সাল ২০১৬। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরের পর তাদের এফটিপির সবচাইতে বড় সফরের সিরিজটা খেলতে ভারতে পা রেখেছে। এই সফরের আগে শেষবার যখন ইংল্যান্ড ভারতে খেলতে এসেছিল, ফিরে গেছিল বেশ বড় জয় নিয়েই। শেষবারের স্মৃতি পুনর্বার রোমন্থন করতেই কিনা, অধিনায়ক অ্যালিস্টেয়ার কুক তাঁর দল সাজালেন ‘নবীন প্রবীণ এক প্রাণ’ মন্ত্রে।
সেই ‘এক প্রাণ’ দলেরই এক নবীণ ছিলেন জাফর আনসারি! সারেতে খেলা এই বাঁ-হাতি স্পিনার ইংলিশ উইকেটে শেষ মৌসুমে যেভাবে ভেল্কি দেখিয়েছেন, পকেটে পুরেছেন একের পর এক উইকেট, ভারতের তখনকার স্পিন ট্রাকে জাফর আনসারিকে কুকের নামাতেই হত। তবে সারের হয়ে খেলা জাফর আনসারির বিশেষত্ব এটুকুতেই থেমে যায়নি।
কেননা, মাত্র ২১ বছর বয়সে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান আর রাজনীতিতে যুগল ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে গেছেন জাফর আনসারি। শুধু তাই না, ২০১৬ তে এই সিরিজে ডাক পাওয়ার আগে, জাফর আনসারি লিখে ফেলেছেন ৪০ হাজার শব্দের এক নিবন্ধ, যার মূল বিষয় ছিল- ‘১৯৬০ এ আফ্রো-আমেরিকান স্ব-প্রতিরক্ষা এবং এর সাথে কৃষ্ণ বর্ণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সম্পর্ক।’
তার এই গুণের কথা টেস্ট ক্যাপ মাথায় তোলার আগেই চাউর হয়ে গেছিল চারদিক। ততদিনে তাই ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা সবচাইতে ‘স্মার্ট’ ক্রিকেটারের তকমা জুটে গেছে জাফরের কপালে।
কিন্তু জাফর তার এই ক্রিকেটার হওয়ার নিয়তির সাথে পরিহাস করতে বেশি সময় নিলেন না। সেই সিরিজে ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠ মাতানো বাঁ-হাতি স্পিনারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল কয়েক মাস পরেই, মাত্র ২৫ বছর বয়সে!
নাহ, জাফরের কোন ইনজুরি সমস্যা ছিলনা, ছিলনা কোন শৃঙখলাজনিত সমস্যাও, অভিষিক্ত ক্রিকেটার হিসেবে তার পারফর্ম্যান্স তিন টেস্টে খুব খারাপও ছিল না। তাহলে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন!
হ্যা, ভুল শুনছেন না। এই এখন যে সময়টা আমরা ভিনদেশের যে নির্বাচন নিয়ে মেতে আছি, সেই নির্বাচনই জাফর আনসারির ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার মূল কারণ! পুরো গল্পটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই ২০১৬ সালে, রাজকোট টেস্টে!
৯ নভেম্বর, ২০১৬। রাজকোটে তখন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফিল্ডিং-এ স্বাগতিক ভারত, ব্যাটিং পিচে তখন জো রুট আর মঈন আলী। ক্রিকেট পিচে যখন মঈন আলী আর জো রুট সেঞ্চুরির পথে, ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস যখন বেশ ফুলে ফেঁপে উঠছে, ড্রেসিং রুমে তখন বড্ড অস্বস্তিতে জাফর আনসারি।
মাঠে নিজ দেশের ব্যাটসম্যানেরা ব্যাট করছেন, নিজে আছেন দলের একাদশে, অথচ জাফর আনসারি কিনা তাঁর পূর্ণ মনোযোগ মাঠে দিতেই পারছিলেন না।কারণটা তো আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। হাজার মাইল দূরের সেই নির্বাচন নিয়ে জাফর আনসারির আগ্রহের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, তিনি আক্ষরিক অর্থেই এর খবর পাওয়ার জন্যে ড্রেসিং রুমে ছটফট করছিলেন।
কিন্তু বিধি বাম! ড্রেসিং রুমে তো মোবাইল ফোন ব্যাবহার করতে দেওয়া হয়না। আনসারি তাই বারবার ড্রেসিং রুম ছেড়ে ছুটে যাচ্ছিলেন নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে। কিন্তু তারাও আনসারিকে যতটুকু তথ্য দিতে পারছিল, আনসারির তৃষ্ণা বাড়ছিল তাতে আরো বেশিই। এভাবেই পুরো একটা দিন কেটে যাবার পর আনসারি যখন ফোন হাতে নিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন অফিশিয়ালি বিজয়ীর মুকুট পরার অপেক্ষাতে।
এতটাই রাজনীতিকে ভালবাসেন আনসারি। পরে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাফর বলেছেনও সেদিনের অভিজ্ঞতা, ‘ওই দিনটা আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটা বার্তা দিয়েছিল। এসব ছেড়ে ক্রিকেট খেলাটা আমার জন্যে আসলেই কঠিন।’
রাজকোটের গেট থেকে বেরোবার ঠিক ৫ মাস পর জাফর আনসারি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন। এমন কিছুকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন, যা হয়তো ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা ‘টেস্ট ক্রিকেটার’ এর মাহাত্মকে স্পর্শ করবে না, কিন্তু জাফরকে ড্রেসিং রুমে ছটফটে অবস্থাতেও রাখবেনা।
এরপর জাফর আনসারি নানা সময়ে নানা কাজ করেছেন। কখনও শিশু আইন নিয়ে কাজ করেছেন, কখনও দাতব্য সংস্থার হয়ে কম বয়সী মানুষকে ইমিগ্রেশনে সহায়তা করেছেন, কখনও স্কুল প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন, কখনও বা রাষ্ট্রের দায়ে আত্মীয়কে চিরদিনের মত হারানো মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহায়তা দিয়েছেন দাতব্য সংস্থার অংশ হিসেবেই! এই কাজ হয়তো অহম, স্বীকৃতি কিংবা খ্যাতি দেয়না, কিন্তু জাফরের তো এটাই ভাল লাগে!
ক্রিকেট একটা দারুণ বিষয়। এখানে আপনি হয়তো একটা রান আউট, একটা বিশাল ছক্কা কিংবা ধ্রুপদী ক্যাচের মাধ্যমে ‘হিরো’ খুঁজে পাবেন। তবে মনে রাখবেন, ক্রিকেট মাঠই শুধু হিরোদের মঞ্চ নয়। এর বাইরে এই তাবৎ পৃথিবীর আনাচে কানাচেও শত হিরো আছেন, কাজ করে চলেছেন নির্ভীক চিত্তে, আত্মত্যাগের মহিমাতে!
জাফর আনসারি কি আমাদের সেই হিরোদের কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন না?