শেষ প্রশ্নের পর, লর্ডস প্যাভিলিয়নের পাশের সাংবাদিক সম্মেলনের ঘরটা তখন আবেগে উত্তঙ্গ। ফ্ল্যাশ লাইটের অবাধ ঝলকানি উপেক্ষা করে, মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে হাসি মাখা ম্লান মুখটা। সন্ধ্যার ঘন কালো আকাশে পাখির ঘরে ফেরার মতো। করতালির শব্দে কান পাতাই দায়। চলছে তো চলছেই। অবিরাম। সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে। শ্রদ্ধায়। কারও চোখে জল, তো কারও মুখে, ‘হোয়াট আ ম্যান!’, বিস্ময়।
হারা দলের অধিনায়কের কি এই সম্মান প্রাপ্য? সে কি অদৃশ্য কালির খোঁচায় মুছে দিতে পারে বিশ্ব জয়ের গর্ব? ইংরেজি কোমলগান্ধার? বদলে দিতে পারে, ট্রফির সোনালী রং? হারা অধিনায়কের নাম যদি কেন স্টুয়ার্ট উইলিয়ামসন হয়, আর দিনটা যদি ২০১৯-এর ১৪ জুলাই হয়, তবে সবই সম্ভব। এ যে ক্রিকেট ইতিহাস ভাঙা গড়ার দিন। টেস্ট ক্রিকেটের কাব্যিক রোমান্স ছেড়ে একদিনের ম্যাচের অনিশ্চয়তায় গা ভাসানোর দিন। ‘হার ক্যার জিতনেওয়ালে কো…’ বাজিগর হওয়ার দিন।
এ দিনই তো ফের কোনও এক আলেকজান্ডার লড়াই জিতেও, শেষে ‘হার’ মানবেন এক পুরু-র কাছে। বিশ্বজয়ের আনন্দের মাঝেই ছেড়ে যাবেন মঞ্চ। যে মঞ্চে পুরুকে আপন করে নিতে, পেশার যাবতীয় কাঠিন্য ছেড়ে, খাতা কলমের তাত্ত্বিক হিসাব ভুলে, স্রেফ আবেগে গা ভাসাবেন অগুনতি সাংবাদিক। টুপি খুলে জানাবেন সেলাম। করতালি দিয়ে চাইবেন পুরুকে বরণ করে নিতে।
সাংবাদিক সম্মেলনে হাততালি, স্ট্যান্ডিং ওভেশন ক্রিকেট ইতিহাসে ততোটাই নজির বিহীন, যতটা দলের দশ বা এগারো নম্বর ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি। ২০০৪-এ স্টিভ ওয়াগের বিদায়ী সিরিজের শেষ দিন আর ২০১১-র ওয়াংখেড়ের ফাইনাল ছাড়া আতস কাঁচে চোখ রাখতে হবে। প্রথমবার মূলত অজি সাংবাদিকরা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাঁদের জাতীয় বীরের শেষ বিজয় গাথায়। ধোনির বেলা সেটাই ছিল ভারতীয় প্রেসের ২৮ বছরের অপেক্ষা অবসানের আনন্দ। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই এভাবে একত্রে গোটা ঘর উঠে দাঁড়ায়নি। এই সম্মান শুধু উইলিয়ামসনের। দেশ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে! কেউ যেন তখনও ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না! লোকটা সত্যি বিশ্বকাপ ফাইনালে পরাজিত? এবং ম্যাচটা ‘না’ হেরেই। তাহলে? নিয়তির অমন করুণ পরিহাসের পরও লোকটা এত ঠান্ডা কী করে! কী ভাবেই বা বিতর্কিত সমস্ত প্রশ্ন বাণ আটকাচ্ছেন হাসি মুখে!
উত্তর খুঁজতে, ক্যালিডোস্কোপে চোখ রেখে যেতে হবে টাওরাঙ্গায়। প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ের ছোট্ট শহরটায়। ছেলেবেলা যেই ব্যাট হাতে নিলেন, সেঁটে দেওয়া হল তকমা ‘বিস্ময় প্রতিভা’। ভেসে না গিয়ে স্কুল ক্রিকেটে হাজার হাজার রান করেছিলেন উইলিয়ামসন। অনূর্ধ্ব- ১৯ হয়ে তারপর টেস্ট দলে। অভিষেকে শক্ত গিঁট, ভারত। হরভজন সিংয়ের দুসরা! রাফে ফেলা প্রজ্ঞান ওঝার লেফট আর্ম অর্থডক্স। শুরুতেই কঠিন প্রশ্ন। লড়াই চলল ২৯৯ বল। ১৩১ রানের ইনিংসটা যখন থামলো, নিউজিল্যান্ড নিরাপদে। সেদিন লোকে শুধু প্রতিভাই দেখেছিল, ২০ বছরের ছেলেটার ঠাণ্ডা মাথাটা তখন চোখে পড়েনি।
সে হদিশ প্রথম পান মার্টিন ক্রো। উইলিয়ামসন পূর্ববর্তী নিউজিল্যান্ড ব্যাটের সেরা বিজ্ঞাপন। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে বলেছিলেন, ‘একটু ধৈর্য রাখুন। আমাদের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান সবে শুরু করেছে।’ সারা জাগানো অভিষেকের পর, মাঝে দু-তিন বছর চুপ ছিল উইলিয়ামসনের ব্যাট। অফ স্টাম্পের বাইরের দুর্বলতা যাচ্ছিল না। ভেতরে আসা বল মাঝে মাঝেই খুঁজে নিচ্ছিলো পা বা স্ট্যাম্প। ২০১২-য় ভাঙা পিচে, টেস্টের পঞ্চম দিন, স্টেন, মর্কেলদের গোলাগুলির বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ডকে বাঁচাতে মহাকাব্যিক লড়াই(১০২*) করেছিলেন বটে, কিন্তু তা মধ্যবিত্তের মাসে একদিন মটন খাওয়া সম। ধারাবাহিকতা তখনও পরশমণি!
