রাজ্জাকের রাজা হওয়ার দিন

জানুয়ারি ২১, সাল ২০০০। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজের সপ্তম ম্যাচে হোবার্টে মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। টুর্নামেন্টে পাকিস্তান দুই জয় পেলেও ভার‍ত তখনো জয়ের মুখ দেখেনি। ফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে এই ম্যাচটা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেদিন তরুণ পাকিস্তানি অলরাউন্ডার আব্দুল রাজ্জাকের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে পাকিস্তানের কাছে পাত্তা পায়নি ভারত। হোবার্টে সেদিন ব্যাটে-বলে অনবদ্য পারফরম্যান্সে দলকে দুর্দান্ত এক জয় এনে দেন রাজ্জাক।

জানুয়ারি ২১, সাল ২০০০। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজের সপ্তম ম্যাচে হোবার্টে মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। টুর্নামেন্টে পাকিস্তান দুই জয় পেলেও ভার‍ত তখনো জয়ের মুখ দেখেনি। ফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে এই ম্যাচটা ছিলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেদিন তরুণ পাকিস্তানি অলরাউন্ডার আব্দুল রাজ্জাকের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে পাকিস্তানের কাছে পাত্তা পায়নি ভারত। হোবার্টে সেদিন ব্যাটে-বলে অনবদ্য পারফরম্যান্সে দলকে দুর্দান্ত এক জয় এনে দেন রাজ্জাক।

টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ভারতের অধিনায়ক শচীন টেন্ডুলকার। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে দলীয় ২২ রানে শহিদ আফ্রিদিকে হারায় পাকিস্তান। এরপর দ্বিতীয় উইকেটে ইজাজ আহমেদের সাথে ৬০ রানের জুটি গড়েন সাইদ আনোয়ার। দলীয় ৮২ রানে সৌরভ গাঙ্গুলির বলে ব্যক্তিগত ৪৩ রানে আউট হন সাইদ। ইনজামাম উল হকও গাঙ্গুলির কাছে পরাস্থ হয়ে ফেরেন দ্রুতই। দলীয় ৯৬ রানেই ৩ উইকেট নেই পাকিস্তানের।

এরপর চতুর্থ উইকেটে ইজাজ ও মোহাম্মদ ইউসুফ মিলে গড়েন ৬০ রানের জুটি। একপ্রান্তে ধৈর্যশীল ব্যাটিংয়ে ব্যক্তিগত ফিফটি তুলে নেন ইজাজ। এই জুটি যখনই বড় সংগ্রহের ইঙ্গিত দিচ্ছিল তখনি ভেঙ্কটেশ প্রসাদের এক ওভারে পর পর দুই বলে আউট ইজাজ আহমেদ ও মইন খান! ইজাজ ব্যক্তিগত ৬৭ ও মইন খান ফেরেন গোল্ডেন ডাকে। ১৫৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে তখন চরম বিপাকে পাকিস্তান।

ষষ্ঠ উইকেটে মোহাম্মদ ইউসুফের সাথে জুটি বাঁধলেন আব্দুল রাজ্জাক। ৪০ ওভার শেষে দলীয় সংগ্রহ তখন ৫ উইকেটে ১৭১ রান। এই দু’জনের ব্যাটেই তখন পাকিস্তানের শেষ ভরসা। ইউসুফ একপ্রান্তে উইকেট বাঁচিয়ে খেলতে থাকেন আরেক প্রান্তে বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন রাজ্জাক। রাজ্জাকের ব্যাটে চড়ে ৪৫ ওভার শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ তখন ৫ উইকেটে ২১২ রান। এরপর দলীয় ২২৩ রানে অনিল কুম্বলের বলে ব্যক্তিগত ৪৫ রানে ইউসুফ আউট হলে ষষ্ঠ উইকেটের পতন ঘটে। ৪৭ তম ওভার থেকে কুম্বলে মাত্র ২ রান দিয়েই ১ উইকেট শিকার করেন।

শেষ ৩ ওভার! পাকিস্তানের সংগ্রহে ৬ উইকেটে ২২৫ রান। প্রাথমিক লক্ষ্যটা তখন ২৫০ পেরোনো। রাজ্জাক তখন ৩৭ বলে ৪৬ রানে অপরাজিত, আরেক প্রান্তে ছিলেন ওয়াসিম আকরাম।

পরের ওভারেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ফিফটি পূর্ণ করেন রাজ্জাক। ওই ওভারের তৃতীয় বলে দেবাশীষ মোহান্তিকে ছক্কা হাঁকান রাজ্জাক। শেষ বলে আকরামকে আউট করলেও রাজ্জাক দাপটে পাকিস্তানের সংগ্রহ তখন ৭ উইকেটে ২৪৩। ৪৯ তম ওভারে ভারতীয় অধিনায়ক শচীন টেন্ডুলকার দিলেন মাত্র ৭ রান। তবে এক পর্যায়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে থাকা পাকিস্তান রাজ্জাকের ব্যাটে তখন ২৫০ এর কোটায়।

