মিলানে নড়বড়ে ব্রাজিলিয়ান নক্ষত্র

ফুটবলে ত্রয়ীদের নিয়ে বহু আলোচনা হয়। তেমনই এক ভয়ংকর ত্রয়ী ছিল ২০০২ বিশ্বকাপে- ব্রাজিলের। তিনজনের নামের আদ্যাক্ষর একই। বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের ‘র’ দিয়ে শুরু। রিভালদো, রোনালদো ও রোনালদিনহো। এই ত্রয়ীতে বুদ হয়ে ছিল একটা সময় গোটা ফুটবল বিশ্ব। এদের ফুটবলীয় শৈলী যেন ছিল মনোমুগ্ধকর কোন এক চিত্রকর্ম।

তাঁরা মাঠে থাকা মানেই দলের পক্ষে যেকোন সময় ম্যাচের গতিপথ ঘুরিয়ে দেবেন। সবুজ মাঠটার একটা দখল তাঁদের কাছে সব সময়ই ছিল। রোনালদিনহোর প্রতিভাবান খেলোয়াড় বিশ্ব ফুটবলে বেশ বিরল। তিনি বোধহয় জাদুই জানতেন। রিভালদোও একটা রাজত্ব চালাতেন স্ট্রাইকারের ঠিক পেছনের জায়গা থেকে। দলের স্ট্রাইকারদের গোলের সুযোগ করে দেওয়ার পথটা মসৃণ করবার সব দায়িত্বে তিনি ছিলেন পটু।

অন্যদিকে, রোনালদো নাজারিওর কথা তো আর বলার কিছু নেই। সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন হিসেবেই বিবেচিত হন তিনি। ডি-বক্সের আশেপাশে তাঁর মত ভয়ংকর বোধহয় খুব কম খেলোয়াড়ই ছিলেন। ইউরোপের প্রায় প্রতিটা দলেরই একটা আগ্রহের নজর সব সময়ই ছিল এই তিনজন খেলোয়াড়ের উপর। সেখান থেকে বাদ যায়নি ইতালির ক্লাব এসি মিলান।

এই ক্লাবটাই ব্রাজিলের আরেক কিংবন্তিকে লাইম লাইটে আসার পথটা করে দিয়েছিল। সে কিংবদন্তি ছিলেন রিকার্ডো কাকা। তবে থাক কাকার কথা আজ। রিভালদো, রোনালদো ও রোনালদিনহো এই তিনজন এসি মিলানে এসেছিলেন ভিন্ন সময়ে। তবে একটা বিষয়ে এই তিনজনের মিল ছিল। ইতালিয়ান ক্লাবটার হয়ে নিজেদের সেরা সময়ে আসেননি বা এসেই হারিয়েছিলেন নিজেদের দুর্দান্ত ফর্ম। বরং এসে একরাশ হতাশায় ডুবিয়েছেন ক্লাবের সমর্থকদের থেকে শুরু করে সবাইকে।

২০০২ সালে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর ব্রাজিলের প্রায় প্রতিটা খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে মুখিয়ে ছিল। তবে এসি মিলান গোল্ডেন বুট জেতা রোনালদো কিংবা বিশ্বকাপেই আলোড়ন সৃষ্টি করা রোনালদিনহোকে দলে নিয়ে আসেনি। তাঁরা বরং ভরসা রেখেছিল অভিজ্ঞতার বিচারে বাকিদের থেকে এগিয়ে থাকা ৩০ বছর বয়সী রিভালদোকে। এর বছর দুইয়েক আগে তাঁকে স্যান সিরোতে আনার প্রচেষ্টা চলেছিল। তবে সেবার আর নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

বার্সেলোনার সাথে সম্পর্কে তখন ফাটল ধরাতে চাননি রিভালদো। তবে বিশ্বকাপের পর ফ্রি এজেন্ট হিসেবে তাঁকে দলে ভেড়ায় এসি মিলান। তবে বিশ্বকাপের দুর্দান্ত রিভালদোর দেখা আর কখনোই মেলেনি এসি মিলানের জার্সিতে। মলিন পারফরমেন্স তিক্ততাই বাড়িয়েছিল। এর বেশি কিছুই যেন মিলানকে দিতে পারেননি রিভালদো। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার পর একটা লম্বা সময় পার হয়ে যায়।

২০০৭ সাল নাগাদ রোনালদোকে দলের ভেড়ায় এসি মিলান। তবে ততদিনে নিজের স্বর্ণালী সময় ফেলে এসেছিলেন রোনালদো। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ক্রমশ তাঁর পারফরমেন্সের গ্রাফটা নিম্নগামী হতে শুরু করে। এর পেছনে অবশ্য সবচেয়ে বড় কারণ ছিল রোনালদোর হাঁটুর ইনজুরি। বেশ কিছু অস্ত্রপচারও হয়েছিল। সেসবই ফুটবলের এই সেরা তারকার ধূর্ত স্ট্রাইকার সত্ত্বাকে বিপাকে ফেলে। মানসিকভাবেই যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন রোনালদো। যার ফলে নিজের শরীরে ওজনের দিকেও নজর দেননি রোনালদো।

ঠিক এমন একটা সময়ে তাঁকে আট মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে এনেছিল এসি মিলান। প্রথম বছরটা দলে ঠিকমত প্রভাবই ফেলতে পারেননি রোনালদো। পশ্চিম আকাশে সূর্য মিলিয়ে যাওয়ার মত করেই মিলিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে পরের মৌসুমে ২০ ম্যাচে নয় গোলের দেখা পান তিনি। আশাবাদী হয়ে উঠছিল যেন গোটা স্যান সিরো। তবে না, আরও একবার ইনজুরি। ব্যাস, সেখানেই মিলানে সাথে রোনালদোর সম্পর্কের সমাপ্তি। তবে ২০০৭ মৌসুমে রোনালদো দেখেছিলেন কাকার হাত ধরে মিলানের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের উল্লাস। সেটাই মিলানের এখন অবধি শেষ।

এতকিছুর পরও ২৮ বছর বয়সী রোনালদিনহোকে দলে এনেছিল মিলান। ২০০৮ সালে ২২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনার জার্সি ছেড়ে তিনি মিলানের জার্সি গায়ে জড়ান। তাঁর বিপক্ষে একটা অভিযোগ ছিল বার্সেলোনার। তিনি নাকি হারিয়ে ফেলছিলেন নিজের ফিটনেস। সে অভিযোগ মাথায় নিয়েই তিনি ইতালিতে পা রেখেছিলেন। তবে মিলানের জার্সিতেও খুব বেশি কিছু অর্জন করা হয়ে ওঠেনি তাঁর।

রোনালদিনহো থাকাকালীন সময়ে সিরি ‘এ’ তে তৃতীয় হয়েছিল ক্লাবটি। আর ইউরোপের মহারণে খুব বেশি দূর এগোতেই পারেনি মিলান। তিনিও বাকি দুই কিংবদন্তির মতই মিলানের রঙটাকে ফ্যাকাসে করেই বিদায় নিয়েছিলেন ক্লাব থেকে।

এসি মিলানে আসার আগে রিভালদো, রোনালদো, রোনালদিনহোরা ছিলেন নিজ নিজ জায়গায় সেরা। সাবেক ক্লাব কিংবা জাতীয় দলের হয়ে তাঁদের অর্জনের যেন কোন প্রকার কমতি ছিল না। তবে অমাবশ্যার রাতের মতই এই কিংবদন্তিদের মিলান অধ্যায়টা হয়ে রইলো অন্ধকারাচ্ছন্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link