হতাশার কুয়াশা মোড়ানো দশ সহস্র রজনী

১.

আপনি যখন এই লিখাটি পড়ছেন তখন দিনের হিসাব ৫ অঙ্ক তো ছুঁয়েছেই তার পিছে হয়ত অনেক গুলা ঘন্টাও যোগ হয়েছ। তবু একটা দলের শিরোপা খরা কাটে নি। শিরোপা কি সবাই জেতে? কিংবা সবাই কি শিরোপার দাবীদ্বার হয়? তাও না! কিন্তু দল টার নাম যখন আর্জেন্টিনা তখন একটু অবাক হতে হয়ই বৈকি! এই দল বা ফুটবল জাতিটা যে এতোগুলো দিন, মাস, বছর কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা ছাড়া কাটাবে কেউ ভেবেছিল?

২.

১৯৯৩ এর চার জুলাই। গুয়েইকিলের সেই পড়ন্ত বিকেলে দুইবার মেক্সিকোর জালে বল জড়ালেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। টানা দ্বিতীয়বারের আর রেকর্ড ১৪ বারের মতন লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের মালা গলায় পড়লো আলবিসেলেস্তারা। সেই প্রথম কোন নন কনমেবল দল খেলেছে কোপার ফাইনালে ( মেক্সিকো)। কে জানতো অস্কার রুগেরিই সেই শতকের শেষ ভাগ্যবান আর্জেন্টাইন অধিনায়ক হতে যাচ্ছেন কাপ হাতে নেবার?

৩.

এরিক কান্তোনার ঐ উক্তিটি নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার, ‘you can change your wife, change your politics, change your religion, but never, never can you change your favourite football team।’এই উক্তিটি আরও বিশেষ ভাবে খাটে বোধ হয় আর্জেন্টিনা সাপোর্টারদের বেলায়। সেই যে ১৯৯৩ সাল, কোপা আমেরিকা। এই বাংলাদেশে ফুটবল এসেছে, ফুটবলের উন্মাদনা এসেছে তো স্বাধীনতারও আগে। কিন্তু আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রতি ভালবাসা এসেছে কবে কার হাত ধরে?

সে বিষয়ে গবেষণা ছাড়াই ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার নাম উল্লেখের নাম ছাড়া অন্য কিছু ভাবার বোধ করি বেশি প্রয়োজন নেই। ১৯৮৬ তে কাপ জেতালেন একজন প্রায় একক কৃতিত্বে। বৃটিশদের প্রতি একপ্রকারে ঘৃণা মানুষের জনমনে অনেক দিন ধরেই ছিল। সেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোয়ার্টারে এমন দুই গোল করলেন যার দুটি একটি সব থেকে আলোচিত একটি অপরটি সমালোচিতগুলোর একটি। ফকল্যান্ড দ্বীপ দখলের প্রতিশোধ কিংবা ঈশ্বরের হাত গোল করেছে বলে দুনিয়া জোড়া হৈ চৈ ফেলে দেয়া সেই মানুষটাই এই দেশে তথা সারা দুনিয়াতে আর্জেন্টিনা ভক্ত তৈরির মূল হোতা – এ কথা বললে অত্যূক্তি হবে না।

৪.

১৯৮৬ তে বাংলার শহরে ফুটবল বিশ্বকাপ এসেছে, গ্রামে ছড়িয়েছে ১৯৯০ তে। ততদিনে অনেক বাড়িতে রঙিন টিভি, সেখানে ফুটবল। সব রথী মহারথীর খেলা। পত্রিকা, রেডিওর কল্যাণে ক্যানিজিয়া, ম্যারাডোনা রা ভীষণ রকমের জীবন্ত। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের দ্বৈরথে সেই যে মিডফিল্ড থেকে কয়েকজন কে কাটিয়ে ডিফেন্স চেরা ট্রেডমার্ক থ্রু পাস, বাম প্রান্ত থেকে ছুটে আসা সোনালী চুলের ক্যানিজিয়ার গোলরক্ষক তাফারেল কে কাটিয়ে গোল- সেই স্মৃতি যেন আরও বড় হয়ে জায়গা করে নিলো মানুষের মনে।

পাড়ায় মহল্লায় তখন নায়ক নায়িকাদের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের পোস্টার জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। ছেলে ছোকরারা টাকা জমিয়ে সেই পোস্টার আর পেপারের ছবি ঘরে টাঙিয়ে রাখে। সোনালী সেই কাপ হাতে চুমু খাচ্ছেন কোকড়া চুলের বেটে মতন এক লোক,সেই তিনি তখন এদেশের অনেকের ঘরের মানুষের মতনই আপন হয়ে গেছেন? কীভাবে?

