১৮৯১ সালে যখন ফ্রেঞ্চ ওপেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন শুধুমাত্র ফ্রান্সের ঐতিহ্যশালী কয়েকটা ক্লাবের সদস্যরাই খেলার সুযোগ পেতেন৷ ১৯২৫ সালে বিদেশি খেলোয়াড়দের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর এর নাম হয় ‘ফ্রেঞ্চ ওপেন’৷ যে স্টেডিয়ামে এখন নাদাল-ডকোভিচরা আগুন ঝরাচ্ছেন, নামের সাথে জড়িয়ে আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস এবং আরও নানা কথা৷ তেমনই একটা গল্প বলতে চলেছি আজ।
ইউজেন আদ্রিয়েন রোল্যান্ড জর্জেস গ্যারোস। ফরাসি উচ্চারণে তিনি পরিচিত শুধু রোল্যাঁ গ্যাঁরো নামে। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ডাকাবুকো স্বভাবের৷
যখন তাঁর একুশ বছর বয়স, সেই সময় একদিন আকাশপথে বৈমানিকদের গতির লড়াই প্রতিযোগিতা দেখে অসমসাহসী তরুণটির মনেও আকাশে উড়বার বাসনা জাগে৷ তিনি স্থির করেন পাইলট হবেন৷ যেমন ভাবা, তেমন কাজ৷ ট্রেনিং শেষ করে কয়েকটা বিমান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বেশ সুনামও অর্জন করলেন৷
পৃথিবীর আকাশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে প্রায়৷ এই সময়েই প্রথম বৈমানিক হিসাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিলেন বিরতিহীনভাবে৷ ক’দিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হল৷ গ্যাঁরো যোগ দিলেন বিশ্বযুদ্ধে! ১৯১৪ সালের আগষ্টে ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য আকাশপথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় দুটি যুদ্ধবিমান৷ অসামান্য সামরিক নৈপুন্যে বিপক্ষের জার্মান জেপলিন বিমানকে ধ্বংস করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখলেন তিনি৷
আজ আমরা যতই সুখোই, রাফাল বা তেজসের আস্ফালন শুনি না কেন, আকাশ যুদ্ধে তিনিই ছিলেন প্রথম পথপ্রদর্শক৷ তখনকার দিনে যুদ্ধ-বিমানে বসে মেশিনগান চালানো ছিল বিপদজনক৷ বহুক্ষেত্রে নিজের বিমানের পাখাতেই গিয়ে লাগত নিজের ছোঁড়া বুলেট৷ ইঞ্জিনিয়ার রেমন্ড সলনিয়ারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এক নতুন পন্থা উদ্ভাবন করলেন তিনি যার মাধ্যমে প্রপেলারের মধ্যে দিয়ে নিজের বিমানের ব্লেডকে আঘাত না করে গুলি চালানো সহজ হল৷
এর ফলে যুদ্ধে শত্রুপক্ষের তুলনায় ফরাসী বিমানবাহিনীর বিশেষ সুবিধা হল৷ একের পর এক লড়াইতে নিজের কুশলতার ছাপ রাখলেন গ্যাঁরো৷ বহুবার অপরাজেয় থেকেও ১৯১৫ সালের ১৮ এপ্রিল, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নিজ বিমান নিয়ে জার্মান ভূখন্ডে অবতরণে বাধ্য হন তিনি৷ ভাগ্য বিরূপতায় যুদ্ধবন্দি হলেন৷তিনবছর শত্রুপক্ষের বিভিন্ন ক্যাম্পে যুদ্ধাপরাধীর জীবন কাটান৷
হার না মানা যাঁর রক্তে, তাঁকে আটকে রাখার মতন ক্ষমতা কার? ক্ষুরধার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে স্বদেশে সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়ে জোগাড় করলেন দুটি টেনিস র্যাকেট৷ সেগুলোর ফাঁপা হাতলে ভরা ছিল জার্মানির একখানা ম্যাপ আর একটি ভাঁজ করা হ্যাট৷ সাথে পেয়ে গেলেন সহবন্দী দেশজ পাইলট অ্যানসেল্ম মার্শালকে, যিনি ছিলেন জার্মান ভাষায় তুখোড়৷
উপস্থিত বুদ্ধি আর দুর্দম মনোবলকে সঙ্গী করে দুইজনে জার্মানদের চোখে ধুলো দিয়ে পালালেন৷ নেদারল্যান্ড, লন্ডন হয়ে ফিরে এলেন প্যারিস৷ বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ দুইজনকে দেয়া হল ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান Légion d’honneur৷ সরকারের পক্ষ থেকে গারোকে বাহিনীর দপ্তরে বসে যুদ্ধের খূঁটিনাটি তদারকির প্রস্তাব দেয়া হল৷ জীবন-মৃত্যু যাঁর পায়ের ভৃত্য, তাঁর কী আর এই ধরনের কাজে আঁশ মেটে?
