১.
এই শতাব্দীর প্রথম ওডিআই ক্রিকেটের বিশ্বকাপের আসর বসবার কথা দক্ষিণ আফ্রিকায়। শতাব্দীর শুরুতেই ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম কালো অধ্যায় পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বেহালার এক হাল না ছাড়া মনোভাব সম্পন্ন জেদি যুবকের হাত ধরে।
যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ তাই ভালো মানের পেসার চায় দলে। কিন্তু ভারতীয় দল সারা জীবন স্পিনার নির্ভর দল। এদিকে ভেঙ্কটেশ প্রসাদ নেই, কয়েকজন তরুণ পেসার যদিও উঠে আসছে। এমন সময় ভারতের সীমিত ওভারের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ সিদ্ধান্ত নিলেন অবসর নেবেন।
ভারতীয় দল ও দলের অধিনায়কের দিশেহারা হওয়ার অবস্থা। কিন্তু সেই ‘হাল না ছাড়া’ অধিনায়ক আশা ছাড়লেন না। কথা বললেন শ্রীনাথের সঙ্গে। বরফ গললো, তিনি রাজি হলেন বিশ্বকাপে তরুণ ভারতীয় পেসারদের নেতৃত্ব দিতে।
বিশ্বকাপ শুরু হতেই নিজের জাত চেনাতে লাগলেন শ্রীনাথ। সঙ্গ দিতে থাকলেন দুই বাঁ-হাতি তরুণ পেসার। এভাবেই বিশ্বকাপের ফাইনালে আগের বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার সাথে। তার আগে সেমিফাইনালে দুর্বল কেনিয়ার সাথে ১৪ রানে ৩ উইকেট নিয়ে একজন বাঁ-হাতি পেসার সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার তালিকায় চতুর্থ স্থানে পৌঁছালেন এ ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়ে। যদিও অভিজ্ঞ শ্রীনাথ ও আরেক বাঁ-হাতি পেসার আশিষ নেহরাও অনেকগুলো উইকেট নিয়ে ভারতকে দ্বিতীয় বার চাম্পিয়ন হওয়ার অবস্থানে নিয়ে এসেছেন।
এরপর এলো সেই দুঃখের স্মৃতি। ফাইনালে এই তিনজন কোনো উইকেট নিতে পারেননি যার ফল ভারতীয় দল অনুভব করেছিল প্রবলভাবে। কোটি কোটি ভারতবাসীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বকাপ জয় হয়নি। তবে, যদিও এর পরবর্তী এক দশক জুড়ে ভারতের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে নিজেকে জাহির করতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি হলেন জহির খান।
২.
২০১১ সাল। এবার একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপের আসর বসেছে উপমহাদেশে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে আগের বিশ্বকাপে হতাশাজনক ফল ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে মশগুল ভারতীয় দলসহ গোটা ভারতবাসীর। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের অসাধারণ মিশেল এবং আরেক অসাধারণ অধিনায়কের সাম্প্রতিক অতীতের সাফল্য, এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার আশা আরও প্রবল করেছে।
ব্যাটিংয়ে অসাধারণ সব অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান থাকলেও সবাই জানে যেকোনো টুর্নামেন্ট জেতায় বোলাররাই। ভারতের মাটিতে স্পিনারদের প্রাধান্য বেশি থাকলেও ২০০৩ সালের সেই বাঁ-হাতি পেসার, যিনি আজ দলের অন্যতম সেরা ভরসা; যার অসাধারণ ‘ট্র্যাডিশনাল সুইং’ ও ‘রিভার্স সুইং’ বিপক্ষের রাতের ঘুম হারাম করে। জহির খান এবার ভারতীয় পেস বিভাগকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তৈরী।
ভারত প্রত্যাশা মতোই তৃতীয় বারের জন্য ফাইনালে গেল। আর তার অন্যতম প্রধান কারিগর কিন্তু ওই জহির খানই। ফাইনালে কিন্তু এবার তিনি আর হতাশ করলেন। শুরুতেই বিপক্ষকে চেপে ধরে বেশি রান হওয়া থেকে বিরত রাখলেন। নিজে দুই উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের যুগ্ম সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হিসেবে শেষ করলেন।
আর সেদিন রান তাড়া করতে নেমে শুরুতে বেসামাল হয়েও ভারতকে দুটি বিশ্বকাপ দেওয়া এক অসাধারণ ব্যাটসম্যান ও ভারতকে দুটি বিশ্বকাপ দেওয়া উইকেটরক্ষক অধিনায়কের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে গোটা ভারতবাসীর স্বপ্ন সফল হয়েছিল।
২৮ বছর পর রাচির যুবকের হাতে ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শোভা পাওয়ার অন্যতম কারিগর যে ওই অভিজ্ঞ পেসার ছিল যার একবার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে, একথা মেনে নিতে কারোর আপত্তি তখনও ছিল না, এখনও নেই। এভাবেই এক অসম্পূর্ণ বৃত্ত পূর্ণতা পেয়েছিল, আর ইনি হয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের এক কিংবদন্তি।
৩.