কেবল চর্মগোলকে পা চালিয়ে জাদু দেখিয়েই। ‘ওরা আমাকে এতো মারে কেন…’ – এই ভিউ কার্ড, পোস্টার ও অনেকের মনে গিয়ে বিঁধেছ।। প্রতিপক্ষ দল গুলো যখন আর পেরে উঠত না এই লোকটির সাথে কুতসিত সব আক্রমণ চালাতো তাঁর উপরে। ৯০ এর জার্মানিতে রেফারির একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্তে হেরে গেলেন।

দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছেন, কখনও জার্সিতে কামড়ে ধরে কান্না আটকাতে চাচ্ছেন, এই দেখে এই দেশের কত লক্ষ লোক চোখের জল বিসর্জন দিয়েছেন ইয়ত্তা নেই। ফুটবলের সাথে যে কী আবেগ লুকানো আর কে দেখিয়েছে এতো আপন হয়ে? ম্যারাডোনা হয়ে গেলেন তাই ৯০ প্রজন্মের সর্বাধিনায়ক। আর তাঁর দেশ আর্জেন্টিনা পেলো বিপুল এক জনসমর্থন। কেবল বাংলাতেই নয়। পুরো বিশ্বজুড়ে।

ফুটবল তাঁর আগেই দেখেছে পেলে, জিকো, গারিঞ্চা, বেকেনবাওয়ার, প্লাতিনি, মালদিনি দের । কিন্তু হয়ত সম্প্রচার মিডিয়ার কল্যাণে ম্যারাডোনাই সবথেকে দ্রুত জনমানুষের আবেগের সাথে মিশে যেতে পেরেছিলেন। নাহলে জার্মানির সাথে হারের পরদিন এই দেশের জায়গায় জায়গায় কেন মিছিল হবে, রেফারির কুশপুত্তলিকা দাহ হবে, কেনই বা লোকে আত্মহত্যা করবে?

তাঁর দল আর্জেন্টিনার সেই যে বিশাল জনসমর্থন। অথচ, কাপের হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের তুলনায়, ইতালির তুলনায় কম তখন। ১৯৯৪ তে লোকের সামনে হাজির হলেন আরেক জাদুকর, আরেক বুনো উল্লাসের নায়ক গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, ঝাকরা চুল, অসম্ভব ক্ষিপ্র গতি, পায়ে দুর্বার শট । ৯১,৯৩ এর কোপা জেতা দলে তখনও আছেন বুড়ো হয়ে যাওয়া গডফাদার ম্যারাডোনা, আছেন সেই ক্যারিশম্যাটিক ক্যানিজিয়ারা।

হট ফেভারিট দল টাও শুরু করল ফেভারিটের মতন করেই। শুরুর ম্যাচেই বাতিস্তুতার হ্যাট্রিক, আরেক গোল ম্যারাডোনার। কিন্তু কোকেন সেবনের দায়ে নিষিদ্ধ হলেন দ্বিতীয় রাউন্ডেই। আর্জেন্টিনা দলের মনোবল ও যেন রাতারাতি তলানিতে নেমে এলো। জর্জ হ্যাজির রুমানিয়া তাদের বাদ করে দিল। সেই বিশ্বকাপের জয়ের মালা পড়লো ব্রাজিল। টান টান উত্তেজনার সেই ব্রাজিল-ইতালি ফাইনাল গত শতকের অন্যতম সেরা একটি লড়াই ছিল বটে। শেষ হাসিটা ব্যাজিওর মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে নতুন হিরো রোমারিও।

৫.

