তাতানগরের সবচেয়ে বড় তারকা হলে দীপিকা কুমারি, আর্চার। তবে, ওখানে কেবল এই দীপিকাই যে গ্রেটনেস ছুঁতে চান তা নয়। কিনান স্টেডিয়ামের ব্যাকড্রপে এই দীপিকার বড় একটা হোর্ডিং বোর্ড টাঙানো। এর নিচেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে রোজ স্বপ্নবাজ একগাদা তরুণকে দেখা যায় স্বপ্ন খোঁজার মিশনে অংশ নিতে।
তাঁরা ক্রিকেটার, রঞ্জি দলে খেলেন। ঝাড়খণ্ড দলের হয়ে। মহেন্দ্র সিং ধোনি – ঝাড়খণ্ড নামটা শুনলেনই নিশ্চয়ই মাহির কথা মনে পড়েছে সবার। নাহ, এই গল্পটা মাহির নয়। গল্পটা ‘উস্তাদজি’র। তিনিই ঝাড়খন্ড দলকে ২০১২-১৩ মৌসুমে নিয়ে গিয়েছিলেন রঞ্জির নকআউট পর্বে।
কিনানের মাঠে দাড়িয়ে সেই উস্তাদজিই তরুণ রঞ্জি খেলোয়াড়দের নানারকম গল্প করতেন। আসলে গল্প নয়, সবই সত্যি ঘটনা। এমন গল্পের মত সত্যি ঘটনার তো অভাব নেই এই উস্তাদজির জীবনে। এই উস্তাদজি হলেন তারাক সিনহা।
রঞ্জি ট্রফিতে তিনি দিল্লির হয়ে কোচিং করিয়েছিলেন প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় আগে। ২০১০-১১ সালে রাজস্থান তার অধীনেই প্রথম শিরোপা পায় রঞ্জিতে। এরপর ঝাড়খণ্ড, সেখানেও ইতিহাস – তারাক সিনহা হচ্ছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের আন সাং হিরো।
ঝাড়খন্ড শুধু দল নয়; সিনহার বেশ ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল এই। তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। বছরের পর বছর পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে ১২ জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার তিনি বের করেন। চার জেনারেশন ধরে তার একাডেমি থেকে প্রতি বছরেই ক্রিকেটার বের হচ্ছে! সেই সাথে তিনি দ্রোনাচার্য্য পুরষ্কারও জেতেন।
১০০ জনেরও বেশি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার তিনি তৈরি করেছেন এবং দুইটি রঞ্জি ট্রফির সাথে তার ঝুলিতে আছে ভারতীয় নারী দলের ঐতিহাসিক বিদেশ সফরে জয়। ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে স্বনামধন্য ক্রিকেট ক্লাব পরিচালনা করেন তিনি। ১৯৬৯ সাল থেকে সনেট ক্রিকেট ক্লাব পরিচালনা করে আসছেন তিনি। কোচ হিসেবে নিজের মধ্যে সবকিছুই আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন তিনি।
তিনি ক্রিকেটারই অবশ্য হতে চেয়েছিলেন, সেটাই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু, অনূর্ধ্ব-১৬ স্কুল ক্রিকেট ট্রায়ালে তাকে বাদ দেওয়া হয়। ক্ষোভে এর পরই তিনি অল্প বয়সেই কোচিং করানোর সিদ্ধান্ত নেন। নিজের স্বপ্ন পুরণ না হলে কি হবে – এখন তিনি গোটা ভারতবর্ষের স্বপ্ন পূরণ করে চলেছেন।
তখন অনূর্ধ্ব -১৬ দলের অধিনায়ক ছিলেন সালমান খুরশিদ। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেখানে সুযোগ পাননি। কারণ সেখানে দিল্লি পাবলিক স্কুল ও জাভিয়েরস এর মধ্যে কম্পিটিশন হতো, সেখান থেকে কারা সুযোগ পাবে। তিনি ছিলেন বিড়লা স্কুলের! যার জন্য তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর কোনো মেধাবি গরীবকে তিনি এভাবে অবহেলার শিকার হতে দেবেন না।
তিনি বলেন, ‘আমি খুব গরিব পরিবার থেকে এসেছিলাম, আমি হেটে অনুশীলনে যেতাম টাকা সঞ্চয়ের জন্য। আমার বাবা মাও আমাকে ক্রিকেট খেলতে বাধা দিত। কিন্তু আমি মনে করতাম আমি একদিন ভারতের হয়ে খেলবো। যদিও সেটা হয়নি।’
সাল ১৯৬৯ – কয়েকজন খেলোয়াড় নিয়ে সিনহা বানিয়ে ফেললেন সনেট ক্রিকেট ক্লাব। দিল্লীর আজমল খান পার্কে এই ক্লাব গঠন করেন তিনি। আস্তে আস্তে সে আরো কিছু খেলোয়াড় পেলো এবং সেখানে তাদের নিয়ে কোচিং করানো শুরু করলো।