মহারাষ্ট্রের সিরডি হতে হতে ৪০ কিমি দূরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়ার সময় থেকেই এনার অসাধারণ প্রতিভার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে, একজন ছাত্র হিসেবেও তিনি খুব ভালো ছিলেন। একটা সময় যখন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ক্রিকেটের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার সময় এলো তখন কোচ এসে তাঁর বাবাকে পরামর্শ দিলেন ক্রিকেটকে বেছে নিতে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সমস্ত মায়া কাটিয়েও বাবা মেনে নিলেন এবং ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর দায়িত্ব নিজে নিলেন। ছেলেকে মুম্বাইতে নিয়ে গিয়ে কোচিং এর ব্যবস্থা করলেন। বাবা নাকি সেদিন বলেছিলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার তো অনেকেই হতে পারে, তুমি বড় ক্রিকেটার হয়ে দেখাও!’
ব্যস, জীবনের মোড় ঘুড়ে গেল জহির খানের। প্রবল মনোযোগী এবং শৃঙ্খলাপরায়ন এই টিনএজার ভালো ভাবেই নিজের দক্ষতা ও প্রতিভা সবার সামনে ফুটিয়ে তুলতে থাকলেন। এভাবেই মুম্বাই ও পশ্চিমাঞ্চল অনূর্ধ্ব- ১৯ দলে জায়গা করে নিলেন।
শুধু প্রতিভা ও দক্ষতাই কোনো মানুষকে কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে দেয় না। এর জন্য প্রয়োজন একজন সঠিক পথপ্রদর্শকের। এমনই এক অসাধারণ পথপ্রদর্শকের দেখা পেলেন চেন্নাইয়ের এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে যিনি নিশ্চিত করলেন এই তরুণ জহির যেন ভারতের হয়ে সেবা করতে পারেন। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ডেনিস লিলি। জহুরীর ছোঁয়ায় জহিরের ভেতরে থাকা রত্নটা পেল পূর্ণতা।
ভারতীয় ক্রিকেটের কালো অধ্যায়ের পরেই চাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম ম্যাচেই অভিষেক হলো ওই তরুণ জহিরের, নতুন বলও পেলেন তিনি। অভিষেকেই তিন উইকেট নিয়ে নিজের জানান দিয়ে দিলেন বিশ্বকে। পরের ম্যাচেই কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি যখন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, স্টিভ ওয়াহ’র স্ট্যাম্প ছিটকে দিলেন সেদিনই ২২ পেরিয়ে ২৩ পা দিলেন। ভারতও অসাধারণ জয় পেলো।
পরের মাসেই জাতীয় টেস্ট দলে অভিষেক হয়ে গেলো। প্রথম দিকে ততটা সাফল্য না পেলেও দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে তৈরী করতে লাগলেন। এরপর ২০০৩ বিশ্বকাপে সাফল্য; অত:পর দলের প্রধান পেসার হয়ে ওঠার সূচনা। অন্য ধরনের ক্রিকেটার হিসেবে সবাই দেখতে পেলো তাঁকে।
এরপর নিজের খারাপ বা ভালো সময় এসেছে কিন্তু বারবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন সেটা দেশে হোক কিংবা বিদেশে। এরপর ভারতকে যখন বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার প্রধান কারিগর রূপে প্রতিষ্ঠিত করলেন নিজেকে তখন কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। বিশ্বকাপ জিতে মহেন্দ্র সিং ধোনি বলেছিলেন, ‘জহির হলেন বোলিংয়ের শচীন টেন্ডুলকার।
একজন পেসারের যে সব গুণ প্রয়োজন তা সবই ছিল তাঁর ঝুলিতে। আর একজন বাঁ-হাতি স্যুইং পেসার তো সবসময় অন্য সম্মান পান ক্রিকেটে। তবে যেটার জন্য তিনি সবার সম্মান আদায় করে নিয়েছেন তা হলো পেসারদের এক অসাধারণ শিল্পকলা ‘রিভার্স স্যুইং’। এই অসাধারণ শিল্প দিয়ে তিনি কত শিকার করেছেন তার ইয়াত্তা নেই। ইংলিশ পেসার জেমস অ্যান্ডারসনও জহির খানকে দেখেই রিভার্স স্যুইং আয়ত্ব করেছেন, নিজেই স্বীকার করেছেন। বিশ্বকে জহির উপহার দিয়েছেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অন্যতম সেরা বোলিং অস্ত্র – ‘নাকল বল’।
ভারতীয় পেসারদের সমীহ করার বিশ্বাসটা দিয়ে গিয়েছিলেন জহির খান। ভারতীয় ক্রিকেট তার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। উইকেট নেওয়ার পর দুই হাত মেলে ধরে অনাবিল সুন্দর সেই হাসিটা মিস করে ক্রিকেট বিশ্ব।