নিল জনসন, ফ্লাওয়ার ভাই, মারে গুডউইন, হিথ স্ট্রিক, হেনরি ওলোঙ্গা, এডো ব্রান্ডেসদের সেই ‘ব্র্যান্ড অফ জিম্বাবুয়ে’ ক্রিকেট আগের সেই কৌলিন্য হারিয়েছে। সোনার সময় পেরিয়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্তের সাক্ষীও থেকেছে, টেস্ট স্ট্যাটাস চলে যাওয়ার পর আবার তা ফিরেও এসেছে।
দেশটির ক্রিকেটে দুর্নীতি, অর্থের অভাবের সাথে প্রকট হয়েছে বহু সময়ে প্রতিভার অভাবও, কখনো প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি দেশের ক্রিকেটের অন্তর্কলহে। হ্যামিলটন মাসাকাদজার অবসরের পর দেশের ক্রিকেটের এক বটবৃক্ষ ও আজ অনুপস্থিত। এই কঠিন সময়েও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের মর্যাদাকে বিশ্বের দরবারে যাঁরা খানিকটা হলেও বাঁচিয়ে রেখেছেন বা আগামী দিনে বাঁচিয়ে রাখার দাবি রাখেন তাঁদের নিয়েই আজ গল্প হোক।
- ব্রেন্ডন টেলর
গত দেড় দশকে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের যতই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাক না কেন তাদের ব্যাটিংয়ের মূলস্তম্ভ ৩৪ বছরের এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানটি। স্কিল ও টেকনিকে বিশ্বসেরাদের থেকে টেলর কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। ফ্লাওয়ার ভাইদের অবসরের পর জিম্বাবুয়ের ব্যাটিংকে হ্যামিলটন মাসাকাদজার সঙ্গে জুটি বেঁধে টেনে নিয়ে গেছেন তিনি, আজও সেই ব্যাটে মরচে পড়েনি।
২০০৪ সালে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেকের পর প্রায় ২০০’র কাছাকাছি একদিনের ম্যাচে ১০ শতরান সমেত সাড়ে ছয়হাজারের মতো রান, গড় ও ৩৫ এর ওপর। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৩৫০র ওপর রান তাড়া করতে নেমে অনবদ্য ১৪৫* রানের ইনিংস বা ২০১৫ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে ১৩৮ রানের ইনিংস দুটি টেলরকে সেরাদের কাতারে রাখার জন্য যথেষ্ট। এছাড়া সেই বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধেও ৩০০ রানের বেশি তাড়া করা ম্যাচে দুর্দান্ত ১২১ করলেও দলকে যদিও জেতাতে পারেননি তিনি।
একসময় অধিনায়কত্বের দায়িত্ব সামলানো এই ব্যাটসম্যান টেস্ট ক্রিকেট ও টি-টোয়েন্টিতেও যথেষ্ট সফল। ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জিম্বাবুয়ের অসাধারণ জয়ে টেলরের ৬০* ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১০ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতকে হারাতে কিংবা পরের বছর নিউজিল্যান্ড এর বিরুদ্ধে অসাধারণ জয়ে টেলরের চওড়া ব্যাটই সবচেয়ে ভরসার হয়ে দাঁড়ায়।
সেই নিউজিল্যান্ড সিরিজে পরপর দুই ম্যাচে শতরান হাঁকিয়ে প্রথম জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটার হিসাবে অনন্য কীর্তি স্থাপন করেন টেলর। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্টে ১৭১ রানের অনবদ্য ইনিংস বাংলাদেশকে হারিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের আবার ছাপ ফেলতে বড় ভূমিকা নেয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ক্রিকেটার টি দেশকে একদিনের বিশ্বকাপের মূলস্রোতে আবার ফিরিয়ে আনবেন এ আশা করাই যায়।
- শন উইলিয়ামস
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সাইলেন্ট পারফর্মার বলা হয় বছর ৩৩ এর বাঁ-হাতি এই অলরাউন্ডারকে। ২০১১ বিশ্বকাপে চোটের জন্য খেলা না হলেও ২০০৭ ও ২০১৫ এর বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করেছেন এই স্টাইলিশ ক্রিকেটার। গত ১৫ বছর ধরে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটার সেবা করে চলা উইলিয়ামস ১৩০ এর বেশি ম্যাচে ৩৪ গড়ে প্রায় ৪০০০ এর কাছাকাছি রান ও ৭০ এর বেশি উইকেটের মালি।
টি-টোয়েন্টিতেও বল হাতে দারুণ সফল এই ক্রিকেটার টেস্ট মাত্র ১২ টি খেলার সুযোগ পেলেও দুটি শতরানে তাঁর প্রতিভার নমুনা দেখিয়েছেন। মাসাকাদজার অবসরের পর বর্তমান জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক সব ফরম্যাটেই আরো আলো ছড়াবেন আশা করা যায়।
- সিকান্দার রাজা
