বঙ্গ ফেসবুক জগৎ ঋদ্ধি বন্দনায় মশগুল। এবং সঙ্গত কারণেই। আজ ঋদ্ধি অনবদ্য খেলেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিই কি ঋদ্ধি এবার পাকাপাকি ভাবে ভারতীয় একাদশে সুযোগ পাবার বন্দোবস্ত করে ফেললেন? উত্তর টা এক কথায় দিলে, না।
ঋদ্ধির কিপিং দক্ষতা সন্দেহাতীত। শুধু ভারত কেন, বিশ্বের অন্যতম সেরা উইকেট রক্ষক বাংলার ‘পাপালি’। কিন্তু ব্যাটিং? ঋদ্ধির ব্যাটিং বরাবর তাঁর ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। তিনি যে সময়ে জন্মেছেন, তার বছর কুড়ি আগে জন্মালে, ঋদ্ধি হয়তো গোটা ষাটেক টেস্ট আরামসে খেলে দিতেন। কিরমানি পরবর্তী এবং ধোনি পূর্ববর্তী সময়ে হয়তো হয়ে দাঁড়াতেন ভারতের অন্যতম ভরসার জায়গা। কিন্তু বর্তমান যুগে, যেখানে কিপিংয়ের সাথে সাথে ব্যাটিংটাও সমান জরুরি, ঋদ্ধি কিন্তু পান্তদের থেকে খানিক পিছিয়ে গেছেন।
ঋষাভ পান্ত শুরুর দিকে একেবারে খাজা কিপিং করতেন। ব্যাটিং দক্ষতা তাঁর চিরকালীন। কিন্তু দলে টিকে থাকার জন্যে, কিপিংটাতেও মন দিলেন। এবং এখন অশ্বিন, জাদেজাদের সামনে ঘূর্ণি উইকেটেও তাঁকে অপ্রতিভ লাগে না। হয়তো তার পিছনে ঋদ্ধিমানের কিছুটা অবদান আছে। মানে না থাকলেই আমি অন্তত আশ্চর্য্য হবো। কিন্তু ঋদ্ধি তাঁর ব্যাটিংকে সেই স্তরে উন্নীত করতেই পারেননি। হয়তো চরম খেটেছেন। কিন্তু ফাইনাল মার্কশিটে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
তবে এটাও ঠিক যে ঋদ্ধির জীবনের সেরা সময়ে ধোনি উইকেট রক্ষকের জায়গায় ছিলেন। ২০১৫ থেকে যখন পাকাপাকি ভাবে ঋদ্ধির কাছে সুযোগ এলো, তখন তিনি ৩১। তবুও ২০১৫ থেকে ২০১৭র শেষ অব্দি অসম্ভব ভালো খেলে গেছেন। কঠিন সময়ে রান করার জন্যে, সেই সময়ে বারবার ঋদ্ধির ডাক আসতো। এবং তিনি খুব একটা হতাশ করতেন না।
কয়েকটা উদাহরণ দি। ২০১৬ সালে এই নিউজিল্যান্ডেরই বিপক্ষে ইডেনে জোড়া হাফ সেঞ্চুরি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে কঠিন সময়ে সেঞ্চুরি। ২০১৭ সালে যেবার অস্ট্রেলিয়া ভারত সফরে এলো, সেবারও পুজারার সাথে জুটিতে রাঁচির সেঞ্চুরি ও জাদেজার সাথে জুটিতে ধর্মশালায় কিছু অত্যন্ত জরুরি রান।
কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে। এই সময়ে ভারত উপমহাদেশের বাইরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া একটাও সফর করেনি। প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েই ঋদ্ধির ব্যাট কিন্তু বোবা হয়ে গেলো। বাঙালি আবেগ একটু সরিয়ে রেখে বলি, বিদেশ সফরে বেশ কিছু সুযোগেও ঋদ্ধি কিন্তু সেভাবে দাগ কাটতে পারেননি। এবং ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাতে বেশির ভাগ সময় পেসের বিপক্ষে কিপিং করার জন্যে কিছু বিরাট দরের কিপার প্রয়োজন হয় না। বরং কিপার যদি ব্যাটিং টা করে দিতে পারেন, দলেরই আখেরে লাভ।
স্পিনটা ঋদ্ধি বরাবর ভালো খেলতেন। কিন্তু কঠিন পিচে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পেস বোলিং খেলতে তিনি বারবার অক্ষম হয়েছেন। এছাড়া চোট তো ভুগিয়েছেই। ঋদ্ধি কিন্তু সেই দলের ক্রিকেটার যাঁরা হয়তো খুব একটা দক্ষ নন। কিন্তু বুকের খাঁচা দিয়ে বাকিটা ম্যানেজ করে নেন। ‘দক্ষ নন’ টা অবশ্যই ব্যাটিংয়ের কথা মাথায় রেখেই বলছি। আরেকটি দলেও ঋদ্ধি চোখ বুঁজে চলে আসেন। অসময়ে জন্মানো ক্রিকেটার্স ক্লাব। যেমন ব্র্যাড হজ। যেমন ডেমিয়েন ফ্লেমিং। যেমন উইনস্টন ডেভিস। যদি ধরেই নি এরপর চোট এবং পান্থের ফিরে আসা মিলিয়ে ঋদ্ধি আর খেলবেন না। তাই আজকের ৬১ উপরিউক্ত দুটো ক্লাবেই ঋদ্ধির মেম্বারশিপ আরও পাকা করলো।
ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, ঋদ্ধির ভারতীয় ক্রিকেটকে অনেক কিছু দেবার বাকি আছে। তবে মাঠের বাইরে থেকে। সমস্ত উঠতি কিপার-ব্যাটারদের কিপিং প্রশিক্ষকের ভূমিকায় ঋদ্ধি অবতীর্ণ হলে আখেরে ভারতীয় ক্রিকেটেরই লাভ। কারণ আজকের ইনিংসের পরেও, দক্ষিণ আফ্রিকায় রাবাদা এন্ড কোম্পানিকে ঋদ্ধি ৩৭ বছর বয়সে পান্থের চেয়ে ভালো খেলে দেবেন, এ বোধহয় ঋদ্ধির অন্ধ সমর্থকও মনে করেন না।
প্রথম ইনিংসের পর ঋদ্ধির দিকে যে পরিমাণ ট্রোলের বন্যা হয়েছিল, তা নিতান্তই কুরুচিকর এবং যুক্তিহীন। সেটা আজকাল আকছার হয়েই থাকে। ও নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর মানেই হয় না। কিন্তু ঋদ্ধির দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফুরিয়ে এসেছে, এই সহজ সত্যিটাও মেনে নেবার সময় এসেছে। ভবিষ্যতে তাই আমি অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে ঋদ্ধিকে দ্রাবিড়-রাঠোরের পাশের চেয়ারটায় দেখতে চাই।