আবার বিমান নিয়ে উড়লেন, দেশের প্রতি অবিচল ভক্তি আর আত্মত্যাগের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ গড়ে অংশ নিলেন যুদ্ধে৷ আবারও দিলেন অসমসাহসিকতার প্রমান৷ পাঁচ অক্টোবর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে আর মাসখানেক বাকি৷ পাঁচটি যুদ্ধবিমানের সাথে আকাশে উড়লেন গ্যাঁরো, এক ঝাঁক জার্মান বিমানের আক্রমণ প্রতিহত করতে৷ অন্য বিমানগুলো ফিরে এলেও ফিরলেন না তিনি৷
উৎকন্ঠিত দেশবাসী আশায় বুক বাঁধল, তাঁদের নায়ক ঠিক ফিরে আসবেন৷কিন্তু সকল প্রার্থনা ব্যর্থ করে তাঁর ভগ্ন বিমান আর দেহাবশেষ পাওয়া গেল ভৌজিয়ার গ্রামে৷ মাত্র ২৯ বছর বয়সে অস্তমিত হল এক দূর্নিবার প্রাণ৷ জার্মানদের নথিপত্রে কোথাও ওনার বিমানকে পরাহত করার কথা পাওয়া যায়নি৷ তাই মনে করা হয় নিজের আবিষ্কৃত ব্যবস্থার ত্রুটিতে নিজের মেশিনগানের গুলির আঘাতেই ভেঙে পড়ে তাঁর বিমান৷
ব্যক্তিজীবনে মানুষটি কেমন ছিলেন তা দু’টি ঘটনা থেকে বোঝা সম্ভব৷ একুশ বছর বয়সে তিনি গাড়ির ব্যাবসা শুরু করেন এক বন্ধুর সাথে৷ বন্ধুটির নাম ইটোর বুগাট্টি৷ যিনি পরবর্তীতে জগৎবিখ্যাত বুগাট্টি গাড়ির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন৷ ১৯২২ সালে যখন বুগাট্টির দ্বিতীয় সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, প্রয়াত বন্ধুর নামে তিনি ছেলের নামকরণ করেন রোল্যাঁ৷
১৯২৫ সাল, ফ্রেঞ্চ ওপেন সংগঠিত করার জন্য প্রয়োজন দেখা দিল একটা নতুন স্টেডিয়ামের৷ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হল ফ্রান্সের অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশনের তখনকার সভাপতি এমিলি লেইজারের উপর, যিনি ছিলেন গ্যাঁরোর বাল্যবন্ধু, সহপাঠী এবং সহসেনানী৷ তিনি দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন, বন্ধুর নামে স্টেডিয়ামকে নামাঙ্কিত না করলে এক-কানা কড়িও খরচ করবেন না৷
মৃত্যুর দশ বছর পরে উদ্বোধন হল রোল্যাঁ গ্যাঁরো স্টেডিয়ামটির৷ একদিন দুটি টেনিস র্যাকেট সম্বল করে শত্রুপক্ষের ডেরা থেকে ফিরে এসেছিলেন যিনি, পৃথিবীর টেনিসের ইতিহাসে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গেল তাঁর নাম৷
অথচ মজার ব্যাপার হল, তাঁর প্রিয় খেলা ছিল রাগবী৷ রজার—রাফা—জোকার এর ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ডের আড়ালে অনেক সময়েই বিস্মৃত হয়ে যান সিংহ-হৃদয় এই দেশপ্রেমিক৷