এরপর? ১৯৯৫, ৯৭ এর কোপা গেল । সেমির দরজায় পা পড়ল না আর্জেন্টিনার। ১৯৯৮ তে গ্রুপ পর্বে দারুণ খেলা দল টা দ্বিতীয় রাউন্ডে সেই চেনা শত্রু ইংল্যান্ডের বিরূদ্ধে উপহার দিল রুদ্ধ্বশ্বাসী এক ম্যাচ। কোয়ার্টারে পার হতে পারল না কমলা বাঁধা। ৯৯ এও হলো না, বিয়েলসার ভয়ংকর দল নিয়েও কলম্বিয়া থেকে পাওয়া সন্ত্রাসীদের থ্রেটে ২০০১ এ অংশই নেয়া হল না। বারবার ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকা দল টাকে এল প্রফেসর গুছিয়ে নিয়েছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপের আগে।

সেবার লাতিন অঞ্চল থেকে সবাইকে টপকে সেরা হয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন, দলে এক ঝাঁক তারকা। স্ট্রাইকিং পজিশনে ইন ফর্ম ক্রেস্পো কে জায়গা দিতে পারছেন না ফিওরেন্টিনার হয়ে মাঠ মাতাতে থাকা পুরনো যোদ্ধা বাতিস্তুতার জন্য। ওদিকে আইমারের মতন ট্যালেন্ট একাদশে ঢুকতে পারছেন না ওরতেগার জন্য। এমন সব মধুর সমস্যা যে দলে সে দল ফাইনাল খেলবে না সেই বাজি ধরা লোকের সংখ্যাই তো কম ছিল।

কিন্তু, সেবারের বিশ্বকাপ ছিল অঘটনের জন্যেই কেবল।নাহলে আগের বিশ্বকাপ জয়ী শক্তিধর ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনা র ফাইনাল হবে ধরে বসে থাকা লোকেদের চোখে সরষে ফুল দেখিয়ে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় হয়ে যাবে কেন এরা? বাছাইপর্বে ধুকতে থাকা ব্রাজিল অপরাজেয় হয়ে কাপ জিতে নিবে সেইই বা কতজনে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ভাবতে পেরেছে?

৬.

আর্জেন্টিনার অপেক্ষার প্রহর বাড়তেই লাগলো। ২০০৪ এও কোপা জয় করলো ব্রাজিল। ফাইনালে দুই বার এগিয়ে থেকেও ৯০ মিনিটে আদ্রিয়ানোর গোলে খেলা গেল টাইব্রেকে। সেখানে মিসের মহড়া অভিজ্ঞ হাইঞ্জে আর ডেল আলেসান্দ্রোর ।

একদিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের একের পর এক সাফল্য অন্যদিকে নিজেদের ছন্নছাড়া দশা। আর্জেন্টিনা সমর্থকদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা চলতেই লাগল। ২০০৬ এর বিশ্বকাপের কোয়ার্টারের কথাই ধরুন। টুর্নামেন্টের বাকি ৪ ম্যাচ ফেভারিটের মতন খেললো দল টা। কি ডিফেন্স, কি মিডফিল্ড কি এটাক!! নতুন পুরাতন মিলিয়ে পরিপূর্ণ একটা দল। মাঝমাঠের কাণ্ডারী রিকুয়েলমে, সাথে এসেছেন লা জেফিতা মাসচেরানো, ক্রিয়েটিভ রোলে ম্যাক্সি, মাঝমাঠ কন্ট্রোলের জন্য ক্যাম্বিয়াসো। আর সামনে?

ক্রেসপো তখনও ফর্মের তুঙ্গে, সিরি এর অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ক্রুজ দলের ৫ নম্বর চয়েস। ২য় চয়েসে স্যাভিওলা। আর ৩ আর ৪ নম্বরের নামগুলো তো ভুলার কথা নয়, ২০০৪ এ প্রায় একক কৃতিত্বে অলিম্পিকের সোনা জেতানো তেভেজ, আছেন নতুন সেনসেশন লিওনেল মেসি। এই দল কেন বিশ্বকাপের ফাইনাল অন্তত খেলবে না? কিন্তু খেলা বলে কথা। আবোনদাঞ্জিয়ারি আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়লেন ১ গোলের লিড থাকা অবস্থায়।

এতোদিন দল টাকে হাতের কড়ির মতন চিনে ফেলা আর তিলে তিলে গড়া দল টা কে নিয়ে দাবার চালে ভুল করবেন কে জানতো? রিকুয়েলমে কে তুলে নিলেন, মাঝমাঠের দখল রেখে খেলাটা কে লিডেই শেষ রাখতে নামালেন ক্যাম্বিয়াসোকে। ক্রেসপোকে তুলে মেসিকে চাচ্ছিলেন সমর্থকেরা। এরিয়ালে জার্মানির সাথে পেরে ওঠার জন্য নামালেন সেই হুলিও ক্রুজ কে । খেলা শেষের ১০ মিনিট আগেই গোল করলেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। খেলা গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে।