পাকিস্তানি বংশদ্ভুত এই জিম্বাবুইয়ান অলরাউন্ডার ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি বিশ্বে বর্তমানে পরিচিত মুখ হলেও দেশের হয়েও দারুণ সফল তিনি। ২০১৩ থেকে প্রায় ১০০’র মতো একদিনের ম্যাচে তিনটি শতরান ও ৫৭ টি উইকেট নিয়ে যথেষ্ট ছাপ রেখেছেন তিনি। ২০১৩ সালে বিরাট কোহলির ভারতের বিরুদ্ধে একদিনের সিরিজে নিজের মাত্র চতুর্থ ম্যাচেই অনবদ্য ৮২ রানের ইনিংস খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ছাপ ফেলেন রাজা।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেকেও সফল রাজা একদিনের ক্রিকেটে তাঁর অন্যতম সেরা ইনিংসটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই খেলেন। ২০১৫ সালে লাহোরে পাকিস্তানের বোলিং সামলে ৮৪ বলে ১০০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস উপহার দেন। ওই ২০১৫ সাল আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলা যায় তাঁর ফুল ফোটানোর বছর, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে আবারো দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরি আসে রাজার ব্যাট থেকে।
২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে একদিনের সিরিজ জয়ের অন্যতম কারিগর তিনি। টেস্টে একটি শতরান তাঁর নামের পাশে থাকলেও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর নামের প্রতি ততটা সুবিচার এখনো করতে পারেননি হার্ড হিটার ও দারুণ টেকনিক সমৃদ্ধ এই ব্যাটসম্যান। ২০১৮ তে বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে ৩০০’এর ওপর রান ও ১৫ টি উইকেট নিয়ে অসাধারণ পারফরমেন্স করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেলেও দেশকে বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে না পারা রাজার এক বড়ো আক্ষেপ।
- ক্রেইগ আরভিন
২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতকে বেগ দেওয়া শন আরভিন কে মনে আছে? তাঁরই ছোট ভাই ক্রেইগ জিম্বাবুয়ে দলের ব্যাটিংয়ের অন্যতম স্তম্ভ। টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিক দুই ধরণের ক্রিকেটেই ৩ টি করে শতরান থাকা এই ক্রিকেটার যে কোনো সময় ম্যাচের মোড় ঘোরানোর ক্ষমতা রাখেন। বছর কয়েক আগে নিউজিল্যান্ড এর বিরুদ্ধে ৩০০ র ওপর রান তাড়া করে জয়ে আরভিনের শতরানই প্রধান ভূমিকা নেয়।
১৮ টি টেস্টে ১২০০’র ওপর রান করা আরভিন একদিনের ক্রিকেটেই সর্বাধিক আলো ছড়িয়েছেন। ১০০ এর কাছাকাছি একদিনের ম্যাচে আড়াই হাজারের বেশি রান করা আরভিন টি-টোয়েন্টিতেও দলের ভরসা..দারুন ফিল্ডার আরভিন সম্প্রতি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্টে অধিনাকত্বের স্বাদ ও পেয়েছেন উইলিয়ামসের অনুপস্থিতিতে।
- কাইল জার্ভিস
হিথ স্ট্রিকের অবসরের পর একজন স্ট্রাইক বোলারের অভাব খুব অনুভূত হত জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে। স্পিন নির্ভর জিম্বাবোয়ে বোলিং আক্রমণে প্রথম ভরসার পাত্র হয়ে উঠলেন যে পেসার। তিনি কাইল জার্ভিস। ২০০৯ সালে প্রথমবার সুযোগ পেলেও ছাপ ফেলতে তাঁর বছরে দুয়েক লাগে। আর গত কয়েকবছর ধরে জিম্বাবুয়ে পেস আক্রমণে অন্যতম ভরসার পাত্র হয়ে উঠেছেন মাত্র ১২ টেস্টে তিন বার ৫ উইকেট সমেত ৫০ এর কাছাকাছি উইকেট নেওয়া জার্ভিস।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে ৫ উইকেট নেওয়া অনবদ্য সব স্পেলগুলো তাঁর দুর্দান্ত বোলিং প্রতিভারই সাক্ষ্য বহন করে। একদিনের ক্রিকেটেও প্রায় ৬০ এর মত উইকেট নেওয়া জার্ভিস কুড়িবিশের ক্রিকেটেও সমানভাবে সফল। অভিষেকের পর থেকে স্থায়ী কোনো বোলিং জুটি পাননি জার্ভিস, কখনো তাঁর সঙ্গী হয়েছেন এমপোফু, কখনো ভোটোরি আবার কখনো তিরিপানো বা বর্তমানকালে টেন্ডাই চাতারা। তারপরেও নিজের কাজে সর্বদা অটল জার্ভিস চোটমুক্ত থেকে জিম্বাবুয়ে পেস বোলিংকে এবার আরো উঁচুতে নিয়ে যেতে পারেন কিনা সেটাই এখন দেখার।
- টেন্ডাই চাতারা
জিম্বাবোয়ে দলে উইকেটের দুদিকেই দারুন ভাবে সুইং করাতে পারা বোলার খুব কমই আছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা হলেন টেন্ডাই চাতারা। জার্ভিসের সাথে জুটি বেঁধে জিম্বাবুয়ে পেস বোলিংকে নেতৃত্ব দেওয়া চাতারা ৬৫ একদিনের ম্যাচে প্রায় ১০০’র কাছাকাছি উইকেটের মালিক। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিম্বাবুয়ের অসাধারণ টেস্ট জয়ে চাতারার পাঁচ উইকেট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
টেস্ট খেলার সুযোগ জিম্বাবুয়ে কম পাওয়ায় তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে কম লাল বলের ক্রিকেটে। আগামী দিনে চাতারার হাত থেকে বেরোনো দুর্দান্ত সুইং বোলিং জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে অন্য উচ্চতায় আবার তুলে ধরার আশা রাখা যায়।