রনির গুণ কি, বিজয়েরই বা দোষ কি!

চক্ষুশূল হওয়া। আর তার বৈপরীত্যে সুনজরের বৃত্তে কেন্দ্রিভূত থাকা। বাংলাদেশ দলে জায়গা পাওয়া না পাওয়ার ক্ষেত্রে এ দুইটা ব্যাপারই বোধহয় ক্রিকেটারদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।

অবশ্য এমন সংস্কৃতি বিশ্ব ক্রিকেটে বহু আগে থেকেই রয়েছে। টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা, অনাস্থায় বহু ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, ঠিক একইভাবে বহু ক্রিকেটার হয়েছেন ব্রাত্য।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে ব্রাত্যদের তালিকায় সম্ভবত প্রথম সারিতেই থাকবেন এনামুল হক বিজয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে রীতিমত রান বইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও এ ব্যাটারের প্রতি যেন কোনো সদয় দৃষ্টিই নেই। ব্যাপারটা এমন যে, বিজয়ের ব্যক্তিগত অর্জন যা কিছু, সব কিছুই মূল্যহীন টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে।

বিজয় অবশ্য সুযোগ পেয়েছিলেন। বহু বছর বাদে বাংলাদেশ দলে স্থায়ীভাবে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই পথে নিজের কাজটা ঠিকঠাক ভাবেই করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ শেষ যে বার দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে দেশের বাইরে উড়াল দিল, সেবারই দুই ফিফটিতে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছিলেন বিজয়।

কিন্তু বিজয়কে এরপরও বাদ দেওয়া নিয়েই যত তাড়াহুড়ো। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের পর স্রেফ একটা সিরিজের ব্যর্থতা। এরপরেই দল থেকে বাদ। বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে নির্বাচকদের কাছ থেকে আসা যুক্তিটাও বেশ নড়বড়ে। তামিমের অনুপস্থিতিতে নাকি রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে দলে নেওয়া হয়েছিল বিজয়কে। তামিম দলে ফেরায় তাই বিজয়কে তাদের বাদ দিতেই হয়েছে।

কিন্তু এমন যুক্তির বিপরীতে যে প্রশ্নটা উদয় হয় তা হলো, ভারতের বিপক্ষে সিরিজেও যিনি একাদশে ছিলেন, তিনি পরের সিরিজের স্কোয়াডেই জায়গা পেলেন না? এমন ছুঁড়ে দেওয়া ব্যাপারটাকে তাড়াহুড়ো না বলে উপায় কই!

সম্পূরক আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, এনামুল যদি ভারতের বিপক্ষে সিরিজ ভাল খেলতেন তাহলে কি একই যুক্তি দিতেন নির্বাচকরা? নিশ্চয়ই নয়। মূলত এক সিরিজের ব্যর্থতাতেই দল থেকে বাদ পড়েছিলেন এনামুল হক বিজয়। অথচ সেই সিরিজে মিরাজ আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বাদে রান পাননি কোনো ব্যাটার। কিন্তু দল থেকে বাদ পড়ার মতো শাস্তির খড়গটা নেমে এসেছিল শুধু এনামুলের বেলাতেই।

নির্বাচকদের সদয় দৃষ্টিতে ক্যারিয়ারে মোড় ঘুরেছে নাজমুল হোসেন শান্ত’র। ইংল্যান্ড সিরিজ থেকেই দারুণ ছন্দে এ ব্যাটার। এমন শক্ত সমর্থন পেলে হয়তো বিজয়ের ভাগ্যের চাকাটাও ঘুরে যেতে পারত। কিন্তু দিনশেষে, ঐ ব্রাত্যদের দলেই থেকেছেন তিনি। অধিনায়ক, কোচ কিংবা টিম ম্যানেজমেন্ট, কারো চোখেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারেননি। চক্ষুশূল হয়েই ঘরোয়া ক্রিকেটের চক্করে আবার ঘুরতে হচ্ছে এ ব্যাটারকে।

এনামুল হক বিজয় তাই ফিরে গিয়েছিল সেই পুরনো রাজত্বেই, ঘরোয়া ক্রিকেটে। পুরনো রাজত্ব হলে কি হবে! নিজের আসনটা ঠিকই এবারও ধরে রেখেছেন তিনি। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ইতিহাস গড়ার পরের মৌসুমেই আবার নিজের সেই রেকর্ড ভাঙার পথেই ছুটে চলা। সেই লক্ষ্যে ১০০ গড়ে প্রথম ৮ ম্যাচেই ৬০০ রান! পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটটাকে যেন একদম নিজের ফরম্যাটই বানিয়ে চলেছেন তিনি।