পেকারম্যানের দলের নতুন কোন সাব নেই, দলে আক্রমণ তৈরির অস্ত্রগুলো সব উঠিয়ে রেখেছেন। যা হবার হল তাইই, খেলা গড়ালো টাইব্রেকে, সেখানে শক্ত নার্ভের জার্মানদের সামনে নতুন নামা গোলকিপার ফ্রাংকো কিছুই করতে পারলেন না। ওদিকে দলের দুই অভিজ্ঞ শুটার ক্যাম্বিয়াসো, ঐদিনের গোল স্কোরার আয়ালা মিস করে বসলেন। ব্যাস আরেকবার কোয়ার্টারে এসে থেমে গেলো চাকা।

২০০৭ এর কোপা তে আর্জেন্টিনা শুরু করল দাপুটে দলের মতই। মেসি তখন ভয়ংকর হতে শুরু করেছেন।হেসেখেলেই ফাইনালে চলে গেল।কাপ এবার নিবেই যেন, সেরকম আবহ পুরো টুর্নামেন্টে। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল। সেই ব্রাজিল দলে নেই অনেক অভিজ্ঞ প্লেয়ার। অনেক তরুণ দিয়ে ভরা সেই দল টার সামনে একের পর এক কাউণ্টার এটাকে নাস্তানাবুদ মেসি-রিকুয়েল্মের আর্জেন্টিনা। পুরো নিস্তব্ধ বুয়েন্স আইরেস সহ সবগুলো আলবিসেলেস্তে ঘাঁটি।

৭.

২০১০ বিশ্বকাপের জন্য গ্রন্দোনা দলের দায়িত্ব তুলে দিলেন ম্যারাডোনার হাতে। পাগ্লাটে ম্যারাডোনা বাছাইপর্বেই লেজে গোবরে পাকানো শুরু করলেন যেন। ঘরের মাঠ, পরের মাঠ সবখানে পয়েন্ট হারানো শুরু করলেন। এক ম্যাচ খারাপ গেলেই দল পাল্টে ফেলেন। ২ বছরেরও কম সময়ে ৫০ এরও বেশি প্লেয়ার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন।

এর মাঝে আরেক বোকা লিজেন্ড রিকুয়েলমে র সমালোচনা করায় সেও গেছে বেঁকে। অতি ইমোশনাল জাতির এই মিডফিল্ড মার্শাল রাগ করেই ঘোষণা করলেন আর জাতীয় দলের হয়ে খেলার ইচ্ছা নেই তাঁর। বাছাইপর্বের একেবারে শেষ ম্যাচের আগের ম্যাচ। পেরুর বিপক্ষে জেতা ছাড়া টিকে থাকার সম্ভাবনা কম।

ঠগ বাছতে আর্জেন্টিনা উজার করে ফেলা ম্যারাডোনা ৩৫ বছর বয়সের মার্টিন পালেরমো কে দলে এনেছেন এই বলে যে এ গোল করতে পারলে পরের বছর ওয়ার্ল্ড কাপে নিবেন। বৃষ্টি ভেজা, মাঠে পানি জমে যায় যায় এই অবস্থায় হওয়া সে ম্যাচে জটলা থেকে একদম অন্তিম মুহূর্তে গোল করেন পালেরমো। ম্যারাডোনার সে কী খুশি।

কিন্তু, খেলোয়াড় ম্যারাডোনা যতটা বিচক্ষন ছিলেন কোচ ম্যারাডোনা যেন ততটাই নির্বুদ্ধ। দল গড়লেন ইচ্ছামতন। সে বছরের ট্রেবলজয়ী ইন্টারের ক্যাম্বিয়াসো, জানেত্তি কে চূড়ান্ত স্কোয়াডে রাখলেন না, অথচ সিরি এ র রাইট ব্যাক জানেত্তি। ম্যারাডোনা দল গড়লেন স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে আর্জেন্টিনা দল কে কাপ জিততে দেখেছেন, সেই কাপ হাতে দেখেছিলেন এরিয়াল গার্সে কে । যিনি নিজেও দলে নিজের নাম দেখে অবাক।