খুঁজে পেলেন ১৪ সালে। ক্রো জানতেন। দেখেছিলেন, ব্যাটে ধারাবাহিক হতে অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন উইলিয়ামসন। ঠাণ্ডা মাথায়। সমুদ্রস্রোতের মতো ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল। তাই তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে ১১২ বলে ৮৮ করার পরও নেটে যাওয়া। ‘উইকেটে যথেষ্ট সময় কাটানো হয়নি!’
এই লড়াইটা সামনে থেকে দেখেছিলেন বাল্যবন্ধু ব্রেসওয়েলও। বলেছেন, ‘লোকে উইলিয়ামসনের প্রতিভা দেখে, পরিশ্রমের কথা ভুলে যায়। ছোট থেকেই ওর ওয়ার্ক এথিক্স দেখে অবাক হতাম। আমরা খেলতাম ভালো লাগে বলে বা সময় কাটানোর জন্য। ও যেন ব্যাট করতো জীবনে সফল হওয়ার জন্য। প্রতিটা নেট সেশনে ওর লক্ষ্য থাকে, নিজেকে আরও উন্নত করা।’
মাঝের লড়াইটায় নিজের টেকনিকে ছোটোখাটো কিছু পরিবর্তন করেছিলেন উইলিয়ামসন। কমিয়ে দিলেন উইকেটে এসেই অফ স্টাম্পের বাইরে, শরীর থেকে দূরে ড্রাইভ। কমলো শুরুতেই থার্ড ম্যানে বল ঠেলা। আর যতটা সম্ভব লেট খেলা যায়। বল যেন ব্যাটে লাগে ঠিক চোখের তলায়। ব্যাট গ্রিপ করার সময় হাত দুটোর মাঝে ব্যবধানও বাড়লো হাল্কা। ভেতরে আসা বলগুলো যাতে বটম হ্যান্ডের সাহায্যে মিড উইকেট বাউন্ডারিতে ফেলা যায়।
আমরা সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী। বয়েই গেছে আমাদের এত কাঁটা ছেড়া করতে। কাব্যিক রোমান্স সরিয়ে পরিশ্রম, যুক্তি, তত্ত্ব, বিজ্ঞানের ঘোলা জলে ডুব দিতে! তাই নয় উইকেট যাওয়ার পর, প্যাট কাম্মিনসকে মাথার উপর দিয়ে মারা ছক্কায় নিউজিল্যান্ডের জয়। দেখেই খুশি হই আমরা। শিহরিত হই জনসন, হ্যাজেলউডদের বিরুদ্ধে পার্থের দাপুটে ১৬৬ দেখে। কুর্নিশ করি হেরাথকে ভোঁতা করে দিয়ে করা ২৪২ রানকে।
আসলে লোকটাই যে এরকম! তার লড়াই আলাদা করে চোখ টানে না। মাঠে বিরাট কোহলি সুলভ ঔদ্ধত্য নেই। নেই স্টিভ স্মিথের ইস্পাত স্বরূপ কাঠিন্য। না আছে চাল চলন, কথা বার্তা, কোনও কিছুতেই দেখন-দারির ছোঁয়া। ছোটবেলা বাবা-মায়ের দেওয়া মূল্যবোধ, কিট ব্যাগে পুরে বয়ে নিয়ে চলেছেন সর্বত্র। যেন, ‘তারকা নয়, তোমাদেরই লোক, এই বলে খ্যাত হোক মোর পরিচয়।’
এ জন্যই তো, এক কোথায় দান করে দেওয়া যায় একটা গোটা সিরিজের পারিশ্রমিক। যা করেছিলেন ২০১৪-য়। পেশোয়ারের স্কুলে জঙ্গি হানার পর। কাউকে কিছু না বলেই। শ্রীলঙ্কায় প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলতে খেলতেই ধরা দেওয়া যায় ভক্তের ভালোবাসায়। অচেনা দেশের, এক অজানা ক্রিকেটপ্রেমীর হাত থেকে খাওয়া যায় জন্মদিনের কেক! একাত্ম হয়ে ভক্তের আনা কেক মাখিয়ে দেওয়া যায় তারই গালে। বিশ্বকাপে ৫৭৮ রান করার পরও, সিরিজ সেরা হয়েছেন শুনে অবাক গলায় বলা যায় ‘কে? আমি!’
খুব জানতে ইচ্ছে করে, সে দিন টেমসের পাশের পড়ন্ত বিকেলে কী ভেবেছিলেন ক্রিকেট দেবতা? মার্টিন গাপটিল রান আউট হয়েছিলেন কেন? লর্ডসের ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলনে ওই সম্মান উইলিয়ামসন পাবেন বলে? নাকি পরে, নিভৃতে তিনিও চোখের জল ফেলেছেন, আমাদের মত। এক ট্রাজিক নায়কের জন্মে। গোপনে বালিশে মুখ লুকিয়ে কাউকে বলেছেন, ক্ষমা করো আমারই ভুল।