, নিচে নামানোর সাহস নেই; বোর্ড তারকা খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে জিম্মি। ২০২০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ফলে বছরের বাকি সময়ে ওয়ানডে না খেলে কেবল টি-টোয়েন্টি খেলে যাবো – এমনই তো পরিকল্পনা ছিল।
গাঙ্গুলি, দ্রাবিড়, লক্ষণ, শেবাগের মতো ক্রিকেটারকে তারা নিঃসংকোচে ছেঁটে ফেলেছে, টেন্ডুলকারের মতো ক্রিকেটের সবচাইতে বড়ো তারকাকে ওয়ানডে থেকে বসিয়ে দিয়ে একসময় অনেকটা জোর করেই টেস্ট থেকে অবসরে পাঠিয়েছে। তাদের ক্রিকেটিয় অর্জন এবং ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা দুটোই আমাদের তুলনায় সহস্রগুণ বেশি।
পক্ষান্তরে হাথুরুসিংহ যখন তামিম আর মুশফিককে টি-টোয়েন্টি থেকে বাদ দিতে চেয়েছিল, প্রথম আলোর মতো শীর্ষ দৈনিক তার বিরোধীতা করে লিখেছিল টি-টোয়েন্টি দলকে কচিকাচার আসর বানাতে চাচ্ছেন কোচ। যে কারণে আমাদের দেশে প্লেয়ারের সংকট লেগেই থাকে। কিন্তু আমি মনে করি, ব্যবসায়ীরা চাল মজুদ করে যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখে, বাংলাদেশের খেলোয়াড় সংকটের বিষয়টিও কৃত্রিম। এর সর্বশেষ উদাহরণ হতে পারে মাহমুদুল্লাহ এর ঘটনা। সাকিবের সাথে অন্যান্য বাংলাদেশি ক্রিকেটারের মানসিকতার পার্থক্য দেখুন।
ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে সে খেলেনি ইনজুরির কারণে, ইনজুরির যা অবস্থা তাতে একটু ঝুঁকি নিয়ে সে খেলতে পারতো, খেলেনি; হাফ ফিট অবস্থায় খেলার চাইতে একজন ফিট খেলোয়াড়কে সুযোগ দেয়াকে বড়ো করে দেখেছে। একজন খেলোয়াড় ১৫ জনের স্কোয়াডে থাকা মানে সে অবশ্যই একাদশে থাকার মতো। আমাদের পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, আমরা মূল একাদশের বাইরের ৪ জনকে নিয়ে যাই ফিল্ডিং করা আর পানি টানার কাজে। মাহমুদুল্লাহ এর যে ইনজুরি তাতে ১০-১২ দিন বিশ্রামে থাকার কথা, কিন্তু সে ভারতের বিপক্ষে খেলবেই ধরে নিচ্ছি, এবং এটাকে সমর্থক আর মিডিয়া বিশাল আত্মত্যাগ- দেশপ্রেম বলে মহিমাণ্বিত করবে।
এই দেশে পাইপলাইনে বিকল্প খেলোয়াড় তৈরি হবে কীভাবে? আপনি যদি মিঠুন বা সাব্বিরকে বিকল্প হিসেবে না-ই খেলাতে পারেন, তাদের ১৫ জনের স্কোয়াডে বয়ে বেড়ানো কেন?
ফলে ভারত বিদ্বেষের সমগ্র প্রক্রিয়াটাই নিজেদের ভিশনহীনতা, গ্রোথে অনাগ্রহ আর দুর্বলতাকে ঢেকে রাখার হীন কৌশল বা স্ট্যান্টবাজি হিসেবেই দেখি। একটা দৃশ্যপট চিন্তা করা যাক, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ারের দায়িত্ব পেয়েছেন সাকিব আর মুশফিকের বাবা, থার্ড আম্পায়ার হিসেবে আছে মাশরাফির ছোট ভাই, এবং অফিসিয়ালদের অপরিবর্তিত রেখে মিরপুর, মেলবোর্ন, লর্ডস, স্যাবিনা পার্ক, নেপিয়ার, হাম্বানটোটা, জোহানেসবার্গ- এরকম ৭ দেশের ৭ ভেন্যুতে খেলা হবে, একটিও ভারতের মাটিতে নয়; এবার যদি সত্যিকারের ক্রিকেট লাভার হোন, বলুন তো এই সিরিজের ফলাফল কী হতে পারে?