তবু দল টা শুরু করলো ভালই। আক্রমণ ভাগে এক সাথে তরুণ আগুয়েরো, হিগুয়েইন, ডি মারিয়া, তেভেজ লিও মেসি, আরও আছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে দুই গোল করা মিলিতো, আর আর্জেন্টিনার বাছাইপর্বের ত্রাতা পালেরমো। ম্যারাডোনার নির্বুদ্ধিতা প্রকাশিত হলো আবারও কোয়ার্টারে। জার্মান বুল ডোজার সেই ডান প্রান্ত বেয়েই একের পর এক আক্রমণ শানাতে লাগলো আর গুণে গুণে ৪ টা গোল করে বুঝিয়ে দিল, কাপ্তানের একক নৈপুণ্যের দিন তো অনেক আগেই শেষ, জাহাজে একটা ছিদ্র থাকলে সেটা দিয়েই ডূবানো সম্ভব যত বিশাল ই হোক না কেন। আবারও আশাভঙ্গ আলবিসেলেস্তেরা।

৮.

২০১১ তে ঘরের মাঠে কোপা। এবারে কোয়ার্টারে উরুগুয়ের মুসলেরা দাঁড়ালেন পর্বত হয়ে। মেসি-তেভেজ-আগুয়েরো-হিগুয়েইন রা পেরে উঠলেন না। সেবারের চ্যাম্পিয়ন দল টা এই উরুগুয়েই, আর্জেন্টিনার রেকর্ড শিরোপা ১৪ কে টপকে গেলো আর্জেন্টিনার মাটিতেই।

দল টা কে গোছানোর দায়িত্ব নিলেন লিবার্তাদোরেস জয়ী সাবেলার। বেশ ভালোভাবে উতরালেন বাছাইপর্ব, ফ্রেন্ডলি ম্যাচ গুলোতেও জার্মানি, ইতালি, পর্তুগালকে হারানো দল টা নিজেদের ভাল করে চিনে নিয়েছে। ২০১৪ র আয়োজন চিরপ্রতিদ্বন্দীর মাটিতে। কাপ শুরুর কিছু মাস আগেই ইঞ্জুরিতে ছিলেন দলের দুই প্রধান সেন্টার ফরোয়ার্ড আগুয়েরো-হিগুয়েইন। তাদের ফুল ফর্মে পাওয়া যাবে কিনা সেই চিন্তা থেকে প্রথম পর্বে মুক্তি পেল দল লিও মেসির একক কৃতিত্বে।

সেই যে ইরানের বিপক্ষে অন্তিম মুহূর্তে বক্সের বাইরে থেকে বাকানো শটে ম্যাচ নিজেদের করা কিংবা নাইজেরিয়ার গোলরক্ষক কে ফ্রি কিকে বোকা বানানো সেই টুর্নামেন্টে আল্বিসেলেস্তেদের অনেক বড় প্রাপ্তি। দলের অন্য ফরোয়ার্ড রা তখনো না জ্বলে ওঠায় ট্র্যাডিশনাল ট্যাংগো থেকে খানিকটা সরে গিয়ে ফলাফল নির্ভর ফুটবলে অভ্যস্ত করালেন দল কে। সেকেন্ড রাউণ্ডে সেবারের ডার্ক হর্স সুইস দের হারাতে লেগেছিল প্রায় ১২০ মিনিট।

ঘূণে ধরা আর্জেন্টিনার ডিফেন্স তখন জাবালেতা,গ্যারে-ডেমিকেলিস, রোহো দের সমন্বয়ে দারুণ এক ইউনিট। মাঝমাঠে আছেন যোদ্ধা মাসচেরানো, সামনে মেসি-মারিয়া রা তো রয়েছেন ই। কোয়ার্টারে হিগুয়েইন গোল পেয়ে গেলেন আগেই। কিন্তু তার কিছুক্ষণ বাদে টুর্নামেন্টে মেসির পরে দলের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় মারিয়া মাঠ ছাড়লেন হ্যামস্ট্রিং এ টান নিয়ে। সেমিতে দেখা অপ্রতিরোধ্য প্রায় ডাচ দের।

দাঁতে দাঁত চেপে ১২০ মিনিট পার করা আর্জেন্টিনা কে দেখে অনেকের মনেই হয় নি এটা সেই চিরাচরিত ভাঙা ডিফেন্সের দল টা। এবারে ত্রাতার ভূমিকায় সার্জিও রোমেরো। ক্লাবের বেঞ্চিতে কাটিয়ে কাটিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের সবথেকে দামি সেইভ দুটো করেছিলেন সেই সেমির টাইব্রেকে দুটি শট ঠেকিয়ে। ২৪ বছর পর দল ফাইনালে। পুরো দলের চোখে আনন্দ অশ্রু।

ফাইনালে আবারও সেই জার্মানি। এবার কী হবে প্রতিশোধ!?