শেষ ওভারে গাঙ্গুলির কাছ থেকে ১২ রান আদায় করলে রাজ্জাকের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৬২ রান সংগ্রহ করে পাকিস্তান। ৫২ বলে ৪ চার ও ২ ছক্কায় ৭০ রানে অপরাজিত থাকেন রাজ্জাক। ভারতের পক্ষে মোহান্তি, গাঙ্গুলি ও প্রসাদ শিকার করেন ২ টি করে উইকেট।

২৬৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা তখন যেন পাহাড়সম রান। ওই টুর্নামেন্টে আগের ৬ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াই শুধুমাত্র দুইবার এর চেয়ে বেশি রান করতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতের সামনে যেন তাই ২৬৩ রান বিশাল লক্ষ্যমাত্রা। এর উপর স্লো ওভার রেটের কারণে ২ ওভার কাটা পড়ে ভারতের! ভারতের সামনে নতুন লক্ষ্য তখন ৪৮ ওভারে ২৬৩ রান।

বিশাল লক্ষ্যমাত্রা মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নামে সৌরভ গাঙ্গুলি ও শচীন টেন্ডুলকার। প্রথম ওভারেই মেইডেন দেন ওয়াসিম আকরাম। এরপরই শচীন-সৌরভের ব্যাটে দ্রুত এগোতে থাকে ভারত। প্রথম ১০ ওভারেই দলীয় সংগ্রহ বিনা উইকেটে ৫০ রান। দু’জনেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে থাকেন।

ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আখতার, সাকলাইন মুশতাকদের পাত্তা না দিয়ে ওপেনিং জুটিতেই ভারতীয় ওপেনাররা তোলেন ৯৯ রান! একপ্রান্তে শচীন তুলে নেন অসাধারণ ফিফটি। ম্যাচ তখন পুরোপুরি ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ১৮২ বলে ভারতের দরকার ১৬৪ রান, হাতে ১০ উইকেট।

এরপরই মাত্র ২ ওভারের ব্যবধানে আব্দুল রাজ্জাকের জোড়া আঘাতে আউট গাঙ্গুলি ও ভিভিএস লক্ষ্মণ। ব্যক্তিগত ৪৩ রানে গাঙ্গুলি ও মাত্র ৭ রানেই ফিরেন লক্ষ্মণ। তৃতীয় উইকেট জুটিতে রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে ৪৫ রানের জুটির পথে বিপর্যয় সামাল দেন শচীন। এরপর দলীয় ১৫৬ রানে ওয়াসিম আকরামের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে ব্যক্তিগত ১৫ রানেই ফেরেন দ্রাবিড়। ৩০ ওভার শেষে ভারতের সংগ্রহ তখন ৩ উইকেটে ১৫৬ রান।

একপ্রান্তে তখনো থিতু শচীন ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। তবে দলীয় ১৭৭ রানে ব্যক্তিগত ৯৩ রান রাজ্জাকের দুর্দান্ত লেগ কাটারে বোল্ড হন শচীন। সেঞ্চুরি থেকে দূরে মাত্র ৭ রানের আক্ষেপ নিয়ে ফেরেন এই লিটল মাস্টার। ১৭৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচে ফেরে পাকিস্তান। পঞ্চম উইকেটে জ্যাকব মার্টিন ও রবিন সিং’য়ের ১৬ রানের জুটির পথে শোয়েব মালিকের দুর্দান্ত এক থ্রোয়ে রান আউট হন মার্টিন। ওই ওভারেই রবিন সিংকে তুলে নিয়ে ম্যাচ নিজেদের আয়ত্তে আনেন শোয়েব আক্তার।

১৯৪ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে তখন ম্যাচ থেকে প্রায় ছিটকে গেছে ভারত। শেষ ৮ ওভারে দরকার তখন ৬৯ রান, হাতে মাত্র ৪ উইকেট। অনিল কুম্বলের সাথে সপ্তম উইকেট জুটিতে ২৫ রান যোগ করেন সামির দিঘি। অন্ধকারের মাঝেও যেন হটাৎ আলোর ঝলকানি।

২৭ বলে ভারতের তখনও দরকার ৪৪ রান। ম্যাচে টান টান এক উত্তেজনা, যদিও তখনো ম্যাচটা পাকিস্তানের হাতেই। এরপরই ৩ ওভারের ব্যবধানে ২১৯ রানে ৬ উইকেটে থেকে মাত্র ১১ রান যোগ করতেই ২৩০ রানে অলআউট ভারত! আব্দুল রাজ্জাক ও ওয়াসিম আকরামের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৩২ রানের জয় পায় পাকিস্তান।

ব্যাট হাতে ৫২ বলে অপরাজিত ৭০ ও বল হাতে ৪৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন আব্দুল রাজ্জাক। ২০ বছর বয়সী তরুন রাজ্জাকের দাপুটে পারফরম্যান্সে হোবার্টে সেদিন পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ভারত। অবশ্য ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পর দুই ম্যাচেই বড় ব্যবধানে পরাজিত হয় পাকিস্তান। তবে পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সিরিজ সেরা নির্বাচিত হন রাজ্জাক।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...