তবু আপনি আইসিসিকে দুষবেন, ভারতকে দুষবেন, কারণ মুশফিক বা সাকিবের বাবাও আপনার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়ে বসতে পারে মানবিক ভুল হেতু। পক্ষান্তরে, নিজেদের ফেভারে আসা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চুপ। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ক্রিস জর্ডানের যে রান আউটটা নিজেদের পক্ষে পেলেন, ভাবুন তো ম্যাচের ওই পরিস্থিতিতে রিয়াদ বা সাকিবকে ওরকম এক রান আউট দিয়েছে। কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রোহিত শর্মার যে আউটটা দেয়া হলো, কিংবা পাকিস্তানের বিপক্ষে কোহলি আউট না হয়েও যেভাবে ওয়াক করলো, সেখানেও কি আইসিসি তাদের ফেভার করেছিল?
মানুষের জীবনযাপনের মূল চালিকাশক্তি অর্থনীতি। আরো গভীরে চিন্তা করলে অর্থনীতির চূড়ান্ত অভিলক্ষ্য ক্ষমতা। আইনের চোখে সবাই সমান, কিন্তু ক্ষমতাবানদের জন্য বিধান আলাদা। ক্ষমতার ইতিহাসই বৈষম্য আর শোষণের। কোনো অনুষ্ঠানে ক্ষমতাশালীর জন্য যে আয়োজন-আপ্যায়ন, একজন আমজনতার জন্য কি সুযোগ-সুবিধা সমান?
ক্রিকেটে ভারত হলো সেই ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যার ভিত্তি জনপ্রিয়তা এবং অর্থনীতি। ২০ বছর আগেও ভারতই ক্রিকেটের বৃহত্তম বাজার ছিল, কিন্তু তারা ক্ষমতাবান হিসেবে গণ্য হয়নি, কারণ তাদের পারফরম্যান্স ছিল মিডিওকর। ফলে ভারতের প্রতি সিমপ্যাথিও ছিল অনেকের, বরং অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের নাক উচু মনোভাবের কারণে তাদের প্রতি বিরূপতা ছিল। স্মিথ আর ওয়ার্নারকে ব্যান করার মধ্যবর্তী সময়টাতে অস্ট্রেলিয়া যখন খারাপ পারফর্ম করছিল, তখন তাদেরও শুভাকাংখী জুটে যায়।
কিন্তু ভারতের এখন পারফরম্যান্স গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী, সাথে অর্থনৈতিক সক্ষমতা আর জনপ্রিয়তা মিলে- তারা ক্রিকেটের ক্ষমতাবান ব্যক্তি হয়ে উঠেছে, ফলে পারফরম্যান্স চলে গেছে দৃষ্টির বাইরে, ক্ষমতাই হয়ে উঠেছে চোখের বালি।
এটা নিছকই পরশ্রীকাতরতাজনিত হীনম্মন্যতাবোধ। আমাদের দর্শক নিজেরাও বিশ্বাস করে চেষ্টা করেও বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মা মানের ব্যাটদসম্যান কিংবা বুমরাহ-কুলদীপ মানের বোলার প্রোডিউস করতে পারবো না, ফিল্ডিং-ফিটনেসে তাদের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারবো না, মাঝেমধ্যে তাদের বিপক্ষে ১-২টা ম্যাচ জেতা পর্যন্তই সর্বোচ্চ দৌড় আমাদের। সুতরাং ওদের নিন্দামন্দ করেই মনের জ্বালা মিটাই!
আমরা স্টার জলসা-জি বাংলা এর সিরিয়ালগুলো নিয়ে ট্রল করি কূটনামি বেশি এই অভিযোগে। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি, সমর্থক হিসেবে আমাদের যে দৈন্য বা ভারত বিদ্বেষ এটার রুট কজ সেই কূটনামি প্রবৃত্তিই?
অত সময় কোথায়, তার চাইতে রোহিত শর্মাকে ফ্ল্যাট ট্র্যাক বুলি উপাধি দিই, আর মিরাজকে নেক্সট সাকিব আল হাসান হিসেবে মেনে নিয়ে সাইফুদ্দিনকে বেন স্টোক্স বানিয়ে ফেলি। তারপর জিম্বাবুয়ে আর আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে তামিমের ওপেনিং পার্টনার কে হবে, সেই জল্পনায় সময় দিই!
আর হ্যাঁ, কিন্ত ভারত, কিন্তু ভারত, হ্যাঁ ভারতই হলো ক্রিকেট ধ্বংসের মাস্টারমাইন্ড। এইবার শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ুন