হামেলস এর ভুল ব্যাক পাস থেকে একা ন্যুইয়ার কে পেয়েও বল বাইরে মারলেন হিগুয়েইন, কে জানতো এতোদিনে দলের দ্বিতীয় সেরা নির্ভরযোগ্য স্কোরারের সেটাই ক্যারিয়ারের অভিশপ্ত অধ্যায়ের শুরু? কিছুক্ষণ বাদেই লাভেজ্জির ক্রস থেকে বল জড়ালেন জালে, কিন্তু নাহ, এবারে অফসাইড।

কাগজে কলমে শ্রেয়তর দল হয়ে, বলের দখলে জার্মান রা এগিয়ে থাকলেও বিগ চান্স ক্রিয়েট করলো আর্জেন্টিনাই । কিন্তু ভাগ্যে শিরোপা না থাকলে যা হয়, নাহলে বিগলিয়ার বাড়ানো থ্রু থেকে বক্সে ঢুকে মেসি যে প্লেসিং শট টা নিলেন তা কোন চুম্বক বিকর্ষণে পোস্টের ৩-৫ ইঞ্চি বাইরে দিয়ে বেঁকে যাবে কেউ বলতে পারেন? তাহলে কি কেবল ই আর্জেন্টিনার শিরোপা খরা ঘুচত? নাকি সর্বকালের সেরা ফুটবলের বিতর্কের অবসান ও হতো?

কিংবা প্যালাসিওস এর কাছে আসা লব টায় বলে টোকা টা আরেকটু কেন আস্তে হলো না?হিগুয়েইন কে পেনাল্টি বক্সের ধারঘেষে মারাত্মক ভাবে ফাউল করা ন্যুইয়ার হয়ত ভার এর যুগে লাল কার্ড ই পেতেন। কিন্তু ঐযে ভাগ্য সহায় না হলে অনেক কিছুই হয় না। ১১৩ মিনিটে গিয়ে মারিও গোতজে কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন। বেলা হোরিজেন্তে ক্লান্ত আর্জেন্টাইন ডিফেন্স হার মানলো একদম শেষ বেলায়। সোনালী কাপ টা ছুয়ে দেখা হলো না তর্কাতীত ভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার লিও মেসির, এতো কাছে তাও কত দূরে!!

৯.

২০১৫, ২০১৬ দুটো কোপা আমেরিকা, শক্তির বিচারে আর্জেন্টিনা অঞ্চল সেরা তখনও। দুবার ই ফাইনালে একই প্রতিপক্ষ চিলি। খেলাতে ক্রুশাল সময়ে হিগুয়েইনের গোল মিস, অন্যদের পারফরম্যান্সের গ্রাফ গেলো পড়ে। টাইব্রেকে দুবার ই ট্রফি হাতছাড়া একই দলের কাছে যারা কিনা ঠিক তার পরের বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই ই করতে পারল না। এসব ই কি দুর্ভাগ্য নাকি নিজদের নার্ভ ধরে না রাখতে পারার খেসারত?

২০১৬ র কথাই ধরুন, প্রথম ম্যাচে মেসি ছাড়াই মারিয়া-বানেগা রা চিলি কে হারালো। সেমি পর্যন্ত দুর্দান্ত এক দল। ৪-০ গোলে এগিয়ে যখন ফাইনালে যাবার বাশির অপেক্ষায় তার কিছু আগে ঐ টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার হয়ে দুর্দান্ত খেলতে থাকা লাভেজ্জি এডভার্টাইজিং ফেন্সের উপরে কন্ট্রোল হারিয়ে পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হলেন। পেশিতে চোট নিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন মাঝ মাঠে মাসচেরানোকে দারুণ সাপোর্ট দেয়া অগাস্তো ফার্নান্দেজ।

