বিরল প্রজাতির কিংবদন্তি

বলা হয়ে থাকে সেরা ছাত্ররা নাকি কখনো সেরা শিক্ষক হন না। বিশেষ করে ফুটবল জগতে ব্যাপারটা আরও বেশি প্রমাণিত। এর পেছনে কারণ অনেক। সবচেয়ে মোক্ষম কারণটা সম্ভবত নিজের শ্রেয়তর মানসিকতা, সামর্থ্যের মাপকাঠিতে দলের বাকি সবাইকে মাপার প্রবণতা। ব্যাপারটা একটা মিথ যদিও!

কেউ কেউ অবশ্য সে মিথ ছাপিয়ে ওঠেন। খেলোয়াড়ি জীবনে জাদুর কাঠিতে সর্বজয় করেন। এরপর ডাগআউটে বসে দেখান মগজের খেলটাও। এ প্রজাতির খেলোয়াড়-কোচের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তাইতো ফুটবল পরিমণ্ডলে খানিকটা ভিন্নতর সম্মানই দেখানো হয় এঁদের! 

এদিক থেকে বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন ‘ডার কায়জার’ ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছিলেন বিশ্বকাপ, ইউরো, ইউরোপিয়ান কাপ। ব্যালন ডি অরও বগলদাবা করেছেন একাধিকবার। এরপর কোচ হিসেবে এসে দিয়েগো ম্যারাডোনার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে জিতেছিলেন বিশ্বকাপ। মানদণ্ডটা যদি ধরা হয় ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবল, তবে আসতে পারে ইয়োহান ক্রুইফের নামও। 

শেষ চার বছরে এ তালিকায় যোগ হয়েছে আরও একটা বড় নাম। জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান।

খেলোয়াড় হিসেবে একজন সর্বজয়ীর যা যা থাকা প্রয়োজন, জিতেছেন তার সবই। ফ্রান্সের হয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ আর ২০০০ ইউরো জিতেছিলেন। জুভেন্টাসের হয়ে দুটো সিরিআ জিতে এসেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। ২০০৬ সালে অবসর নেয়ার আগে দলকে জিতিয়েছিলেন একটা লিগ আর একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা।

২০০৬ বিশ্বকাপেও ফ্রান্সকে প্রায় একাই নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। পেনাল্টিতে গোল করলেন, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় মার্কো মাতেরাজ্জিকে করলেন বিখ্যাত এক ঢুঁসও, যার ফলে দেখলেন লাল কার্ড। সেবার বিশ্বকাপ আর জেতা হলো না। হলে হয়তো অনন্য কোন উচ্চতাই ছুঁতেন জিদান। খেলোয়াড়ি জীবনও শেষ হলো সেখানে। তবে তার আগে ব্যক্তিগত ঝুলিতে ব্যালন ডি অর, আর বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জিতে তবেই অবসরে গেলেন। 

কিন্তু ফুটবল অন্তপ্রাণ প্রাণ যার ফুটবল মাঠ ছাড়া কি আর তার প্রানে আনন্দ থাকে? জিদানেরও রইলো না। শীঘ্রই ফেরার পাঁয়তারা করতে লাগলেন। জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদকে।

কার্লো অ্যানচেলত্তির অধীনে রিয়ালের ব্যাকরুম স্টাফে যোগ দেন তিনি। মিথ আছে, জিদানের অতুলনীয় ম্যান ম্যানেজমেন্টই বহুল আকাঙ্ক্ষিত লা দেসিমা জিতিয়েছিলো ২০১৩-১৪ মৌসুমে।

তবে আসল কোচিংয়ে আসতে গেলে ‘অভিজ্ঞতার’ দরকার ছিলো, সেটাও সঞ্চয় করলেন রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়াকে দেড় মৌসুমের মতো কোচিং করিয়ে। 

