তিনি ভারতের ক্রিকেটের ক্রাইসিস ম্যান। দলের সবাই এক বাক্যে স্বীকার করতো দল বিপদে পড়লে সবচেয়ে বড় ভরসার নাম যশপাল শর্মা। মিডল অর্ডারে শক্ত করে ধরে রাখতেন দলের হাল। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দিল্লি টেস্ট কিংবা ১৯৮৩ বিশ্বকাপের বড় মঞ্চ। সবখানেই ত্রানকর্তা হয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী এই ক্রিকেটার আজ হয়তো পাড়ি জমিয়েছেন পৃথিবী ছেড়ে নতুন কোনো দিগন্তে, তবুও তিনি থাকবেন ভারতের ক্রিকেটের ঐতিহাসিক মহাকাব্যে।
তিনি হয়তো টেকনিকালি সেরাদের একজন ছিলেন না। তবে নিজের সীমাবদ্ধতার সাথে লড়াই করে হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপের প্রাণভোমরা। ১৯৭৭ সালে দুলীপ ট্রফির সেমিফাইনাল ম্যাচে ১৭৩ রান করে প্রথম আলোচনায় আসেন। সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলে ছিল ভগবৎ চন্দ্রশেখর কিংবা আবিদ আলীর মত বোলাররা। তবে ওই টেকনিকের কারণে এত আলোচিত হয়েও নির্বাচকদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি।
তবে জবাবটা দিয়েছিলেন পরের বছর। দেখিয়েছিলেন কীভাবে নিজের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সেরাদের সেরা হতে হয়। শুধু নিজেকে চেনা প্রয়োজন। ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ৭৬.২০ গড়ে করেছিলেন ৭৬২ রান। সে বছর ভারতের ক্রিকেটার অব দ্য ইয়্যারও হয়েছিলেন যশপাল শর্মা। ১৯৭৯ সালে ভারতের বিশ্বকাপ দলের সাথে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। তবে সেই বিশ্বকাপে একটিও ম্যাচ খেলেননি তিনি।
তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে লর্ডসে অভিষিক্ত হন তিনি। তবে যশপাল শর্মার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা আসে দিল্লিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। পরের ম্যাচেও ভারতকে প্রায় একাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন। ১১৭ বলে খেলেছিলেন ৮৫ রানের অপরাজিত এক ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ২৪৭ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে এই ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। তবে ভারত ২০০ রান করার পরই আলোক স্বল্পতার কারণে খেলা বন্ধ হয়ে যায়।
সে বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে দিল্লী টেস্টেও হারতে বসেছিল ভারত। তবে সেই ম্যাচেও প্রতিরোধ গড়েছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ৮৪ বলে ২৮ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ১৩৫ বলে করেন ৬০ রান। তাঁর এই জোড়া ইনিংসেই ম্যাচ ড্র করেছিল ভারত।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও বিশ্বনাথের সাথে করেছিলেন মহাকাব্যিক এক জুটি। তৃতীয় উইকেটে ভারতের সর্বোচ্চ ৩১৬ রানের জুটি এসেছিল তাঁদের ব্যাট থেকেই। সেখানে যশপালের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৪০ রান। সেই ম্যাচের টেস্টের পুরো একদিন ব্যাটিং করেছিলেন এই দুইজন।
১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জয় করে এসেছিল ভারত। সেই বিশ্বকাপ দলের অনেকেই ভারতীয় ক্রিকেটের মহাতারকা। তবে সবচেয়ে কম আলোচনা হয়েছিল বা হয় যশপাল শার্মাকে নিয়েই। যদিও সেই বিশ্বকাপে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনিই। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই খাঁদের কিনারা থেকে দলকে তুলে এনেছিলেন এই ক্রাইসিস ম্যান।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ১২০ বলে খেলেন ৮৯ রানের ইনিংস। তাঁর ব্যাটে চড়েই ৩৪ রানের জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল ভারত। এরপর ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেছিলেন যথাক্রমে ৬১ ও ৪০ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। ওই বিশ্বকাপে ৩৪.২৮ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল মোট ২৪০ রান। ফলে ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে অন্যতম নায়ক ছিলেন এই ব্যাটসম্যান।
১৯৮৫ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে দেশটির হয়ে খেলেছেন মোট ৩৭ টেস্ট ও ৪২ ওয়ানডে ম্যাচ। টেস্টে ৩৩.৪৫ গড়ে তাঁর ঝুলিতে আছে ১৬০৬ রান। এছাড়া ওয়ানডে ক্রিকেটেও ৮৮৩ রানের মালিক তিনি। ক্রিকেটকে বিদায় জানানো পরেও নানা ভূমিকায় ক্রিকেটের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।
কোচিং, ধারাভাষ্য কিংবা আম্পায়ারিং সবগুলোই করেছেন তিনি। এছাড়া দুই দফায় ভারতের নির্বাচক কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ী দল গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। আজ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া অবধি ছিলেন দিল্লী ক্রিকেটের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য।