ফাইনালে ব্রাজিলিয়ান পাগলাটে রেফারি কেন রোহো কে লাল কার্ড দেখালেন নিজেও জানেন না বোধ হয়। তার উপরে হিগুয়েইন গোলকিপার ব্রাভো কে কাটিয়েও ফাঁকা জালে বল ঢুকাতে পারল না। টানা ৩ ফাইনালে গোল করার সহজ ৩ টা সুযোগ হাতছাড়া করার মত দুর্ভাগ্য আর কোন খেলোয়াড়ের হয়েছে কিনা জানা নেই। টাইব্রেকে মেসি মিস করলেন, বিগ্লিয়া মিস করলেন। আবার আরেকবার একই ফলাফল। টানা ৩ বার দ্বিতীয় হয়ে শেষ করতে হলো আকাশী সাদাদের। মেসি র মনে মেঘ জমেছিল অনেক। ফেডারেশনের যাচ্ছেতাই অব্যবস্থাপনা, কোচিং প্যানেল কে বেতন না দিতে পারা তার সাথে উপুর্যপরী ব্যর্থতার দায় নিয়ে অবসরেরই ঘোষণা দিয়ে বসলেন।

কিন্তু ভক্তদের অনুরোধ আর দেশের টানে আবার ফিরে আসলেন, বাছাই পর্বে ধুকতে থাকা দলের জন্য শেষ ম্যাচ হয়ে দাঁড়াল ডু অর ডাই । ম্যাচ টা আবার ইকুয়েডরের কিটো তে। যেখানে খেলাটাই বেশ ধকলের। ৫ মিনিটেই গোল খেয়ে গেল আর্জেন্টিনা। ঘুরে দাঁড়ালেন লিও মেসি। হ্যাট্রিক করে জেতালেন দল কে , নিয়ে গেলেন রাশিয়া বিশ্বকাপে।

সেখানেও ভাগ্য বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। ক্যাম্পের শুরুতেই ইঞ্জুরিতে পড়লেন এক দশকের গোল বারের নির্ভরতার প্রতীক সার্জিও রোমেরো। তার বদলে নেয়া হলো রিভার প্লেটের ফ্রাংকো আরমানি কে ।

যাকে মিডফিল্ড এর মধ্যমনি বানানো হচ্ছিল সেই লানজিনি আহত হলেন এর কিছুদিন বাদে। এর মাস কয়েক আগে ইঞ্জুরিতে ছিলেন স্বয়ং মেসি, আগুয়েরো, মারিয়া । দলে নেই তরুণ পরীক্ষিত কোন ডেস্ট্রয়ার বা রেজিস্তা। মাসচেরানোর সলতে তখনও নিভু নিভু। দল টা কে একসাথে খেলিয়ে যে ঝালিয়ে নেবেন, কাপ শুরুর আগের দ্বিতীয় প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলা সম্ভব হলো না ( জেরুজালেমে আয়োজন করা হয়েছিল)। এর উপর কী মনে করে করতে লাগলেন এক্সপেরিমেন্ট। প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ড জয় বঞ্চিত করলো।

পরের ম্যাচে ক্রোয়েটদের শক্তিশালী মিডফিল্ডারদের সামনে ৩-৪-৩ ফর্মেশন সাজিয়ে বড় ধরাই খেয়ে গেলেন। মদ্রিচ-রাকিতিচ রা মিলে বয়সের ভার আর অপরিপক্ক মিডফিল্ড চতুষ্টয় কে নাচাচ্ছিল ভালই । এর মাঝে ক্যাবেয়ারো করে বসলেন অমার্জনীয় শিশুতোষ ভুল। ৩-০ গোলে হারা ম্যাচে শঙ্কা জাগছিল প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ যাওয়ার আয়োজন হচ্ছিল, শেষ ম্যাচে ক্রোয়েট রা আইস্ল্যান্ড কে আর মেসি-রোহো র গোলে নাইজেরিয়া বাঁধা পেরিয়ে এই লজ্জা থেকে অন্তত রক্ষা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না ফ্রান্সের সামনে গিয়ে। আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে এমবাপ্পে-কান্তেদের পেসের সামনে পেরে উঠল না মেসি বাহিনী। কোয়ার্টারেই যাওয়া হলো না । ব্যর্থতার আরেকটা অধ্যায় এখানে শেষ হল্ মেসি-আগুয়েরো দের।

দল টার দায়িত্ব নিলেন সাম্পার সহকারী স্ক্যালোনি। প্রথম বড় এসাইনমেন্ট ব্রাজিল কোপা। শুরুর ম্যাচে কলম্বিয়ার সাথে হার দিয়ে শুরু। পরের ম্যাচে ১-১ এ প্যারাগুয়ের সাথে রক্ষা। শেষ ম্যাচে কাতার কে হারিয়ে কোয়ার্টারে। ভেনিজুয়েলার সাথে ছন্দ ফিরে পেয়ে সেমিতে দেখা মিললো স্বাগতিক ব্রাজিলের। আবারও হতাশা, এবারের নাম অনেক পুরনো শত্রু রেফারি। দুই দুটি পেনাল্টির দাবি থেকে বঞ্চিত করা হলো। দ্বিতীয় টি নিয়ে খেলোয়াড়েরা আবেদন জানানো অবস্থাতেই কাউণ্টারে ব্রাজিল তাদের ২য় গোলের আনুষ্ঠানিকতা সারলো। ব্যর্থতার আরেক মিশন শেষ হলো।

১০.