হটাৎ দিল্লির দেব কলেজে কোচিং করানোর জন্য সুযোগ আসে তার, তবে তার ডেজিগনেশন হবে একজন পিয়ন! কারণ সেখানে ওই একটা পদেই লোক নেওয়ার উপায় ছিলো। সিনহা বলেন, ‘আমার প্রথম বেতন ছিলো ১১০ রুপি। মাঠে আমি কোচ ছিলাম যদিও কাগজে কলমে আমি ছিলাম পিয়ন। এরপর থেকে ১০ বছরের জন্য দেব কলেজ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন থাকে।’
আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম দিল্লী কলেজ ক্রিকেটে হিন্দু এবং সেন্ট স্টিফেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ভেঙে ফেলার জন্য। তিনি বলেছেন, ‘আর আমি এটা প্রমাণ করেছি কারণ দশ বছর ধরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে টিকে আছে দেব কলেজ।’
রাজস্থানের মতো দক্ষ পেশাদারদের নিয়োগের ব্যাপারটি বাজেট সমস্যা থাকায় ঝাড়খণ্ডের জন্য সেই প্রস্তাবটি গ্রহণ করা কঠিন ছিল। স্টেডিয়ামটি তৈরি করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল এবং সেখানে সেরা খেলোয়াড়রা খেলতে রাজি ছিল না। ধোনি খেলতে অস্বীকার করেছিলেন এবং বরুণ অ্যারন পুরো সময়টা জুড়ে পিঠে ইনজুরির কারণে খেলা থেকে দূরে ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি যখন এসেছি, তখন দলের প্রত্যেকের মধ্যে খুব ভালো কিছু অনুভব করেছি, যা আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু যা আমাকে অবাক করে সেটা হলো প্রত্যেকে প্রত্যেকেকে নিজেদের মধ্যে সেরা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। আইপিএল খেলোয়াড়রা ফ্র্যাঞ্চাইজি কিট পরে অনুশীলন করতে আসত এবং অন্যদেরকে তাদের গ্ল্যামার দিয়ে ভয় দেখিয়েছিল! সিনহা বলেন, তিনি ঝাড়খন্ডের ক্যাপগুলি পেয়েছিলেন এবং দলের ট্র্যাকসুট তৈরির জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। তার মাথায় থাকাকা সাদা ঝাড়খণ্ডের ঢিলে ঢালা টুপির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘আমি তাদের বলেছিলাম ক্যাপটির মূল্য দিতে, ক্যাপের জন্য খেলতে। আপনি যখন নিজের রাষ্ট্রকে সম্মান করবেন কেবল তখনই ভারত জাতীয় দলের ক্যাপের প্রতি মর্যাদা দেখাতে পারবে।’
সিনহা সহজাত, প্রায়শই বিতর্কমূলক ও সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত। একবছরের হার্নিয়ার চোট থেকে ফিরে আসা অশোক মেনেরিয়াকে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং ২০১০-১১ মৌসুমে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে রাজস্থানের কোয়ার্টার ফাইনালের আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান পুণেত যাদবকে বাদ দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়েছিল। তবে সিনহা অনুভব করেছিলেন মেনারিয়া দলের হয়ে বড় ম্যাচ খেলোয়াড় হিসেবে খেলবে। ২২ বছর বয়সী এই বাঁহাতি খেলোয়াড় কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালের পাশাপাশি ফাইনালের সেঞ্চুরি করেছেন।
তিনি বলেন, ‘নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে সাহসের প্রয়োজন।’
আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের প্রতিনিধিত্বকারী, বোলিংয়ের নায়ক, ডানহাতি ব্যাটসম্যান অজয় যাদবকে দলে নিতে
ঝাড়খণ্ডের পেসার রাহুল শুক্লাকে তিনি বাদ দিয়েছিলেন! এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাকে দেখতে হবে কোন খেলোয়াড়েরকে কৌশল শেখাতে হবে আর কোন খেলোয়াড়ের জন্য অনুপ্রেরণাই যথেষ্ট। যাদবের মতো খেলোয়াড়দের কেবলমাত্র অনুপ্রেরণা প্রয়োজন। আমি তাকে বলেছিলাম যে যদি সে পাঁচ উইকেট নিতে পারে তাহলে আমি ওয়াকলে সানগ্লাসটি উপহার দিব এবং পরের দিনই সে সেটা করেছে!’