তবে যখন সুযোগটা অবশেষে তার কাছে এলো, রিয়াল মাদ্রিদ ভক্তরা এর আগের অর্ধ মৌসুমকে ভুলেই যেতে চাইবেন। রাফা বেনিতেজের অধীনে ২০১৫-১৬ মৌসুমে নিজেদের মাঠেই এল ক্লাসিকোয় মেসিহীন বার্সেলোনার কাছে ৪-০ গোলে নাস্তানাবুদ হয় দলটা, শিরোপার লড়াই থেকে পিছিয়ে পড়ে যোজন যোজন ব্যবধানে। যার ফলেই সুযোগটা আসে জিদানের কাছে। 

‘ভিনি-ভিডি-ভিসি’ যদি জুলিয়াস সিজারের কথা হয়, ফুটবলের ম্যানেজেরিয়াল ইতিহাসে এর যুতসই উদাহরণই হবেন জিদান। হবেনই না কেন? যে রিয়াল লিগে রীতিমতো ধুঁকছিলো, নিজেদের মাঠে বার্সেলোনার কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছিলো সে রিয়ালকে নিয়েই কিনা কাতালানদের মাঠে গিয়ে জিতলেন, বার্ন্ডট শুস্টারের পর ইতিহাসের দ্বিতীয় ম্যানেজার হিসেবে প্রথম এল ক্লাসিকোতেই জয়! এরপর সে দলটাকে নিয়েই লিগে লড়লেন শেষতক।

আসল খেলাটা দেখালেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। কৌশলে খানিক বদল এনে বের করে আনলেন বেল-বেনজেমা-ক্রিশ্চিয়ানোর সেরাটা। এক মৌসুম বাদেই ইউরোপসেরার শিরোপাটা ফিরলো সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। 

পরের মৌসুমে প্রবল প্রতাপে লিগও জিতলো জিদানের দল। প্রথম দল হিসেবে পর পর দুটো চ্যাম্পিয়ন্স লিগও। এর পরেরবার এসে অধারাবাহিকতার খেসারত দিয়ে আর লিগ হলোনা। কিন্তু ‘রুটিন’ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ঠিকই জেতালেন দলকে। প্রথম দল হিসেবে হ্যাটট্রিক বারের মতো! 

শতবর্ষ পুরনো ক্লাবটার ইতিহাস এমনিতেই বেশ সমৃদ্ধ। এখানে ছাপ ফেলতে হলে তাই আপনাকে অতিমানবীয় কিছুই করতে হতো। নাম পালটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হওয়ার পরে নিয়ম পালটে আরও কঠিন হয়েছে ইউরোপসেরার টুর্নামেন্টটা, দলগুলোর শিরোপা জেতাও তাই পায় বাড়তি মর্যাদা। সে টুর্নামেন্টটাকেই কিনা বানিয়ে ফেললেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার! এমন কীর্তির পরে জিদানের নামটা রিয়ালের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খচিত থাকারই কথা।

তিন মৌসুম রিয়াল মাদ্রিদের কোচের দায়িত্বে থাকার পর অবসাদ আর চাপ ঘিরে ধরাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় মোটেও। ২০১৭-১৮ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানোর পরেই জিদান ঘোষণা দেন ক্লাব ছাড়ার। কিন্তু খুব বেশিদিন থাকতে পারেননি কোচিংয়ের বাইরে। দলের দুরাবস্থায় আধ মৌসুম না যেতেই সান্তিয়াগো ডাক পড়ে তার।

সেবার কিছু না জিতলেও চলতি মৌসুমে আভাস দিচ্ছেন লিগ জেতানোর। হয়তো নিজেদের মাঠে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে ২-১ গোলে হারের বদলা নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও দেখাবেন পুরনো জাদু! হয়তো কোনোদিন ফ্রান্সের কোচ হয়েও জেতাবেন ইউরো। বিশ্বসেরাও করবেন দলকে! সেটা হলে হয়তো ডার কায়জারকেও ছোঁয়া, পেরোনো হয়ে যাবে এক নিমিষে।

তবে তা করা হোক বা না হোক; কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুর তিন বছরে যতো কীর্তি গড়েছেন, জিদান তাতেই বিশালতার দিক থেকে ছাপিয়ে গেছেন ম্যারাডোনা, জর্জ বেস্টদের। এখন অপেক্ষাটা কেবল অমরত্বের!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link