কিন্তু তারপরও জাতীয় দলের কড়া নাড়তে ব্যর্থ হলেন তিনি। ৯ মাস বাদে আবারো বিদেশ সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু আগের বিদেশ সফরে সেরা ব্যাটারটি এবার আর জায়গা পেলেন না। জায়গা পেলেন একদিনের ক্রিকেটে অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা রনি তালুকদার।

মাস দুয়েকের ব্যবধানে প্রধান নির্বাচকের যুক্তিই এবার প্রশ্নবিদ্ধ হলো। বিজয়ের বাদ পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ওকে ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। যেহেতু এখন তামিম ফিরেছে। আর শান্ত আছে। তাই এখন দলের বাইরেই রাখতে হচ্ছে বিজয়কে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেই তত্ত্বটা এবার পাল্টে গেল। এবার তামিম, শান্ত তো আছেনই। সাথে রনি তালুকদারও রয়েছেন। যে জায়গাটায় অনায়াসেই থাকতে পারতেন এনামুল হক বিজয়।

রনি তালুকদার শেষ সিরিজেও ছিলেন। তাই দলের সাথে আয়ারল্যান্ড সিরিজের জন্য ইংল্যান্ড সফরেও তিনি থাকছেন। টি-টোয়েন্টিতে পারফর্ম করে সুযোগ পেয়েছেন ওয়ানডে দলেও। শোনা যায়, বর্তমান কোচ হাতুরুসিংহের বেশ সুনজরেই রয়েছেন এ ব্যাটার। এটার সত্যতা কিছুটা মেলে অবশ্য।

এই ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগের কথাই টেনে আনা যাক। রনি তালুকদার শেষ ৩ ম্যাচে করতে পেরেছেন মাত্র ৫৭ রান। অন্যদিকে, এনামুল হক বিজয়ের শেষ ৩ ম্যাচেই রয়েছে দুটি সেঞ্চুরি। কিন্তু জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে এমন পরিসংখ্যান যেন দৃষ্টিসীমাতেই আসেনি টিম ম্যানেজমেন্টের।

রনিকে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট বলা যায়। সেখানে তিনি আট বছর বাদে ফিরে বেশ পারফর্মও করেছেন। ২০ ওভারের ফরম্যাটে শক্ত একটা অবস্থান তিনি সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু, সেই পারফরম্যান্স নিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁকে ইংল্যান্ডের মত কঠিন কন্ডিশনে পাঠানো যায় কি?

একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলে জায়গা পাওয়ার সর্বশেষ পরীক্ষার মঞ্চ নিশ্চিতভাবেই ডিপিএল। সেই পরীক্ষায় এনামুল হক বিজয় যে লেটার মার্কস পেয়েই পাস করেছেন, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা না। তারপরও বিজয়ের প্রতি কেন এত অ-গ্রাহ্যতা, অগ্রহণযোগ্যতা, উদাসীনতা? ব্যাপারটা রহস্য জাগায়, বিস্মিত হওয়ার মতো বোধোদয় সৃষ্টি করে। কিছুটা আক্ষেপও জাগায় বটে।

এমন আক্ষেপ, আফসোস অবশ্য বিজয়ের মাঝেও নিশ্চিতভাবেই আছে। রান করার বাইরে আর তিনি কিইবা করতে পারেন? ঘরোয়া লিগে রান করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও নিজের ফেরাটা স্মরণীয় করে রেখেছিলেন। কিন্তু এক সিরিজ বাদেই সব কিছুর ভাগফল শূন্য।

বিজয়কে আবারো প্রমাণ করার মঞ্চে ধাবিত হতে হয়েছে। সেই মঞ্চ ডিঙ্গিয়ে আবার যে কবে প্রত্যাবর্তন হবে তা এক প্রকার ঘোর অনিশ্চয়তায়। এমন অনিশ্চয়তায় পারফর্ম করার তাড়নাই টা না আবার ফুরিয়ে যায়!  দিনশেষে, ব্রাত্যতার জালে কেইবা আটকে থাকতে চায় অজানা সময় সীমায়?

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link