সেই যে ১৯৯৩ র সাফল্যের সন্ধ্যা। এরপর কতগুলো বিষন্ন বিকাল, সন্ধ্যা, রাত্রি পার হলো, সুন্দর ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি এই দেশ টার আর ট্রফি ধরা হয়ে উঠলো না। তবু কিছু সময়ের জন্য আনন্দ দিতে পেরেছে তারা অলিম্পিক ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে (২০০৪ ও ২০০৮-এ)। কিন্তু অলিম্পিকের দল হয় মূলত অনূর্ধ্ব ২৩ এর খেলোয়াড় দের নিয়ে। ৩ জন ওভার এইজড খেলোয়াড় থাকতে পারে। একটা সময়ে অনূর্ধ্ব ১৭ বা অনূর্ধ ২০ বিশ্বকাপেও শাসন করেছে আর্জেন্টাইন রা।

কতজন যে নিউ ম্যারাডোনা তকমা পেলো। ম্যারাডোনা তকমা পেতে পেতে এখন মেসি তে এসে ঠেকলো। এখন নতুন সেনসেশনের নাম হয় নিউ মেসি। কিন্তু ম্যারাডোনা যুগের থেকে ফুটবল বদলেছে। এখন ফুটবল হয় অনেক বেশি টিম গেইম। ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স আউটক্লাস হয়ে যায় একটা ডিসিপ্লিনড আর প্ল্যানড টিম গেমের কাছে।

ইনজুরি, ভাগ্য কিংবা নিজেদের খেলোয়াড়ে নির্বাচনে খামখেয়ালী এসব নিয়ে বলতে গেলে ফুরোবে না হয়ত, কিন্তু টেকনিক্যালি দেখতে গেলে আর্জেন্টিনার সবগুলো পজিশনে একসাথে ভালো খেলোয়াড় গত দুই দশকে সব সময়ে ছিল না। কোচের গেম রিড করার ত্রুটি আর খামখেয়ালির উদাহরণ তো পেকারম্যান, ম্যারাডোনা রা দিয়েই গেছেন। এসব কিছুর বলি ট্রফিলেস এতোগুলো বছর।

আর খুব অল্পদিন, মেসি ফুটবলের বুটজোড়া তুলে রাখবেন। যাকে গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম তকমা দিতে অনেকেই নারাজ হন একটা আন্তর্জাতিক শিরোপা নেই দেখে তিনি হয়ে রইবেন হয়ত ইতিহাসের সেরা আক্ষেপ। আর আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা?এখনো ৪ বছর পরপর ছাদে নীল সাদা পতাকা উড়িয়ে যায়, এই প্রজন্মের অনেকে ম্যারাডোনা কে না মেসির জন্য পাগল পারা- এদের ধৈর্য্যের যাত্রা ফুরায় না যেন। কবে ফুরাবে? অদৃষ্টই কেবল জানে বুঝি।

কিছুদিন আগে লিভারপুলের প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা খরা কেটেছে, এই মুহূর্তের অন্যতম পরাশক্তি পরাশক্তি ইউসেবিওর পর্তুগাল প্রথম কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছে ২০১৬ তে এসে, ব্রাজিল সাড়ে নয় হাজার দিন ট্রফিলেস কাটিয়েছে, ৬৬’র পর থেকে এখন অবধি আধুনিক ফুটবলের জনক ইংলিশ রা পৌছতে পারেনি বিশ্বকাপের ফাইনালে এরকম অনেকেরই ব্যর্থতার পাল্লা বেশ ভারীই। কিন্তু আক্ষেপ থেকেই যাবে এই জন্যে যে কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা লিওনেল মেসি নামক এক জাদুকরের হাতের ছোঁয়া পেল না। ভাগ্যের দুই শাখার একটি শাখা একটু বেশিই কি নিষ্ঠুর না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link