১২ জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের গুরু তিনি। তাও তালিকাটা যেন তেন নয়, মনোজ প্রভাকর, রমন লাম্বা, আশিষ নেহরা, শিখর ধাওয়ান, আকাশ চোপড়া, অজয় শর্মা কিংবা আজকের ঋষাভ পান্ত। রহস্যটা কি? সিনহা বলেছিলেন, ‘কখনও বন্ধু, কখনও শিক্ষক,আবার প্রয়োজন হলে পিতা মাতার মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা ঘরোয়া ক্রিকেটে সকলে একই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসে না। সৌরভ তিওয়ারির মতো খেলোয়াড় যে কিনা আইপিএল এর প্রাচুর্যতা দেখেছে তাদেরকে আমার যুক্তি, ধারনার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য দরকারি পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। আমি কিছু কৌশলগত পরিবর্তন এনেছিলাম তার খেলায়, যা তাকে উপকৃত করেছে।’
যেখানে সফলতার শুরু সেখানে আর্থিক সমস্যাগুলো আার আঘাত আনতে পারে না। তারক সিনহার সকল টাকা তিনি এই ক্লাবে বিনিয়োগ করার পর তার অবস্থা এমন হয়েছিল যে দিল্লিতে তাকে তার বাসা ছাড়তে হয়েছিল। তার এমন বিপদাপন্ন অবস্থায় তাঁর সাবেক শিক্ষার্থী ভারতীয় পেসার আশীষ নেহরা তাকে সাহায্য করেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব। আমি আশীষ কে ফোন দেই এবং সে আমাকে বলে, “স্যার, আমি থাকতে আপনাকে কোন দিন রাস্তায় থাকতে হবে না। সে আমাকে থাকার নতুন জায়গা দেয় এবং বলে যে তার উপর অগাধ বিশ্বাসের জন্য এটি একটি সামান্য উপহার।’
সিনহা একজন স্ব-শিক্ষিত কোচ, বই পড়া থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। তারপর দক্ষতা বাড়াতে সকল অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ করেন। তিনি ‘ডেস্কটপ’ কোচিংয়ের ধারণাটিকে এবং ক্রিকেট বোর্ডের তথাকথিত যোগ্য কোচদের ভুল প্রমাণিত করেন। তিনি বলেন, মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য কোচিং করে কেউ কখনো ভাল হতে পারে না। আমি যে কোন বড় এনসিএ (ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি, ব্যাঙ্গালোর) একাডেমিতে কৌশলগত শিক্ষা সহ আরো নানা শিক্ষা প্রদান করতে পারি। কিন্তু দিন শেষে আমাকে তার ফলাফল এনে দিতে হবে।’
খেলোয়াড়েরা বলে যে তিনি রাত তিনটায় উঠে ম্যাচের পরিকল্পনা করতেন। তার জীবনের কোনো খেলার দিন নাই যে তিনি মাঠে ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু ক্রিকেট নিয়ে চিন্তা করি। রাজনীতি কিংবা মুভি আমাকে আকৃষ্ট করে না। আমি যদি কারো ভালো খেলতে দেখি মাঝে মাঝে আমি লাঞ্চও মিস করি। আমি খেলোয়াড়দের নামে মনে রাখি না তাদের চেহারা এবং খেলার স্টাইল দেখে মনে রাখি।’
তার পুরো জীবনে নিজেকে নিয়ে না ভেবে তিনি ক্রিকেট নিয়ে ভেবেছেন এবং সবটুকুই তিনি ক্রিকেটে দিয়েছেন। সেজন্যই হয়তো তাঁর শিষ্যদের কেউ হন ‘গাব্বার’ কেউ বা অজি অহঙ ভেঙে গ্যাবা জয়ের মানসিকতা রাখেন, কেউ বা বিশ্বকের বুঝিয়ে দিতে পারেন, বয়স স্রেফ একটা সংখ্যা!
– ইন্ডিয়া টুডে’র ছায়া অবলম্বনে